সহিংসতার শঙ্কা, ইসির অভয়

দেশের ৩৪ জেলার ৭৩৪টি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) নির্বাচন মঙ্গলবার। প্রথমবারের মতো চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় অন্যান্য বছরের চেয়ে এই নির্বাচন ঘিরে দেখা দিয়েছে সহিংসতাসহ নানা ধরণের আশঙ্কা।

বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় সহিংসতায় রোববার পর্যন্ত সাতজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দুই হাজারের বেশি। ভোট উৎসবের আগে সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভোটার ও প্রার্থীদের মধ্যে এক ধরণের ভয় ও শঙ্কা বিরাজ করছে।

যদিও নির্বাচনী এলাকায় মাঠে টহল শুরু করেছে বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ড ও আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১ লাখ ৮০ হাজার সদস্য। সঙ্গে রয়েছে নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। যে কোন বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে প্রস্তুত নির্বাচন কমিশনও (ইসি)। কিন্তু মাঠ পযায়ের পরিস্থিতিতে সন্তোষ্ট নন ভোটাররা।

রোববার মধ্যরাতেই শেষ হচ্ছে সব ধরেনের প্রচার-প্রচারণা। মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোটগ্রহণ চলবে। নির্বাচনী এলাকায় সোমবার মধ্যরাত থেকেই সব ধরনের যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

চেয়ারম্যান পদে ৩ হাজার ৩৪ জনসহ মোট ৩৬ হাজার ৪৫৬ জন প্রার্থী এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রায় ৭ হাজার ৮৭টি কেন্দ্রে ১ লাখ ২১ হাজার ১৯৫ জন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকবেন বলে ইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ইসি কর্মকর্তারা জানান, প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে নির্বাচনী পরিবেশ। প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, বাড়ি-ঘর ভাংচুর, প্রচারে বাধা দেয়াসহ সহিংস ঘটনা বেড়েই চলছে। একই সঙ্গে আসছে আচরণ বিধি লংঘনের অভিযোগ।

কোথাও কোথাও প্রার্থী ও ভোটারদের এলাকা ছাড়তে বাধ্য করায় শেষ মুহূর্তে ইসিতে অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়েছে। এসব ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রিটার্নিং কর্মকর্তাকে ব্যবস্থা নিতে শুধু নির্দেশনা পাঠিয়ে দায় সারছে ইসি।

অভিযোগ রয়েছে, ওইসব ঘটনায় কমিশন সচিবালয় থেকে মনিটরিং ও দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। উল্টো গত এক সপ্তাহের বেশি সময়ে প্রশিক্ষণ ও সরকারি সফরের নামে দুইজন নির্বাচন কমিশনার ও কমিশন সচিবালয়ের সচিবসহ অর্ধডজন ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা ঢাকার বাইরে অবস্থান করেছেন।

তবে প্রস্তুতির শেষ মুহূর্তে ভোটার ও প্রার্থীদের অভয় দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ। নির্বাচনে বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটনার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, ইউপি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্য নিয়োগ করা হয়েছে। রোববার ইসি কার্যালয়ে তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, ভোটের জন্য আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি। সোমবার ব্যালট পেপার কেন্দ্রে কেন্দ্রে পৌঁছে যাবে। এখন পর্যন্ত মাঠের যে খবর পেয়েছি, তাতে আমরা অত্যন্ত আশাবাদী-নির্বাচন সুষ্ঠু হবে।

অনিয়ম রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মাঠ পর্যায়ে পাঠানো নির্দেশনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ভোটারদের আশ্বস্ত করতে চাই- আমরা পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করেছি। আপনারা নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে নির্বিঘেœ ভোট কেন্দ্রে যাবেন। নির্বাচনে সব ধরনের অনিয়ম রোধে রিটার্নিং অফিসারদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

প্রার্থীদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দল যারা থাকবে তারা অভিযোগ করবে- এটা একটা ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরও আমরা বাস্তবসম্মত যে সব অভিযোগ পেয়েছি- সেগুলোর ব্যবস্থা নিয়েছি। সব অভিযোগ খতিয়ে দেখেছি।

অনিয়ম রোধে কোনো ছাড় না দেয়ার নির্দেশনা দেয়ার পরও দায়িত্বে অবহেলা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ।

সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সংঘাত-সংঘর্ষ হলেই ব্যবস্থা নেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আমরা বলে দিয়েছি-কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বরদাশত করা হবে না। এটা মুখের কথা নয়। অনিয়ম করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। কেউ ছাড় দিলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শাহ নেওয়াজ বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছি আমরা। এরপরও কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে- তা আমাদের নজরে এসেছে। বেশ কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছি। আশা করি, সামনে বড় ধরনের অঘটন ঘটবে না।

ইসি কর্মকর্তারা জানান, ইউপিতে প্রথম ধাপে ইতোমধ্যে ৫৪ জন চেয়ারম্যান, ১৭৯ জন সাধারণ সদস্য ও ৫৪ জন সংরক্ষিত সদস্য পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

প্রথম দফার নির্বাচনে ৩ হাজার ৩৪ জন চেয়ারম্যান, সাধারণ সদস্য পদে ২৫ হাজার ৮৪৭ জন ও সংরক্ষিত পদে ৭ হাজার ৫৭৫ জন প্রার্থী রয়েছেন।

এরপর আরও পাঁচ ধাপে দেশের বাকি সাড়ে তিন হাজার ইউপিতে ভোট হওয়ার কথা রয়েছে।

ভোটার ও ভোটকেন্দ্র:

এ ধাপে ৭ হাজার ৮৭টি ভোটকেন্দ্রে ভোট হবে। এসব ভোট কেন্দ্রে বুথের সংখ্যা ৩৮ হাজার ৩৬টি। এ হিসাবে প্রতি কেন্দ্রে ১ জন করে ৭ হাজার ৮৭ জন প্রিজাইডিং অফিসার, প্রতি বুথে ১ জন করে ৩৮ হাজার ৩৬ জন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং প্রতি বুথে ২ জন করে ৭৬ হাজার ৭২ জন পোলিং অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মোট ভোট গ্রহণ করবেন ১ লাখ ২১ হাজার ১৯৫ জন কর্মকর্তা। এতে পুরুষ ভোটার ৫৯ লাখ ৯৫ হাজার ২৬৯ জন এবং নারী ভোটার ৫৯ লাখ ৪২ হাজার ৬৯৪ জন।

শেষ প্রচার–প্রচারণা, অপেক্ষা ভোটের:

রোববার মধ্যরাতেই শেষ হচ্ছে সবধরণের প্রচার-প্রচারণা। নির্বাচনী আইন অনুযায়ী কোনো নির্বাচনী এলাকার ভোটগ্রহণ শুরুর পূর্ববর্তী ৩২ ঘণ্টা, ভোট গ্রহণের দিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা এবং ভোটগ্রহণের দিন রাত ১২টা থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উক্ত নির্বাচনী এলাকায় কোনো ব্যক্তি কোনো জনসভা আহ্বান, অনুষ্ঠান বা তাতে যোগদান করতে এবং কোনো মিছিল বা শোভাযাত্রা সংঘটিত করতে বা তাতে যোগদান করতে পারবে না। এই বিধি লঙ্ঘন করলে অন্যূন ৬ মাস বা অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

মাঠে আইন–শৃঙ্খলা বাহিনী:

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে মাঠে নামছে বিভিন্ন বাহিনীর এক লাখ ৮০ হাজার সদস্য। একই সঙ্গে ৩৪ জেলার ১০১টি উপজেলায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের পাশাপাশি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরাও অপরাধ তদারকিতে মাঠে রয়েছেন।

দ্রুত ফলাফল পাঠাতে নির্দেশনা:

ভোটগ্রহণ ও গণনা শেষে দ্রুত ফলাফল পাঠাতে রিটার্নিং অফিসারদের বিশেষ নির্দেশনা পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রোববার বিকেলে এ বিশেষ নির্দেশনা সকল রিটার্নিং অফিসারকে পাঠানো হয়েছে বলে ইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। পাশাপাশি ভোটগ্রহণ শেষে ফলাফল ঘোষণা ও পরবর্তী সময়ে যাতে সহিংসতার সৃষ্টি না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে।

নির্বাচনী এলাকায় সাধারণ ছুটি:

নির্বাচনের কারণে ৭৩৪ ইউপিতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ফলে নির্বাচনী এলাকায় সকল অফিস বন্ধ থাকবে।

যান চলাচল নিষিদ্ধ:

শনিবার মধ্যরাত থেকে নির্বাচনী এলাকায় মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া ভোটের আগের রাত থেকে পরবর্তী ৩২ ঘণ্টা সব ধরনের যান চলাচল নিষিদ্ধ করেছে ইসি। তবে রিটার্নিং কর্মকর্তার অনুমতি সাপেক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা তাদের নির্বাচনী এজেন্ট, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক ও অনুমোদিত সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে তা শিথিল থাকবে।

ইসির ঘোষণা অনুযায়ী প্রথম ধাপে ২২ মার্চ ৭৩৪টি, ২৩ মার্চ নাগরপুরে ১১টি এবং ২৭ মার্চ টেকনাফের দুটি ইউপি, দ্বিতীয় ধাপে ৩১ মার্চ, তৃতীয় ধাপে ২৩ এপ্রিল, চতুর্থ ধাপে ৭ মে, পঞ্চম ধাপে ২৮ মে ও ষষ্ঠ ধাপে ৪ জুন ভোট হওয়ার কথা রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর