সরেজমিনে নাঙ্গলকোট পৌরসভা নির্বাচন ‘এ জীবনে আর কি নিজের ভোট নিজে দিতে পারব না

২০ মার্চ ২০১৬ রোববার সকাল সাড়ে ৯টা বাজবে হয়তো। নির্বাচন কভার করতে যাওয়া স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকদের গাড়িটি তখন নাঙ্গলকোট পৌর সভার দাউদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে থামে। সাংবাদিক লেখা স্টীকার যুক্ত গাড়িটি দেখেই তৎপর হয়ে উঠল এতক্ষণ ধরে অলস সময় পার করা আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা, কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার ও বহিরাগত ক্যাডাররা। যারা এতক্ষণ এলোমেলো ভাবে লাইনে দাঁড়ানো ছিল। কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলতে শুরু করল, এই সাংবাদিক এসেছে, সোজা হয়ে লাইনে দাঁড়া। বলার সাথে সাথে শান্ত বালকের ন্যায় সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। ততক্ষণে আমরা ও গাড়ি থেকে নেমে কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। এমন সময় লক্ষ করলাম, একজন ১৫/১৬ বছরের বালকের হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলে কালির দাগ পড়ে আছে। উৎসুক মন নিয়ে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই, আপনি কি ভোট দিয়েছেন। জানাল না, দেখছেন না, লাইনে দাঁড়িয়ে আছি ভোট দেয়ার জন্য। আমি বললাম আপনার হাতে তো ভোট দেওয়ার কালির দাগ রয়েছে, এই যে । এ কথা বলতেই ঐ কিশোর লাইন ছেড়ে দিল ভোঁ দৌঁড়। পরে একে একে গুনে দেখলাম, কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত প্রায় ৭/৮ জনের হাতে কালির দাগ রয়েছে। জাল ভোট দেওয়ার জন্য যাদের জনপ্রতি ৩০০ টাকা দিয়ে ভাড়া করে গ্রাম থেকে আনা হয়েছে। আমাকে ফলো করে আছে লাইনের বাহিরে থাকা ২ জন নেতা। যাতে আমি তাদের কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করি। বিষয়টি বুঝতে পেরে আমিও কৌশল পাল্টালাম। । সাংবাদিক তরুন, সোহাগ ও হাবিব কে বুথ কক্ষটি দেখার কথা বলে একটু রাস্তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম, ঐ ২ জন ক্যাডার আর আমাকে ফলো না করে আমার ঐ সহকর্মীদের পেছন নিল যাদের আমি বুথ কক্ষে পাঠিয়েছি। এ সুযোগে আমি কেন্দ্রের পেছনে গিয়ে দেখি কিছু দূরে ২টি লম্বা টুলে ৪/৫ জন তরুণ বসে হাসাহাসি করছে। কথা বলে জেনে নিলাম, তারা নৌকার সমর্থক। এখানে টুল নিয়ে বসে আছেন কেন জানতে চাইলে তারা উত্তর না দিলেও আরেকটু এগিয়ে কিছুটা মহল্লার ভিতরে গিয়ে জেনে নিলাম টুল নিয়ে বসে থাকার নেপথ্যের কাহিনী।
একটু এগোতেই দেখি কয়েকজন বৃদ্ধ লোক দাঁড়িয়ে কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। সামনে গিয়ে তাদেরই একজন মৃত জিন্নাত আলীর পুত্র আবদুর রশীদ (৭০)। পেশায় কৃষক। ভোট দিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে আবেগ আপ্লুত ভাবে তরিত্ব জবাব এল, ‘বাবা, জীবনে বহুবার ভোট দিয়েছি। তবে এ জীবনে আর ভোট দিতে পারব বলে মনে হয় না। কেন পারবেন না জানতে চাইলে, ইশারা দিয়ে দেখালেন, লম্বা টুলে বসা যুবকদের দিকে। বললেন, কোন ভোটার যাতে কেন্দ্রে না যেতে পারে সেই জন্যই তারা এখানে বসে পাহারা দিচ্ছে। একবার তৌহিদ ও রুহুল আমিনকে নিয়ে সামনে এগুতেই বলে দিয়েছে, আপনারা তো আমাদেরই ভোট দিবেন। তাই কষ্ট করে যাওয়ার দরকার নেই। আমরা সিস্টেম করে দিয়েছি। আপনাদের কেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই।’
এই অবস্থা শুধু দাউদপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে না, নাঙ্গলকোট পৌরসভার যে ৬/৭ টি কেন্দ্রে গিয়েছি তার প্রতিটি কেন্দ্রেই ছিল দাউদপুর কেন্দ্রের অবিকল চিত্র। তবে নাঙ্গলকোট ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে আমরা থাকা অবস্থায় ৯টা থেকে সোয়া ৯ টা পর্যন্ত কোন অনিয়ম চোখে পড়ে নি। পড়ে অনিয়ম হয়েছে কি না বলতে পারব না।
বাতুপাড়া , নাওগোদা, খান্না পাড়া, ধাতীশ্বরসহ যে সকল কেন্দ্রেই গিয়েছি, দেখেছি এক অভিনব ভোট ডাকাতির চিত্র। প্রতিটি কেন্দ্রে সকালেই ক্ষমতাসীন দলের এজেন্টরা প্রতিপক্ষের এজেন্টদের বের করে দিয়ে প্রিজাইডিং অফিসার থেকে এজেন্ট ফরম নিয়ে ফিলাপ করে ধানের শীষের এজেন্ট সেজে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ভোটাধিকারকে গলা টিপে হত্যা করে চলছে নির্মম ভাবে।
দাউদপুর গ্রামের কৃষক আবদুর রশীদের কথা বার বার চোখের সামনে ভেসে আসছে। বাবা, এ জীবনে কি আর নিজের ভোট নিজে দিতে পারব না।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রসঙ্গ উঠাবো না। এ সম্পর্ক সবাই ওয়াকিবহাল। কিন্ত যে ভাবেই হোক, একটা নির্বাচনের মধ্যে দিয়েই যখন একটি সরকার গড়ে উঠেছে সে সরকারের কাছে কি ভোট দেওয়ার অধিকারটি চাইতে পারে না আবদুর রশীদেরা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচন, এর পর হয়ে গেল পৌরসভা নির্বাচন। সারা বাংলাদেশের কথা পত্রিকায় পড়েছি কিন্ত চোখে দেখি নি। কিন্ত আমার কুমিল্লায় আমি চোখে দেখেছি, সরেজমিনে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। হলফ করে বলতে পারি, কয়েকটি কেন্দ্রে ব্যতিক্রম ছাড়া জনগন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে নি। আবদুর রশীদরা সব জায়গায়ই শেষ অবলম্বন হিসেবে সাংবাদিকদের কাছে তাদের আকুতি জানিয়েছে। আমরা ও আমাদের কলমের মাধ্যমে তাদের চাপা ক্ষোভ, অব্যক্ত বেদনা ও বোবা কান্না গুলো পত্রিকায় তুলে ধরে সদাশয় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করে যাচ্ছি। হয়তো আরো চেষ্টা করে যাবো।
লেখাটি শেষ করব, গত পৌর নির্বাচনে লাকসাম পাইলট হাই স্কুল কেন্দ্রে ভোট দিতে না পেরে ফিরে যাওয়ার সময় ক্ষুদ্ধ এক স্কুল শিক্ষকের কথা দিয়ে। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ভাই, যে বঙ্গবন্ধু সারা জীবন ভোটের অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছেন, জেল, জুলুম, নির্যাতন ভোগ করেছেন, সেই অবিসংবাদিত নেতার হাতে গড়া মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাছে আজ ভোটের অধিকার হরণ হবে এটা যেন কিছুতেই মানতে পারছি না। ভদ্রলোক স্কুল শিক্ষকের এই বক্তব্য শুধু তার নয়, এই বক্তব্য দেশের প্রতিটি গণতন্ত্রকামী মানুষের। অপেক্ষায় থাকলাম সেই দিনের যে, দিন আর কাউকে ভোট দেওয়ার জন্য আক্ষেপ করে বলতে হবে না, বাবা, এ জীবনে কি আর নিজের ভোট নিজে দিতে পারব না?

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর