হাওর বার্তা ডেস্কঃ সুন্দরবনে তাদের জীবন, সুন্দরবনই তাদের জীবীকা। বনের গহীন থেকে মধু-গোলপাতা-গড়ান কাঠ আর নদ-নদীর মাছ বিক্রি করে তাদের সংসার চলে। পানিতে কুমির আর ডাঙ্গায় বাঘের ঝুঁকি নিয়ে তারা বনের ভেতরে যান, চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে যান পরিবার পরিজনদের। অনেকে ফিরে আসেন, কেউ কেউ ফেরেন না। সুন্দরবন লাগোয়া গ্রামগুলোর বনজীবীদের কষ্ট যেন ফুরায় না। পরিবারের সবাই মিলে কঠিন সংগ্রাম করে তিনবেলা ভাত জোটাতে পারেন না তারা। এ অবস্থায় এবার আসছে ঈদ। ঈদের আনন্দ তাদের মাঝে নেই। সুন্দরবন সংলগ্ন মঠাবাড়ি, কাশিয়াবাদ, কয়রা চার নম্বর, পাঁচ নম্বর, ছয় নম্বর, পাথরখালী, মাটিকাটা, গাববুনিয়া, শাকবাড়িয়া, হরিহরনগর, গাতিঘেরি, বীনাপানি, জোড়শিং, আংটিহারা, গোলখালী প্রভৃতি গ্রামের মানুষদের সাথে কথা বলে জানা গেছে তাদের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা।
খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার বড় একটি অংশ জুড়ে রয়েছে সুন্দরবন। তাই অঞ্চলগুলোর মানুষের জীবন জীবীকা প্রতিনিয়ত আবর্তিত হয় সুন্দরবনকে ঘিরে। একসময় সুন্দরবন ছিল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা। যত দিন যাচ্ছে বন উজার হচ্ছে। কমে আসছে বনজ সম্পদ। সিডর, আইলা, আম্পান, ইয়াসের মত বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ সুন্দরবন এবং এর সাথে নির্ভরশীল মানুষগুলোর জীবন তছনছ করে দিয়েছে। দরিদ্র থেকে চরম দরিদ্র করে দিয়েছে বন নির্ভর মানুষগুলোকে।
খুলনা থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে কয়রা উপজেলা। এক সময় এ এলাকায় জনবসতি ছিল না বললেই চলে। প্রায় একশ’ বছর ধরে এ উপজেলায় বাস করছে আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায়। সময়ের সাথে সাথে তাদের নিজস্ব ভাষা ‘মুন্ডারি’ হারিয়ে গেছে। শত বছর ধরে তারা সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে প্রায় ৩শ’ পরিবার নিয়ে তাদের এ সম্প্রদায়ের সরদার দুর্গাপদ মুন্ডা জানালেন, ঈদ পূজা পার্বন এখন আমাদের মধ্য থেকে এক প্রকার উঠে গেছে। তাই এসব উৎসব আমাদের কাছে অন্য দিনগুলোর মতোই। মাছ, কাঁকড়া শিকার তাদের প্রধান জীবীকা। বাধ্য হয়ে এখন অনেকেই অন্যের জমি চাষাবাদ করে থাকেন।
পাথরখালী, মাটিকাটা, গাববুনিয়া, শাকবাড়িয়া, হরিহরনগর, গাতিঘেরি, বীনাপানি, জোড়শিং গ্রামের বনজীবীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে তাদের দুর্দশার কথা। মাটিকাটা গ্রামের মৌয়াল আরাফ শেখ, হাসিব মোল্লা, জয়নাল ও সিদ্দিকুর জানালেন, গত ১ এপ্রিল থেকে দু’মাস মধু সংগ্রহ মৌসুমে তারা বনে গিয়েছিলেন। কিন্তু এবার তারা খুব বেশি মধু সংগ্রহ করতে পারেননি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মধু মৌসুমে আনা মধু বিক্রি করে তাদের সারা বছর সংসার চালাতে হয়। ঈদ কেমন হবে এবার এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, গত ৮/১০ বছর তারা ঈদ বা কোনো উৎসব উদযাপন করতে পারেন না অভাবের কারণে। পরিবারের সদস্যদের নতুন কাপড় কিনে দেয়ার মত সামর্থ্য তাদের নেই। আংটিহারা, গোলখালী গ্রামের বাওয়ালী হাশমত ও আজিজুল জানিয়েছেন, সুন্দরবনে এখন কাঠ আহরণ বন্ধ রয়েছে। ডিসেম্বর মাস থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত গোলপাতাসহ কাঠ আহরণের অনুমতি দেয় বনবিভাগ। বর্তমানে চোরাই পথে অনেকেই সুন্দরবনের কাঠ চুরি করে নিয়ে যায়। তাই বৈধভাবে সুন্দরবনে ঢোকা বাওয়ালীরা সমস্যায় পড়ে যান। কাঠ বিক্রি করে যে লাভ হয় তাই দিয়ে সংসার চালানো দুষ্কর হয়ে পড়ে।
তবে এবার ঈদে দুই কেজি গরুর গোশত এবং আতপ চাল, ও ভাজা সেমাই কিনে পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করবেন বাওয়ালী আব্দুস সামাদ। ৫৬ বছর বয়সি সামাদ জানান, গত বছর ঈদে তার দুই নাতিকে নতুন কাপড় দিতে পারেননি। এবার আশা করছেন ৭ ও ৫ বছর বয়সি দুই নাতিকে তিনি নতুন কাপড় দেবেন। একই রকম কথা জানালেন দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের চরামুখা গ্রামের সিরাজুল মিয়া। তিনি পেশায় মৎস্যজীবী। বনের নদ-নদী ও খাল থেকে মাছ ধরেন। দুই মাস ধরে সুন্দরবনে মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে। এ সময় টুকু তিনি পরের জমিতে কাজ করে কিছু টাকা জমিয়েছেন। তাই দিয়ে ১১ বছরের ছেলে মিরাজুলকে জামা কাপড় কিনে দেবেন। এছাড়া ঈদে যারা কুরবানি করবেন, তাদের কাছ থেকে কিছু গোশত পেলে তাই ঈদের দিন বাড়িতে রান্না করা হবে।
সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন কবীর জানিয়েছেন, বনজীবীরা খুবই দূরবস্থায় রয়েছে। সরকারিভাবে তাদের বিভিন্ন সময় সাহায্য সহযোগিতা করা হয়। তবে তা তাদের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। তাদের জীবন মানউন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ প্রয়োজন।
খুলনা বনবিভাগ সূত্র জানিয়েছে, সুন্দরবনের জেলে বাওয়ালী ও মৌয়ালদের সরকারি সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। তালিকাভূক্ত মৎস্যজীবীদের বনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার সময় চাল ও নগদ অর্থ দেয়া হয়। তাদের জীবন মান উন্নয়নে বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ খুলনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, বনজীবীদের জীবনমান উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন পদক্ষে নিয়েছে। যেহেতু বনজ সম্পদ আমাদের সীমাবদ্ধ, তাই তাদের বননির্ভরশীলতা কমিয়ে অন্য পেশায় নেয়ার চিন্তা ভাবনা চলছে। বন সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাঘবিধবাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে। একনেকে এ সংক্রান্ত ১৫৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প এবছর ৪ জানুয়ারি অনুমোদন পেয়েছে। সুন্দরবনে যখন সম্পদ আহরণে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় (এপ্রিল-আগস্ট) তখন বনজীবীদের জন্য বিকল্প রেশনিংয়ের প্রস্তাব মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে ঝিনাইগাতীর গারো পাহাড়ের মানুষ অন্য রকম ঈদ উৎসব পালন করে। অতি দরিদ্র লোকজনের বাস গারো পাহাড়ে। তাই আনন্দের ঈদ উৎসব তাদের বলতে গেলে নিরান্দেরই হয় প্রতি বছর। এবারতো করোনা ও লকডাউনে বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে তারা। এরপর এসেছে ঈদ উৎসব। কিভাবে কি করবে ভেবেই পাচ্ছে না পথ। তারা দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ। তাই ঈদ উৎসব তাদের কাছে যেন মুর্ত্তিমান আতংক আর হতাশার নাম। যারা ছেলে মেয়েদের কিনে দিতে পারেনা নতুন জামা কাপড়, নিজের জন্যও কিনতে পারে না নতুন জামা। পুরাতন জামা কেউবা ছেড়া পাঞ্জাবি পড়েই ঈদের নামাজ আদায় করেন। এভাবেই ঈদ উৎসব পালনে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তারা। এমনই ঈদ উৎসবের বর্নণা দিলেন গারো পাহাড়ের গান্দিগাঁও গ্রামের আব্দুল মান্নান, আব্দুল জব্বার, ইয়ানুছ আলী ও সাবেক ইউপি সদস্য তোফাজ্জল হোসেন, রাঙটিয়া গারো পাহাড়ের আহাম্মদ আলী ও আব্দুর রহমান মাস্টার, জুকাকুড়া গ্রামের আব্দুল মান্নাফ নওকুচি গ্রামের আমেজ উদ্দিন প্রমুখ।
তারা আরো জানান, গারো পাহাড়ে শতকরা ৭০/৮০ ভাগ মানুষ হতদরিদ্র। পুরাতন বা ছেড়া কাপড় পড়েই ঈদের দিন কাটান। এমনিতেই তাদের কষ্টের সীমা নেই। তারপর আবার করোনা মহামারিতে কাজ করতে না পেরে তারা আছেন অনাহারে।
এ অবস্থায় কীভাবে ঈদ উৎসব পালন করবে তা ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছেন না তারা। তাই এই করোনাকালীন সময়ে পাহাড়ি মানুষের ঈদ আনন্দ যেন এক মহাবিপদের নাম। গারো পাহাড়ের মানুষ সমতল ভূমির লোকজনের মতই ঈদের নামাজ আদায় করেন। তফাৎ শুধু চরম দারিদ্রতা। শতকরা ২০/৩০ ভাগ মানুষ স্বচ্ছল। তারা স্বাচ্ছন্দে ঈদ উৎসব পালন করলেও শতকরা ৭০/৮০ ভাগ মানুষই অত্যন্ত অসহায়ভাবে ঈদ উৎসব পালন করে। কুরবানি দেন বিত্তশালী লোক।
চরম দরিদ্র এসব মানুষ পেটের ভাতই যোগার করতে পারে না। কুরবানি সে তো স্বপ্ন। তাই ঈদের খুশি তাদের অন্যরকম অসহায়ত্বের নাম। তবে বিত্তশালীরা কুরবানি দেয়ার পর ৩ ভাগের ১ ভাগ গোশত বিলিয়ে দেন দরিদ্র লোকজনকে। ২/৪ টুকরা গোশত পেয়েই খুশি থাকতে হয় গারো পাহাড়ের দরিদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠিকে। কুরবানি দেয়া হয় এলাকার ঈদগাহ মাঠে বা কোন মসজিদের সামনে।
অপর দিকে ছেলে মেয়েদের চাপে ধারদেনা করে শেষ সময়ে যারা কিছু কেনাকাটা করতে আসেন তাদেরকে গ্রাম্য ভাষায় বলা হয় ‘লেট-কামার’। গারো পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষের দুঃখের শেষ নেই। বর্ণনা করার মত ভাষা নেই, নেই কোন সান্তনা। পাহাড় জুড়ে শুধুই হাহাকার আর হাহাকার। এই করোনাকালীন লকডাউন চলাকালে কেউ বলতে পারবে না যে আমরা পেটপুড়ে ভাত খেয়েছি। হয় অনাহারে না হয় সামান্য করে চিড়া-মুড়ি খেয়ে বেঁচে আছি। কেউ বা খেয়ে না খেয়ে দিন পার করেছে। এমনই অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছে পাহাড়ি লোকজন।
গারো পাহাড়ে বসবাসকারী অসহায় দরিদ্র মানুষজন আরো জানান, অনেক যন্ত্রনা ও কষ্টের মধ্যে আছি আমরা। আমাদের আবার ঈদ আনন্দ কিসের? ঈদ যেন আমাদের যন্ত্রনার নাম। করোনাকালীন সময়ে খুব কষ্টে আছি আমরা। এটাতো কেউ দেখছে না। চেয়ারম্যান-মেম্বররাতো এসব দেখেও না দেখার ভান করে। যারা সামনের নির্বাচনে তাদের ভোট দেবে তাদেরই বেছে বেছে সরকারি সাহায্য সহযোগিতা দেয়। সরকারতো গরিব মানুষকে কম দিচ্ছে না। পাকা ঘর পর্যন্ত দিচ্ছে। চেয়ারম্যান মেম্বরদের কারণে আমরা সকল সাহায্য সহযোগীতা হতে বাঞ্চিত হচ্ছি।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারুক আল মাসুদ বলেন, হতদরিদ্র মানুষদের মাঝে বিতরণের জন্য চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে ভিজিএফসহ নানাভাবে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা করা হচ্ছে। তার পরও যদি অসহায় অবস্থায় কেউ থেকে থাকে তাকে সহযোগিতা করা হবে। আপনার জানা থাকলে ৪/৫ জনের নাম দিতে পারেন। আমি নিজে তাদের সাহায্য প্রদান করবো।