কোরবানির বিকল্পে অর্থদান চিন্তা ও একটি মূল্যায়ন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বছর ঘুরে আবারও আমাদের মাঝে উপস্থিত হতে যাচ্ছে পবিত্র ঈদুল আজহা, পবিত্র জিলহজ মাস। এই জিলহজ মাসে রয়েছে নেক আমলের অভাবনীয় অনেক সুযোগ। এর মধ্যে অন্যতম কোরবানি।

শিয়ারে ইসলাম বা ইসলামের মৌলিক নিদর্শনাবলির অন্তর্ভুক্ত এই কোরবানি। জিলহজ মাসের ১০ তারিখ তথা ঈদুল আজহার দিন ইয়াউমুন নাহর বা কোরবানির দিবস। এই তারিখে মুসলমানরা কোরবানি করেন এবং ঈদুল আজহা উদযাপন করেন।

এ সময়টি মুসলমানদের কাছে খুবই আবেগ ও উদ্দীপনার।আল্লাহর বান্দারা আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকবেন এর চেয়ে আনন্দের বিষয়, এর চেয়ে সহজ সুন্দর বিষয় আর কি হতে পারে।

কোরবানির পরিচয় হলো— এটি আল্লাহর এবাদত। যার প্রাণ বা মূলকথা আল্লাহর জিকির তথা আল্লাহর স্মরণ। মহান নবী হজরত ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক আপন প্রাণপ্রিয় কিশোরপুত্র হজরত ইসমাইলকে (আ.) কোরবানি করতে নিয়ে যাওয়ার এক অপূর্ব স্মৃতিচারণ। এটা যেন সে কথারই প্রতিচ্ছবি যে, বান্দার কাছে সবচেয়ে বড় হলো তার প্রিয়তম রব ও মনিব মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম।

আল্লাহতায়ালার হুকুমের সামনে কোনো কিছুই তার কাছে কোনো অর্থবহ নয়। কোরবানির মধ্যে এই শিক্ষা রয়েছে যে, আল্লাহই একমাত্র উপাস্য আর কোনো রব ও পরওয়ারদিগার নেই।  তার কোনো শরিক নেই। তার আনুগত্যের বিপরীতে আর কারও আনুগত্য নেই।

আমাদের নিজস্ব রুচি-অভিরুচিকে আল্লাহর অনুগত বানিয়ে আমাদের যুক্তিবুদ্ধি বিচার-বিবেচনাকে আল্লাহর হুকুমের সামনে বিসর্জন দেওয়া—এটিই তো কোরবানির শিক্ষা। প্রচলিত-অপ্রচলিত  নানা মত-মতবাদ থেকে বিমুখ হয়ে আল্লাহর প্রতি সমর্পিত হওয়া এবং এক আল্লাহর আনুগত্যকে নিজের জীবনের সেরা ধার্য করা এই মহান শিক্ষার স্মরণ তো কোরবানিই আমাদের দেয়। ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণ আল্লাহর স্মরণ ও আনুগত্যের মাঝেই রয়েছে, আল্লাহ বিস্মৃতির মধ্যে নেই।

এই সত্য গভীরভাবে উপলব্ধির প্রয়োজন। এই সত্যের উপলব্ধি অর্জিত হলে ইসলামের অনুষঙ্গগুলোর জাগতিক মূল্য অনুধাবন করা সহজ হবে।

ছোট্ট এই ভূমিকা অবতারণার কারণ হলো— দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুসলিম সমাজের কিছু মানুষের মধ্যেও রয়েছে কোরবানির মতো ইবাদত নিয়ে বিভ্রান্তি। তারা একে অর্থ অপচয় মনে করে।

বিশেষত বর্তমান প্রেক্ষাপটে। অর্থাৎ চলমান করোনা পরিস্থিতি এবং এই পরিস্থিতিকালীন বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট, অভাব ও দারিদ্র্যের সময়ে। কারও কাছে এই সময়ে মনে হতে পারে যে, প্রতিবছরই তো কোরবানি করা হয়। এই বছর কোরবানি না করে এই টাকাটা দান করাই তো বেশি যুক্তিযুক্ত।

আপাতদৃষ্টিতে কারও কাছে কথাটা সুন্দর মনে হলেও মূলত কথাটি অসার ও তাৎপর্যহীন। এই বক্তব্যের অসারতার সবচেয়ে বড় কারণ হলো— এখানে কোরবানিকে গণমানুষের কল্যাণে দাঁড়ানোর প্রতিবন্ধক মনে করা হচ্ছে।

অথচ যদি গভীরভাবে লক্ষ্য করা হয়, তা হলে দেখা যাবে— আল্লাহর হুকুম পালন করার মধ্য দিয়েই একজন মুসলিমের পক্ষে সমাজ ও মানবকল্যাণে অংশগ্রহণ করার সুযোগ বেশি রয়েছে।

মূলত কোরবানির মাধ্যমে একজন মুসলিম আল্লাহর আনুগত্যের যে শিক্ষা অর্জন করে, সেই শিক্ষা বাস্তবজীবনে তাকে মানুষের কল্যাণে দাঁড়ানোর সুযোগ আরও বেশি পরিমাণে সৃষ্টি করে দেয়।

সবচেয়ে বড় কথা হলো— অর্থ তো আল্লাহরই দান। আল্লাহ প্রদত্ত অর্থ যদি আল্লাহর হুকুম মোতাবেক ব্যয় হয়, সেটিই তো অর্থের যথার্থ ব্যবহার। অন্যথা হলেই তো বরং অর্থের অপচয়। অর্থ সম্পর্কে এটাই তো হওয়া উচিত একজন মুসলিমের দৃষ্টিভঙ্গি। অর্থবিত্ত একজন মুসলিমের কাছে এত মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ  কীভাবে হতে পারে যে, আল্লাহর এবাদতে ব্যয় করাও তার কাছে অর্থ অপচয় মনে হতে থাকে?!

মুসলিম কি আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে দিয়ে অর্থ সংরক্ষণকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে? তাই কোরবানির বিকল্প হিসেবে নিছক কিছু অর্থ প্রদানের সুযোগ না খুঁজে কোরবানির শিক্ষাকে ধারণ করে সামগ্রিকভাবে সমাজকল্যাণে এগিয়ে আসা উচিত।

একজন মুসলিমের জীবনে ইসলামি অর্থনীতিবোধ তৈরি হলেই কেবল  বাস্তবিকভাবে তার মাধ্যমে সমাজকল্যাণ অধিকতর সম্ভব হবে।

কীভাবে, কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে উদাহরণ দিচ্ছি।

১. ইসলামের জাকাত বিধান। ইসলামের ইবাদতব্যবস্থার সৌন্দর্য যে, একদিকে যেমন তাতে মানুষের মাঝে মানবিকতার বিকাশ হয়. অপরদিকে ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণ হয়। কেবল জাকাত প্রদানের মাধ্যমেই দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব। অর্ধকোটি টাকা বছরে জাকাত ফরজ এমন মানুষের সংখ্যা বর্তমান বাংলাদেশে নেহাত কম নয়।

ভাবা যায়, বছরে অর্ধকোটি টাকা একজন ব্যক্তির আবশ্যকীয় দান! এ ছাড়া বিভিন্ন পরিমাণে অপরিহার্যভাবে একজন প্রকৃত মুসলিম সেই দানটি করবে।

২. ইসলামের সদকার বিধান। আবশ্যকীয় জাকাতের পাশাপাশি  মানব ও সমাজকল্যাণের এমন কোনো বাস্তবসম্মত খাত নেই, যেখানে ব্যয় করার ভারসাম্যপূর্ণ নির্দেশনা ইসলাম দেয়নি। একজন প্র্যাকটিসিং মুসলিম অবশ্যই সে ব্যাপারে সচেতন হবে।

৩. অন্যায়-অনাচারের ক্ষেত্রে অর্থব্যয়ের ইসলামে নিষেধাজ্ঞা। এটি ইসলামি অর্থব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিস্তৃত অধ্যায়। মদ, জুয়া, নাচ-গান, সীমাতিরিক্ত সৌখিনতা ও সজ্জা, অপ্রয়োজনীয় পর্ব উৎসবে ব্যয় করা, অপব্যয়-অপচয় ও সম্পদহানি ইসলামে নিষিদ্ধ।

ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয়ভাবে এই নিষিদ্ধ সম্পদ ব্যয়ের উদাহরণ তো দুঃখজনকভাবে বর্ণনাতীত। অথচ সম্পদ ব্যয়ের এই নিষিদ্ধ ক্ষেত্রগুলো বন্ধ হলে অর্থাভাবে মানবকল্যাণের যে ভালো কাজগুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ে ও সামষ্টিক পর্যায়ে অসম্পন্ন থাকছে, তা সম্পন্ন করা সহজ হতো।

৪. এ ছাড়া ইবাদতের মূল হলো ইখলাস  বা একনিষ্ঠতা। তাই একাধিক পশু এবং বড় পশু জবেহ করার মধ্যেও যেমন একনিষ্ঠতার চর্চা করা উচিত। লোক দেখানোর জন্য না করা, সব কিছুকে আল্লাহর জন্যই করার উপলব্ধি লালন করা উচিত। তেমন ছোট পশু বা শরিকানা কোরবানির মাঝেও এটি চর্চা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেন লোকে কী বলবে এজন্য বড় পশু ক্রয় করার মনোভাব তৈরি না হয়।

এই একনিষ্ঠতা ও লিল্লাহিয়াতের সঙ্গে কেউ যদি ওয়াজিব কোরবানি আদায় করে এবং সেই ক্ষেত্রে মধ্যম ধরনের পশু বা শরিকানা কোরবানির মধ্যেই ক্ষান্ত থাকে। এবং নফল কোরবানি ও একাধিক কোরবানির পরিবর্তে অতিরিক্ত টাকা বর্তমান সংকটকালীন পরিস্থিতিতে মানবকল্যাণে দান করে। তবে অবশ্যই সেটি প্রশংসার যোগ্য ও নন্দিত। এবং আশা করা যায় আল্লাহ তাআলার কাছেও এটি পছন্দনীয় ও গ্রহণযোগ্য আমল হিসেবে পরিগণিত হবে । আল্লাহ তাআলা সর্বজ্ঞ।

মোটকথা, আল্লাহতায়ালার এই মহান হুকুম কোরবানির পরিত্যাগ করার মধ্য দিয়ে নয়, বরং মহান আল্লাহর হুকুম পালন করার মাধ্যমেই ইহ-পরকালের সব সংকট থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি।

তাই কোরবানির প্রতি নিরুৎসাহিত করা নয়, বরং এই মহান ইবাদতগুলোর প্রতি আরও উৎসাহিত করে এই ইবাদতের শিক্ষাজীবনে ধারণ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা উচিত। এতেই মানব ও সমাজের প্রকৃত কল্যাণ অর্জিত হবে ইনশাআল্লাহ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর