পরীক্ষিত চৌধুরীঃ
শ্রাবণের মেঘগুলো আকাশে জড়ো হলে বটে
বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বার কোন লক্ষণ তাদের মাঝে নেই
কয়েকজন নিজেদের মধ্যে খোশগল্পে মশগুল
দুই বালিকা মেঘ একজন আরেকজনের উকুন মারতে ব্যস্ত
এক উদাসী মেঘ
পৌরাণিক তারাদের পানে চেয়ে আছে অপলক —
এক যুগল পরস্পরের হাত ধরে,
আকাশে হেলান দিয়ে;
তাদের শরীরের ঘর্ষণে এক অপার্থিব আলো ঠিকরে এসে পড়ে আমার সম্মুখে।
অফিস শেষে বাসার দিকে বেরোবো
দোতলার সিঁড়ির ল্যান্ডিং- এ পথ আটকে দাঁড়িয়ে
দুটো কুকুর।
কালোটি বয়সে বড় আর সাহসী,
বাদামি রংয়েরটি অল্পবয়সী এবং নিতান্তই গোবেচারা।
কাজ শেষ করতে করতে মাঝরাত্তির;
তারপর আবার এই দুটোর পথ আগলে রাখার একগুঁয়েমি,
পাশ কেটে এগিয়ে চললাম।
পিছনে তাকিয়ে ওদের আর দেখতে পেলাম না
কেন যেন একটু মন খারাপ হলো আমার।
একটা সিএনজি ভোঁ
করে ছুটে গেলো পাশ দিয়ে।
ঔজ্জ্বল্য ছড়ানো সোলার ল্যম্পপোস্টগুলো পেরিয়ে মিলিয়ে গেলো হাইকোর্টের মাজারের দিকে।
একপাল গরু সড়ক বিভাজন টপকে দ্রুত হেঁটে চললো।
এসময় এদিকটাতে গাড়ি চলে কম
তিন চারদিন শহরে থেকে তারাও বোধহয় এটা
বুঝে গেছে।
গতিময় শহরের সাথে তাল মেলাতে, নাকি পুনর্জীবন লাভের আনন্দে তাদের চলনে এমন দ্রুততা, কে জানে?
যে মালিকপুত্র পোষ্য হারানোর শোকে তিনদিন না খেয়ে আছে
তার সাথে পুনর্মিলনের ব্যাকুলতায় আরো দ্রুতবেগে ছুটে চলে কয়েকটা ছাগল।
স্বজনের রক্তভেজা পথ পেরিয়ে ছুটে চলে ওরা,
বাতাসে স্বজনের মাংসের গন্ধ।
রাখালগুলোর হতাশাগ্রস্ত বিধ্বস্ত শরীর
তাল সামলাতে পারছেনা নিরীহ পশুগুলোর গতির সাথে,
যেন অনাদিকাল তারা
‘পথ হাঁটিতেছে পৃথিবীর পথে’।
রাখাল গরুর পাল নিয়ে ফিরে গ্রামে।
মন খারাপের মাত্রা আরো চড়া হলো যেন।
হাসপাতালের সামনে লোকজনের ভিড়
ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো আগুনে পোড়া কয়েকটা লাশ
কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি? গার্মেন্ট কারখানা?
কোমল পানীয় তৈরির বহুতল ভবন?
নাকি গ্যসলাইন?
সড়কে থেঁতলে যাওয়া দুটো লাশও বেরোলো নাকি?
নাকি…?
নাকি…?
নাকি…?
গেইটের সামনে বুম নিয়ে দাঁড়িয়ে এক ঝাঁক সাংবাদিক। হিসেব নিকেশের কলরবে বাতাসে চঞ্চল ঢেউ খেলে যায় ত্বরিৎ।
আরেকটু এগিয়ে হাসপাতালের বহির্গমন পথেই চোখে পড়লোা আরো কয়েকটা লাশ
আরো কিছু ক্যামেরা,
ফ্ল্যাশলাইটের কদর্য আলো আর গা সয়ে যাওয়া একঘেঁয়ে বর্ণনা
‘আজ দেশ দেখলো মৃত্যুর সর্বোচ্চ রেকর্ড। শনাক্ত…., নতুন আক্রান্ত…, মৃত্যু…., সুস্থ……’
অ্যকশন, কাট এর শব্দ বাতাসে বাতাসে
মৃত্যুর রেকর্ড বাজে ইথারে ইথারে
স্বজন হারানোর কান্না উঠোনে উঠোনে
অ্যাম্বুলেন্সের কর্কশ ধ্বনি রাজপথে জনপথে।
কুকুরের জ্বলে ওঠা চোখে দেখি প্রিয়জন বিচ্ছেদের বেদনার্ত চাহনি
গরুদের নিরাবেগ চোখেও ভাসে স্বজনের রক্তের লাল আভা
ছাগলের নরোম চোখে ছুয়ে যায় আঁধারের কুয়াশা
মানুষের জোড়া জোড়া আর্দ্র চোখে উৎকন্ঠা, প্রার্থনা,
আর থমকে থাকা সময়ের কান্নার বহমান ধারা।
বাতাসে কেবল মাংসের গন্ধ
কেবল রক্তের গন্ধ
কেবল লাশের গন্ধ
বুঝিনা কোনটা পোড়া, কোনটা মশার কামড়ে নেতিয়ে পড়া
কোনটা রেকর্ড ছাড়ানো?
আর কোনটাই বা সমর্পিত জীবনের বাইপ্রোডাক্ট!
দীর্ঘায়িত এক কালোরাত্রির পীড়ণে পীড়ণে
নগ্ন হয়ে যাওয়া এক শহরে আমি ও একই মুখাবয়বের প্রাণিগুলো
সঙ্গে প্রস্তর যুগ থেকে আমাদের জীবনের সাথে লেপ্টে থাকা গরু-ছাগল-কুকুর-বিড়াল
এবং অন্যান্য সব পশু।
সকলেরই প্রাণ আছে
সকলেরই কি মন থাকে?
বাতাস তাদের অনুমতি দেয় না
বিষবাস্প ছড়ানোর,
কিন্তু তাদের রক্তের সাথে রাত্রি আরো ঘন হয়ে মিশে যায়
আঁধার স্নান করে রক্তের নদীতে
নাকিরক্তকণিকাগুলো
ডুব দেয় আঁধারের নদীতে
বলা মুশকিল
দূরে কোথাও খিলখিল হাসে ক্ষণজন্মা জোনাকির ঝাঁক।
ভারী, কেবল ভারী হয় অন্তর
ভারী, কেবল ভারী হয়
কাঁধে ভর করা কফিনের জোয়াল।
মেঘগুলো ভারী হবে কখন?