হাওর বার্তা ডেস্কঃ ২০১৬ সালের ঈদুল ফিতরের দিন (৭ জুলাই) কিশোরগঞ্জের চরশোলাকিয়া সবুজবাগ মোড় পুলিশ চেকপোস্টে বাধা পেয়ে গ্রেনেড, বোমা, চাপাতি ও পিস্তল নিয়ে অতর্কিত হামলা চালায় জঙ্গিরা। এ সময় জীবন তুচ্ছ করে প্রথম প্রতিরোধ গড়েন চেকপোস্টের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা। জঙ্গিদের হামলায় ১৪ পুলিশ সদস্য আহত হন। তাদের তাজা রক্তে নির্বিঘ্ন হয় শোলাকিয়ায় উপমহাদেশের বৃহত্তম ঈদজামাত।
আহতদের মধ্যে কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম তপুর মৃত্যু হয়। অন্যদের মধ্যে কনস্টেবল আনছারুল হক (২৮), রবিকুল ইসলাম, প্রশান্ত কুমার সরকার, তুষার আহম্মেদ, জুয়েল মিয়া, মো. মশিউর রহমান ও এএসআই মো. নয়ন মিয়াকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে কনস্টেবল আনসারুল হককে ময়মনসিংহ সিএমএইচে নেয়ার পর দুপুরে সেখানে তার মৃত্যু হয়।
এদিকে শোলাকিয়ার সবুজবাগ মোড় পুলিশ চেকপোস্ট আক্রান্ত হওয়ার পর পরই হামলাকারী জঙ্গিদের ধরতে অভিযানে নামে পুলিশ। বিশেষ করে শোলাকিয়া ঈদগাহে জঙ্গিদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কোন হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ছাড়াই বন্দুকযুদ্ধে অসীম সাহসিকতা দেখিয়ে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ মুর্শেদ জামান পরিণত হন জাতীয় বীরে।
নিহত দুই পুলিশ কনস্টেবলের মধ্যে কনস্টেবল (নং-১৪৭৬) জহিরুল ইসলাম তপু ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভাটিপাড়া বালাশর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদের ছেলে এবং কনস্টেবল (নং-১৪৩০) আনসারুল হক নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের সিদ্দিকুর রহমানের ছেলে।
অন্যদিকে পুলিশের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা বন্দুকযুদ্ধ চলাকালে সবুজবাগ এলাকার ঝরণা রাণী ভৌমিক (৪৫) নামে এক গৃহবধূ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিজ বাসাতেই মৃত্যুবরণ করেন। নিহত গৃহবধূ ঝরণা রাণী ভৌমিক এলাকার গৌরাঙ্গ চন্দ্র ভৌমিকের স্ত্রী।
মামলার অভিযোগপত্রে শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার ঘটনায় ২৪ জনের সম্পৃক্ততা উল্লেখ করে তাদের মধ্যে অভিযুক্ত ১৯ জন বিভিন্ন স্থানে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় অব্যাহতি দেয়া হয় এবং পাঁচজনকে অভিযুক্ত করা হয়।
জঙ্গি হামলার সময় ওই পুলিশ চেকপোস্টে দায়িত্বরত পাকুন্দিয়া থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সামসুদ্দীন বাদী হয়ে জঙ্গি হামলার চারদিনের মাথায় ১০ জুলাই সদর থানায় মামলা (নং- ১৪) রুজু করেছিলেন। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ মুর্শেদ জামান। পরবর্তিতে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আরিফুর রহমান।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, শোলাকিয়া হামলায় খরচের যাবতীয় টাকা হুন্ডির মাধ্যমে সিরিয়া, সৌদি আরব ও পাকিস্তান থেকে আসে। শিবগঞ্জে বন্দুকযুদ্ধে নিহত জঙ্গি মো. বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট (৩২) এই টাকা বাংলাদেশে আনে। বাশারুজ্জামান চকলেট সেই টাকা নারায়ণগঞ্জে বন্দুকযুদ্ধে নিহত জঙ্গি নেতা তামিম আহমেদ চৌধুরীর কাছে পৌঁছে দেয়। এছাড়া ভারত থেকে আসে অস্ত্র ও গোলা বারুদ।
মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানের মাধ্যমে কিশোরগঞ্জে তামিম চৌধুরীর কাছে সেই অস্ত্র ও গোলা বারুদ পৌঁছে দেয় মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় বন্দুকযুদ্ধে নিহত জঙ্গি নূরুল ইসলাম মারজান। শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদকে হত্যার টার্গেট করে এই জঙ্গি হামলা চালানো হয়।
অভিযোগপত্রে আরো উল্লেখ করা হয়, ২০১৫ সালের জুলাই মাসে গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার নিকট টাঙ্গাইলে অভিযানে নিহত মাহফুজুর রহমান বিজয় ওরফে সুজন এর ভাড়াটিয়া বাসায় শোলাকিয়া জঙ্গি হামলার বিষয়ে একটি বৈঠক হয়। পরবর্তিতে ২০১৬ সালের ২৪ জুন রাজধানীর বসুন্ধরায় এপোলো হাসপাতালের পেছনে তানভীর কাদেরীর বাসায় শোলাকিয়া হামলার পরিকল্পনা হয়।
এই পরিকল্পনায় রাজীব গান্ধী, তামিম চৌধুরী, সারোয়ার জাহান, নূরুল ইসলাম মারজান, বাশারুজ্জামান চকলেট, তানভীর কাদেরী, খাইরুল ইসলাম ওরফে বাধন ওরফে পায়েল, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিমল ওরফে নাহিদ, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিব্রাস ইসলাম, মীর সামেহ মোবাশ্বের ও মেজর জাহিদ উপস্থিত ছিল।
পরবর্তিতে হামলার তিন দিন আগে ৪ জুলাই মিরপুর শেওড়া পাড়ার একটি বাসায় নূরুল ইসলাম মারজান, সারোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমান ও রাজীব গান্ধী এই তিন জঙ্গি শোলাকিয়া হামলার বিষয়ে আরো একটি পরিকল্পনা মিটিং করে।
ওই মিটিংয়েই শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদকে হত্যা করা হবে মর্মে সিদ্ধান্ত হয়। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নব্য জেএমবি’র মাস্টার মাইন্ড তামিম আহমেদ চৌধুরী, মেজর জাহিদ, ফরিদুল ইসলাম আকাশ, আবির রহমান, শরীফুল ইসলাম ওরফে শফিউল ইসলাম ও জাহিদুল হক তানিম কিশোরগঞ্জ শহরের নীলগঞ্জ রোড এলাকার ভাড়া বাসায় অবস্থান নেয়।
পরবর্তিতে ৭ জুলাই ঈদের দিন সকালে শোলাকিয়ার ইমামকে হত্যা করার জন্য জঙ্গি আবির রহমান ও শরীফুল ইসলাম ওরফে শফিউল ইসলামকে অপারেশনে পাঠিয়ে তামিম আহমেদ চৌধুরী, মেজর জাহিদ ও ফরিদুল ইসলাম আকাশ কিশোরগঞ্জ ত্যাগ করে।
কিন্তু তল্লাসি চৌকিতে পুলিশের তৎপরতা নস্যাত করে দেয় তাদের সব পরিকল্পনা। তল্লাসির মুখে পড়ে চাপাতি ও বোমা নিয়ে পুলিশের ওপর হামলে পড়ে জঙ্গি আবির ও শরীফুল। এ সময় জীবন তুচ্ছ করে প্রথম প্রতিরোধ গড়েন চেকপোস্টের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা।