ঢাকায় পতাকা উত্তোলনের খবরে সাহস বেড়ে যায় বহুগুণ

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের রক্তঝরা দিনের ইতিহাস সমৃদ্ধ অন্যতম জেলা কুষ্টিয়ার সগ্রামী যোদ্ধারা সব সময়ই ছিলেন অগ্রগামী সৈনিকের ভুমিকায়। ১৯৭১ সালের ১মার্চ তৎকালীন ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণায় মুক্তিকামী জনগণ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।

তারা পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে এবং দেশবাসীর পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির সংগ্রামে নেমে আসেন রাজপথে। সেদিনের সেই রক্তঝরা ইতিহাসের পাতা থেকে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন তৎকালীন বৃহত্তর কুষ্টিয়ার ছাত্রলীগ সভাপতি ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আব্দুল জলিল।

একান্ত আলাপচারিতায় তিনি বলেন, ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে বাংলার বাংলার ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যা গরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়। অথচ বাঙালীর অধিকার হরণের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এর ফলে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকায় নির্ধারিত পার্লামেন্টের অধিবেশন ১মার্চে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে বেতারযন্ত্রে প্রচার করে।

তিনি বলেন, এ সংবাদ শোনার পর ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক শামসুল হাদী, কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের ভিপি শেখ দলিল উদ্দিন, জিএস মারফত আলীসহ আব্দুল মোমিন, মধু, মাসুম, লোকমান, হেলাল, গিয়াস মিন্টু, পুটাসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দদের নিয়ে মিটিং করে ঢাকাতে কাজী আরেফ ও আব্দুর রাজ্জাক ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করেন আব্দুল বারী জিনাত আলী।

আব্দুল জলিল বলেন, ঢাকাতেও সবাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো’র ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেন। পাক শাসকের বাঙালী নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে এবং বাঙালী জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তারই সূত্র ধরে সিদ্ধান্ত হয় প্রস্তাবিত বাংলাদেশের পতাকা হবে সবুজের মাঝে লাল সূর্য এর মাঝে পূর্ব পাকিসত্মানের মানচিত্র থাকবে, যদি ২মার্চ ঢাকাতে পতাকা তোলা হয় তবে আমি ৩মার্চ সম্ভব হলে প্রস্তাবিত পতাকা নিয়ে কুষ্টিয়াতে এসে তা উত্তোলন করা।

এই বীরযোদ্ধা বলেন, সিদ্ধান্তানুযায়ী ২মার্চ আওয়ামীলীগ নেতাদের সাথে পরামর্শ করে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের মিটিং করে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৩মার্চ কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ চত্ত্বরে ছাত্র জনতার জমায়েত আহবান করা হয়। ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত স্বাধীন বাংলা পতাকা তৈরী করার জন্য মাসুমের বাসায় গোপনে বৈঠক হয়। সেখানে দলিল উদ্দিন, মধু, মাসুম বদর দর্জিকে ডেকে এনে প্রস্তাবিত পতাকার মোটামুটি একটা ধারণা দেয়া হয়। ২মার্চ চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুরসহ ছাত্র সংগঠনগুলোকে সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয়।

তখনকার পরিস্থিতি বর্ণনা করে তিনি বলেন, ২ মার্চ ডাকসুর সহ-সভাপতি আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বে প্রসত্মাবিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের সংবাদ পেয়ে আমাদের সাহস ও উদ্যোম বেড়ে যায় বহুগুণ। তারই ধারাবাহিকতায় ৩ মার্চ, ১৯৭১ সাল কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ চত্ত্বরে হাজার হাজার মুক্তিকামী জনতা ঢাল, সড়কি, ফালা, বন্দুক ও লাঠিসোটা নিয়ে কলেজ চত্বরে সমবেত হয়। সেই সমাবেশ থেকেই শামসুল হাদী পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দেয়।

আব্দুল জলিল বলেন, এসময় আমি প্রস্তাবিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি। সমাবেশ শেষে আব্দুল বারীসহ আমি পতাকা নিয়ে মাঠে এসে প্রকাশ্যে উত্তোলন করি। সামাবেশে উপস্থিত হাজারও ছাত্র-জনতা জয়বাংলা শ্লোগান ধ্বনিতে মুখরিত করে তোলে। জাগো জাগো বাঙালী জাগো ইয়াহিয়া-ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশকে স্বাধীন করো; জাতীয় নানা ধরণের শ্লোগানসহ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে বিশাল মিছিল বের করা হয়। ৩মার্চ পতাকা উত্তোলনের পর গোটা জেলাজুড়ে ব্যাপক জনগণের সম্পৃক্ততায় একদফা অর্থাৎ স্বাধীনতা আন্দোলনের গতিকে বেগবান করতে প্রতিটা থানায় ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণসহ জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।

শুরু হয় পাক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। দীর্ঘ ৯মাস যুদ্ধ করে ৩০লাখ শহীদের আত্মদান ও দুইলক্ষ মা বোনেদের সম্ভ্রমহানীর বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা ছিলো মুক্তিকামী বাঙালী জাতির পরাধীনতার শৃংখল মুক্তির মধ্যদিয়ে একটি শোষণহীন সুখি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার দৃপ্ত প্রত্যয়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর