বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করব

কারফিউ দিয়েও পূর্ব পাকিস্তানের বিক্ষুব্ধ মানুষকে রুখতে পারছে না পাকিস্তান সরকার। ক্ষোভ ও প্রতিবাদের আগুনে জ্বলছে মুক্তিকামী মানুষ । মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে রাস্তায় নামছে মিছিল। চলছে গুলি। মানুষ মরছে পাখির মতো। সে খবর চাপা দিতে সংবাদপত্রে জারি হয় সামরিক বিধিনিষেধ। অথচ অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে বাঙালির তখন দুর্বার গতি।

ঢাকা শহরে জারি করা সান্ধ্য আইন অমান্য করতে আজ আরও বেশি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বাঙালি। শহরের বিভিন্ন সড়কে ও মোড়ে গড়ে তোলে শক্তিশালী ব্যারিকেড। মিছিল নিয়ে পথে নামে ছাত্র-জনতা।

২ মার্চ সামরিক বাহিনীর গুলিতে রামপুরায় শহীদ তরুণ ছাত্রনেতা ফারুক ইকবালসহ কয়েক শহীদের মরদেহ আনা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (বর্তমান জহুরুল হক হল)। শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় শহীদদের প্রতি। পরে শোভাযাত্রা সহকারে আজিমপুর কবরস্থানে নিয়ে দাফন করা হয়।

সকাল ১১টায় গণহত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় এক প্রতিবাদ সভা করে। সভাপতিত্ব করেন ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী। সভায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা এনে স্বাধীনতা সংগ্রামে জনতার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন শিক্ষকরা।

এই দিন ঢাকা শহরে গুজব রটে যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার দখল করে নিয়েছে। আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়া সে খবরে লাঠি, রড, দা, বঁটি, কুড়াল হাতে রাজারবাগে সমবেত হন অসংখ্য মানুষ।

রংপুরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে দুপুর আড়াইটা থেকে ২৪ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী।

সিলেটের বিক্ষুব্ধ মানুষকে ঠেকাতে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে ১২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করা হয়।

ঢাকায় কারফিউ কিছুটা শিথিল করে রাত ১০টা থেকে সকাল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত বলবৎ করা হয়।

চট্টগ্রামের বিক্ষুব্ধ মানুষকে দমাতে অবাঙালিদের লেলিয়ে দেওয়া হয় বাঙালির বিরুদ্ধে। হামলা, সংঘর্ষ, অগ্নিকান্ড ও গুলিবর্ষণে উত্তাল হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম। সারাদিন ধরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলে ফিরোজ শাহ কলোনি, ওয়ারলেস কলোনি, আমবাগান, পাহাড়তলী ও আশপাশের এলাকাগুলোয়। একদিনেই প্রায় ৪শ’ হতাহতের ঘটনা ঘটে।

পল্টনে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্রলীগের বিশাল জনসমাবেশ। বক্তব্য দেন বঙ্গবন্ধু। ডাক দেন অহিংস আন্দোলনের। স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন শাজাহান সিরাজ। ইশতেহারে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত রূপে ঘোষণা দেওয়া হয়।

সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবি মেনে নিতে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ পর্যন্ত সময় দিলেন সামরিক জান্তাকে। রাতে ছাত্রলীগের ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দের এক সভা অনুষ্ঠিত হয় জহুরুল হক হলে। সভায় হাসানুল হক ইনু, শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও ড. মোজাম্মেল খানকে দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নুরুল উল্লাহকে বঙ্গবন্ধুর জন্য একটি বেতার প্রেরক যন্ত্র তৈরি করতে। প্রয়োজনে সেটা দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হবে। পরে ড. নুরুল উল্রাহ একটি বেতার ট্রান্সমিটার তৈরি করে ২৫ মার্চের আগেই তা ইনুর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর হাতে হস্তান্তর করেন।

সন্ধ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানের ইসলামাবাদ থেকে এক বেতার ঘোষণায় জেনারেল ইয়াহিয়া ১০ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের পার্লামেন্টারি গ্রুপের ১২ নেতার সঙ্গে এক বৈঠকে বসার প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবে বলা হয়, বৈঠকের পর দুই সপ্তাহের মধ্যেই জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সে প্রস্তাব তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু বলেন, গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান তাহলে আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারা রচনা করুন। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করবো।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বুলেটে আহতদের জীবন রক্ষার জন্য জনগণের প্রতি ব্লাড ব্যাংকে রক্তদানের উদাত্ত আহবান জানান। তিনি জনসাধারণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বাংলার স্বাধিকার বিরোধী বিশেষ মহল নিজস্ব এজেন্টদের দিয়ে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও উচ্ছৃঙ্খল ঘটনা ঘটাচ্ছে। স্বাধিকার আন্দোলন বিপথগামী করার এ অশুভ চক্রান্ত রুখতেই হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর