তনু হত্যার বিচার পেতে কি ৪৫ বছর লাগবে

মাকসুদা আকতার প্রিয়তি , আমরা বাঙালি জাতি। আমাদের সভ্যতা হাজার বছরের, কিন্তু আমরা কি পেরেছি এখনো সভ্য হতে? শুধু আমার মনে কেন এই প্রশ্ন এখন সবার যারা সভ্য। সভ্য মানে আবার যারা সভ্যতার পোশাক পরা তাদের কথা বলছি না। যারা সভ্য হতে অসভ্য হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে অচেনা কোনো নারীর ন্যায় এর জন্য। আমি সেইসব সভ্য মানুষের কথা বলছি।

স্বাধীনতার ৪৫ বছর চলছে। আর ৪৫ বছর ধরে আমরা ধর্ষণের বিচার করছি। তাহলে কি সদ্য খুন হয়ে যাওয়া তনুদের মতো মেয়েদের ধর্ষণের বিচার আমরা ৪৫ বছর পরে পাবো নাকি শুধু এতটুকু বলে ছেড়ে দেব-‘আল্লাহ তোদের বিচার করবে’। আমরা এমন একটি দেশের নাগরিক যে দেশের সরকার প্রধান নারী আর বিরোধী দলের নেতাও নারী। কিন্তু আমরা আমজনতা নারী জাতি যেন ছারপোকা মাত্র। বাসা হতে শুরু করে স্কুল কলেজ, ভার্সিটি, চাকরি জীবন আর হোক না স্বামীর বাড়ি- প্রতি পদে পদে আমরা হচ্ছি ধর্ষিতা। যার হয়তো ১০% আমাদের দৃশ্যমান হয়। আর বাকিটা চাপা পড়ে যায় লজ্জা নামের শেকলে। দোষটা কি আমাদের। আমরা নারী হয়ে জন্মেছি, নাকি সমাজ ব্যবস্থা আমাদেরকে নারী বানিয়েছে। নাকি পুরুষতান্ত্রিক এ জাতির পুরুষের মাঝে কিছু কাপুরুষের অপকর্মের কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

আমার জানামতে মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী বিগত তিন মাসে ১৫৮ জনের বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। কি উপজাতি, কি গ্রামের মেয়ে, কি স্কুল পড়ুয়া ছাত্রী, কি তনুর মতো ভার্সিটির স্টুডেন্ট কারো রক্ষা নাই। কখনো নিজ বাসায় হতে হচ্ছে লাঞ্ছিত, কখনো সোকলড আত্মীয়ের হাতে, কখনো স্কুলে, কখনো হাসপাতালে, কখনো অফিসে, কখনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। রাস্তাঘাট, মার্কেট আর পাবলিক প্লেস তো বাদই দিলাম। কারণ হালকা গুতা আর বাড়ি এতো আমাদের মেয়েদের প্রতিদিনের সঙ্গী যেন।

আসলে বিষয়টা একটা ক্যান্সারের মতো ব্যাধি যেন। গোটা নারী সমাজকে গ্রাস করছে আর পুরুষ সমাজকে তাদের সমাজে পুরুষ হবার মূল্যবোধ নষ্ট করছে। ব্যাধি যেমন আছে, আছে তার প্রতিকারও। আসলে জানতে হবে কেন হচ্ছে? কি করলে আমরা এই সামাজিক ব্যাধি থেকে পরিত্রাণ পাবো। সমাজের প্রতি আমাদের মূল্যবোধ আসে প্রথমে পারিবারিক পরিবেশ হতে। তাই সবার আগে পরিবার থেকেই নারীদের সম্মান করতে হবে, সুদৃষ্টি দিয়ে অন্যথায় আমরা গোটা জাতিকে সম্মান করতে পারবো না।

আমরা অনেকে বলি উগ্র পোশাকের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থার্টি ফাস্ট-এ সেই মেয়েটি লাঞ্ছিত হয়েছিল। তাহলে তনুদের মতো হিজাব পরা মেয়েদের কি দোষ দেবেন? কি বলে বুঝাবেন সমাজকে, আপনি যে অপকর্মটি করেছেন সেটা সভ্য মানুষের কাজ নয়। আসলে সুদৃষ্টিকে অনুশীলন করতে হলে, ভাবতে হবে আমি যে নারীটিকে দেখছি সে একটা মাংসপিন্ড নয়। সেও মানুষ। তারও মন আছে, আছে আত্মসম্মান, আছে সামাজিক মূল্যবোধ।

একটা মেয়ে যদি শুধু পোশাকের জন্য ধর্ষিত হতো তাহলে উন্নত দেশগুলোয় ছোটবেলা থেকেই অনেক মেয়ে ধর্ষণের শিকার হতো। আসলে সেইসব দেশে নারীদের জন্য পুরুষের চোখে সম্মানের পর্দা আছে। আর সেই সম্মান কেন? নারীকে শুধু নারী ভাবলেই আমাদের বাঙালি নারী তুষ্ট হয়। তাই অন্তত পক্ষে নারীকে নারী ভাবুন, দেখবেন আমাদের নারী একদিন আমাদের পুরুষজাতি নিয়ে গর্ব করে বলবে-‘আমরা এদেশের নারী আমরা সুরক্ষিত সবখানে।’ হিরো হওয়ার জন্য সাকিব আর মাশরাফির মতো ছক্কা হাঁকাতে হবে না। আপনার দৃষ্টিভঙ্গি আপনাকে হিরো করে দিতে পারে কোনো একজন অচেনা নারীর কাছে। সুদৃষ্টি আর সম্মান করা প্র্যাকটিস করতে হবে। বাসা হতে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, রাস্তাঘাট সবখানে। অন্যথা সেইদিন বেশি দূরে থাকবে না যেদিন মানুষ আমাদের দিকে আঙ্গুল তুলে বলবে-`ঐ দেখ বর্বর জাতি যায়`।

পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে কি এমনটি হয় একটি ছেলে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে মেয়েটিকে এসিড মেরেছে? না! কিন্তু আমরা করি কারণ আমাদের মধ্যে প্রতিহিংসা কাজ করে। কেন এই প্রতিহিংসা? কেন পারিনা আমরা পজিটিভ ভাবতে? যাকে এসিড মারছি সেও তো কারো বোন আমাদের বোনের মতো। প্রতিযোগিতা করুন সম্মানিত হওয়ার জন্য। দেখবেন একদিন সেই মেয়ে গর্ব করে বলবে ‘ঐ সম্মানিত পুরুষটা আমাকে ভালোবাসতো কখনো।

আসলে ধর্ষণের প্রতিকার যদি খুঁজতে চাই তাহলে আমি বলবো আমাদের আত্মার শুদ্ধিকরণ করতে হবে। তখন হয়তো প্রশাসনের নজর না দিলেও চলবে। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় আমাদের দেশে আইন আছে ঠিকই কিন্তু তার সঠিক প্রয়োগ নেই। টাকা পয়সা-প্রভাব প্রতিপত্তির উর্ধ্বে ওঠে যদি আমাদের নারী তার ওপর নির্যাতনের বিচার পায় তাহলে সেদিন দূরে নাই আমাদের দেশে ‘ধর্ষণ’ শব্দটা অতীত হয়ে যাবে।

নারীদের সম্মান দিচ্ছি- শুধু এটা বলে কর্তৃপক্ষের নিজের দায়িত্ব ছেড়ে দিলে হবে না। এটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। হতে পারে এমন একটা সময় আসবে যখন নারীরা পুত্রসন্তান জন্ম দিতে নারাজ হবে। সেদিন ভাবা যাবে না কেন এমন হচ্ছে? একটা নারীর নরম মন এতো শক্ত কেন? উত্তরটা আমাদের সবারই জানা। মনটাকে আমরা অন্যায়, অবিচার ও অত্যাচার করে বিষিয়ে তুলেছি দিন দিন। পরিশেষে বলতে চাই, আমরা নারী জাতি, মায়ের জাতি, আমারা শুধু সম্মানের জায়গাটুকু চাই। দেখবেন আপনাদের চলার পথে ভালো বন্ধুটা আমরাই হবো। আপনি পুরুষ ভালো থাকবেন, আমরা নারী ভালো থাকবো। তাহলে ভালো থাকবে দেশ আর গোটা জাতি। শেষটা করতে চাই রবীন্দ্রনাথের আরম্ভ ও শেষ কবিতাটির কিছু লাইন দিয়ে-

`শেষ কহে, একদিন সব শেষ হবে,

হে আরম্ভ, বৃথা তব অহঙ্কার তবে।

আরম্ভ কহিল ভাই, যেথা শেষ হয়

সেইখানে পুনরায় আরম্ভ- উদয়।’

শেষ বলে কিছু নেই। চলুন আজ হতে সহমর্মিতার উদয় ঘটাই।

লেখক : বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মিজ আয়ারল্যান্ড (২০১৪, মিজ আর্থ(২০১৬), মডেল ও চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। পেশাগত জীবনে বৈমানিক।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর