ঢাকা ০৭:২৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাধারণ বিসিএস এবং স্পেশাল বিসিএসঃ ক্ষতিটা কার ?

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:২৯:৪২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন ২০২১
  • ২৮৩ বার

মনির হোসেন ঃ বলতে গেলে ভারতীয় উপমহাদেশে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) এর হাত ধরেই আজকের বাংলাদেশের বিসিএস। আইসিএস প্রতিষ্ঠার পূর্বে ১৭৮৬ সালে কর্নওয়ালিস কোডের অধীনে পুনর্গঠিত সিভিল সার্ভিসকে বলা হতো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কভেন্যান্টেড সিভিল সার্ভিস। ১৮৫৩ সালে চার্টার অ্যাক্ট হওয়ার পর সিভিল সার্ভিসে পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে রিক্রুটমেন্টের ব্যবস্থাটি সম্পূর্ণ বিলোপ করা হয় এবং প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে লোক নিয়োগের ব্যবস্থা চালু হয়। তাত্ত্বিক ভাবে তখন থেকেই ভারতীয়দের জন্য সিভিল সার্ভিসের দ্বার উন্মুক্ত হয়। যদিও পারিপার্শ্বিক সুযোগ-সুবিধা, ধর্মীয় রীতিনীতি এবং আর্থিক ও ভাষাগত যোগ্যতার অভাবে প্রায় ১০ বছর দ্বার উন্মুক্ত থাকা সত্বেও ভারতীয় নাগরিক সিভিল সার্ভিসে উত্তীর্ণ হতে পারেনি।

তারপর ঠাকুর পরিবারের হাত ধরে বাঙালীদের সিভিল সার্ভিসে প্রবেশ। সেটা ১৮৬৩ সালে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এঁর মাধ্যমে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ভারতের সিভিল সার্ভিসের নাম পূর্ববর্তী ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসই (আইসিএস) বহাল থাকে। অন্যদিকে পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিসের নামকরণ করা হয় সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি)। যেহেতু পাকিস্তান দু’টি ভাগে বিভক্ত ছিল সেহেতু পাকিস্তানের সিলিভ সার্ভিসের নামও ছিল দু’রকম। পাকিস্থানের জন্য সেন্ট্রাল সার্ভিস আর প্রদেশগুলোর জন্য আলাদা প্রাদেশিক সার্ভিস। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত প্রদেশটির জন্য ছিল ইস্ট পাকিস্থান সিভিল সার্ভিস (ইপিসিএস)। যার বর্তমান নাম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)। ১৯৭২ সালের ৮ এপ্রিল প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার (পিও)-৩৪ আদেশবলে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর হাতে বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি নির্বাচনের উদ্দেশ্যে বিসিএস এর যাত্রা শুরু হয়।

প্রায় প্রতি বছর বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে থাকে। এ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পূর্বে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় সারাদেশের সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বিদ্যমান জনবল কাঠামোর শূন্যপদের তালিকা সংগ্রহ করে থাকে। প্রাপ্ত শূন্যপদ পূরণের উদ্দেশ্যেই এ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। যেমন-২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর ৪২ তম বিশেষ বিসিএস এবং ৪৩ তম সাধারণ বিসিএস এর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। ইতোপূর্বে কখনো দু’টি বিসিএস এর বিজ্ঞপ্তি এক সাথে বা কাছাকাছি সময়ে প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। প্রফেশনাল/টেকনিক্যাল ক্যাডারের পদসমূহের আওতায় ১০ থেকে ১৫ টি বিষয়ে জনবল নিয়োগ করতে দেখা যায়। আবার এই শ্রেণিভুক্ত কোন একটি বা দু’টি বিষয়ে নিয়োগের উদ্দেশ্যে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে দেখা যায়। যা বিপিএসসি’র পরিসাংখ্যিক এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার দুর্বলতা প্রকাশ করে। শুধু তাই নয়, চাকরি প্রার্থীদের সময় ক্ষেপন, রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি এবং এক শ্রেণির চাকরি প্রার্থীদের আবেদন থেকে বঞ্চিত করে থাকে।

লক্ষ্য করুন, ৪৩ তম সাধারণ বিসিএস এ স্বাস্থ্য ক্যাডারের ৭৫ টি পদ অন্তর্ভুক্ত আছে। একই সময়ে ৪২ তম বিসিএস এ স্বাস্থ্য ক্যাডারের ২০০০ পদ দিয়ে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। তাহলে এই ৭৫ জনকে বিশেষ বিসিএস এর আওতায় বিজ্ঞাপিত করতে সমস্যা কোথায় ছিল? শুধু তাই নয়, এই ৭৫ জন এবং ২০০০ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু চাকরি ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা অভিন্ন। বিশেষ বিসিএস পরীক্ষায় প্রার্থীগণ ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারী এবং মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হবে। অন্যদিকে সাধারণ বিসিএসে স্বাস্থ্য ক্যাডারের ৭৫ জন প্রার্থী ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারী, ১১০০ নম্বরের লিখিত এবং ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হবে। কথিত আছে যে, বিশেষ বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারীর প্রার্থীগণ সাধারণ বিসিএসের প্রিলিমিনারী প্রার্থীদের চেয়ে কম নম্বর পেয়ে নির্বাচিত হয়ে থাকে। তাহলে বিপিএসসির এ নিয়োগ প্রক্রিয়া কি ৭৫ জনের প্রতি অবিচার নয়?

৪২ তম এবং ৪৩ তম বিসিএস একত্রে করে ৭৫ কে নিয়ে ২০৭৫ জনের বিজ্ঞাপন হতে পারতো। তার চেয়েও ভাল হতো ৪২ তম বিসিএসর ২০০০ এবং ৪৩ তম বিসিএসের ১৮১৪ জনকে একত্রে একটি বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে ৩৮১৪ জনের জন্য একটি বিসিএস পরীক্ষার আয়োজন করা। এতে করে সকল প্রার্থী সমান প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হতো এবং রাষ্ট্রের আর্থিক সাশ্রয় হতো। প্রশ্ন আসতে পারে, সাধারণ বিসিএস এর সাথে টেকনিক্যাল পদের পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয় না। যদি তাই হয়, তবে ৭৫ জনের পরীক্ষা কীভাবে নেয়া সম্ভব? পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৩৬ তম বিসিএসে সহকারী সার্জন ১৮৭ জন, ৩৭ তম বিসিএসে সহকারী সার্জন ২৭২ জন এবং ৩৮তম বিসিএসে সহকারী সার্জন ২২০ জন এবং সহকারী ডেন্টাল সার্জন ০৫ জন নিয়োগ দেয়। কিন্তু পরের বছর ৩৯ তম বিসিএস (বিশেষ) এ সহকারী সার্জন ৪৫৪২ জন এবং সহকারী ডেন্টাল সার্জন ২৫০ জন নিয়োগ দেয়া হয়। ৩৮তম বিসিএসে এবং সহকারী ডেন্টাল সার্জন মাত্র ৫ জন নিয়োগ না দিয়ে কেন বেশি দেয়া হয়নি। ৩৮ তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয় ২০.০৬.২০১৭ তারিখে এবং ৩৯ তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয় ০৮.০৪.২০১৮ তারিখে। মাত্র ১০ মাসের মধ্যে কীভাবে ৪৭৯২ টি পদ শূন্য হলো? গড় হিসেবে প্রতিদিন প্রায় ১৬ জন স্বাস্থ্য ক্যাডার অবসর গ্রহণ করে?

বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন প্রতি বছর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। যেখানে দেখা যায়, কিছু কিছু পদে নামমাত্র সংখ্যক শূন্যপদের বিজ্ঞাপন হয়। এর অর্থ হলো ঐ বছরের হালনাগাদ তথ্যে এর বেশি শূন্যপদ নাই। যেকারণে উক্ত বিষয়ে শতশত যোগ্য প্রার্থী থাকা সাপেক্ষেও তাদেরকে নির্বাচন করা সম্ভব হয় না। এক বা দু’বছর পর এই একই পদে বিশাল অঙ্কের শূন্যপদে বিসিএস বিশেষ বিজ্ঞপ্তি হয়। প্রশ্ন হলো- এক থেকে দু’বছর আগে যেখানে নামমাত্র সংখ্যায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ায় যোগ্যলোক থাকা সত্বেও নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। সেখানে অল্প সময়ে বিপুল সংখ্যকপদে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি আসে কী করে? তাহলে কী বলবো-পিএসসি শূন্যপদের চাহিদা চাইলে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ডাকে সারা দেয়নি, নাকি পিএসসি চায় না? যদি সারা নাই দেয় তাহলে সাংবিধানিক একটি প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের দায়িত্ব দিয়ে লাভ কী?

আবার দেখুন, ৩৮তম বিসিএসে সহকারী সার্জন ২২০ জন এবং সহকারী ডেন্টাল সার্জন ০৫ জন নিয়োগ দেয়। কিন্তু পরের বছর ৩৯ তম বিসিএস (বিশেষ) এ সহকারী সার্জন ৪৫৪২ জন এবং সহকারী ডেন্টাল সার্জন ২৫০ জন নিয়োগ দেয়া হয়। হয়তো ৩৮তম বিসিএসে সহকারী সার্জন হিসেবে ২২০০ জন যোগ্যপ্রার্থী পাওয়া যায় কিন্তু শূন্যপদ মাত্র ২২০ টি থাকায় বাকি ১৯৮০ জনকে নিয়োগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। আবার হতে পারে এই ১৯৮০ জন যোগ্য প্রার্থী পরবর্তিতে বয়সের জালে আটকা পড়ে আর বিসিএসে আবেদন করতে পারেনি এবং বাংলাদেশ ১৯৮০ জন মেধাবী সহকারী সার্জনের সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হলো। কিন্তু পরের বছরই বিশেষ বিসিএস এর মাধ্যমে অধিকতর কমযোগ্যদের নিয়োগ দিয়ে জনগণকে কাঙ্খিত সেবাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা হলো। অনুরূপভাবে সহকারী ডেন্টাল সার্জনের ক্ষেত্রে যদি ১০০ জন যোগ্য ও মেধাবী প্রার্থী থেকে বিজ্ঞাপিত মাত্র ০৫ জনকে নিয়োগ দিয়ে বাকি ৯৫ জনকে বঞ্চিত করা হলো।

এইটাতো হলো মাত্র ২ বা ৩টি বিসিএস পরীক্ষার মাত্র একটি পদের পরিসংখ্যাণ। অনুরূপভাবে শিক্ষা, প্রাণিসম্পদ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ইত্যাদি নামে বিশেষ বিসিএস পরীক্ষার আয়োজন করে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন একদিকে যেমন যোগ্যপ্রার্থীদের বঞ্চিত করছে অন্যদিকে অধিকতর কমমেধাবীদের নিয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের জনবল কাঠামো পূরণ করছে। যা ভবিষ্যতে জাতিকে ঘোর অমানিশার চাদরে ঢেকে দিবে। বাধাগ্রস্থ করবে জাতির পথ চলাকে। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নয়ন যাত্রায় পথ চলতে জাতি পদে পদে হোঁচট খাবে। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন এখন থেকেই সঠিক পরিসংখ্যাণ করে শূন্যপদের ধারাবাহিকতার সামঞ্জস্য  রক্ষাপূর্বক দক্ষ জনবল নিয়োগ দিয়ে জাতির উন্নয়ন যাত্রাকে ত্বরান্বিত করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

লেখক: কবি ও গল্পকার

কন্ট্রোল সুপারভাইজার

আইসিটি ডিভিশন, প্রধান কার্যালয়

জীবন বীমা কর্পোরেশন

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

সাধারণ বিসিএস এবং স্পেশাল বিসিএসঃ ক্ষতিটা কার ?

আপডেট টাইম : ১২:২৯:৪২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন ২০২১

মনির হোসেন ঃ বলতে গেলে ভারতীয় উপমহাদেশে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) এর হাত ধরেই আজকের বাংলাদেশের বিসিএস। আইসিএস প্রতিষ্ঠার পূর্বে ১৭৮৬ সালে কর্নওয়ালিস কোডের অধীনে পুনর্গঠিত সিভিল সার্ভিসকে বলা হতো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কভেন্যান্টেড সিভিল সার্ভিস। ১৮৫৩ সালে চার্টার অ্যাক্ট হওয়ার পর সিভিল সার্ভিসে পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে রিক্রুটমেন্টের ব্যবস্থাটি সম্পূর্ণ বিলোপ করা হয় এবং প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে লোক নিয়োগের ব্যবস্থা চালু হয়। তাত্ত্বিক ভাবে তখন থেকেই ভারতীয়দের জন্য সিভিল সার্ভিসের দ্বার উন্মুক্ত হয়। যদিও পারিপার্শ্বিক সুযোগ-সুবিধা, ধর্মীয় রীতিনীতি এবং আর্থিক ও ভাষাগত যোগ্যতার অভাবে প্রায় ১০ বছর দ্বার উন্মুক্ত থাকা সত্বেও ভারতীয় নাগরিক সিভিল সার্ভিসে উত্তীর্ণ হতে পারেনি।

তারপর ঠাকুর পরিবারের হাত ধরে বাঙালীদের সিভিল সার্ভিসে প্রবেশ। সেটা ১৮৬৩ সালে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এঁর মাধ্যমে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ভারতের সিভিল সার্ভিসের নাম পূর্ববর্তী ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসই (আইসিএস) বহাল থাকে। অন্যদিকে পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিসের নামকরণ করা হয় সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি)। যেহেতু পাকিস্তান দু’টি ভাগে বিভক্ত ছিল সেহেতু পাকিস্তানের সিলিভ সার্ভিসের নামও ছিল দু’রকম। পাকিস্থানের জন্য সেন্ট্রাল সার্ভিস আর প্রদেশগুলোর জন্য আলাদা প্রাদেশিক সার্ভিস। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত প্রদেশটির জন্য ছিল ইস্ট পাকিস্থান সিভিল সার্ভিস (ইপিসিএস)। যার বর্তমান নাম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)। ১৯৭২ সালের ৮ এপ্রিল প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার (পিও)-৩৪ আদেশবলে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর হাতে বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি নির্বাচনের উদ্দেশ্যে বিসিএস এর যাত্রা শুরু হয়।

প্রায় প্রতি বছর বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে থাকে। এ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পূর্বে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় সারাদেশের সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বিদ্যমান জনবল কাঠামোর শূন্যপদের তালিকা সংগ্রহ করে থাকে। প্রাপ্ত শূন্যপদ পূরণের উদ্দেশ্যেই এ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। যেমন-২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর ৪২ তম বিশেষ বিসিএস এবং ৪৩ তম সাধারণ বিসিএস এর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। ইতোপূর্বে কখনো দু’টি বিসিএস এর বিজ্ঞপ্তি এক সাথে বা কাছাকাছি সময়ে প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। প্রফেশনাল/টেকনিক্যাল ক্যাডারের পদসমূহের আওতায় ১০ থেকে ১৫ টি বিষয়ে জনবল নিয়োগ করতে দেখা যায়। আবার এই শ্রেণিভুক্ত কোন একটি বা দু’টি বিষয়ে নিয়োগের উদ্দেশ্যে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে দেখা যায়। যা বিপিএসসি’র পরিসাংখ্যিক এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার দুর্বলতা প্রকাশ করে। শুধু তাই নয়, চাকরি প্রার্থীদের সময় ক্ষেপন, রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি এবং এক শ্রেণির চাকরি প্রার্থীদের আবেদন থেকে বঞ্চিত করে থাকে।

লক্ষ্য করুন, ৪৩ তম সাধারণ বিসিএস এ স্বাস্থ্য ক্যাডারের ৭৫ টি পদ অন্তর্ভুক্ত আছে। একই সময়ে ৪২ তম বিসিএস এ স্বাস্থ্য ক্যাডারের ২০০০ পদ দিয়ে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। তাহলে এই ৭৫ জনকে বিশেষ বিসিএস এর আওতায় বিজ্ঞাপিত করতে সমস্যা কোথায় ছিল? শুধু তাই নয়, এই ৭৫ জন এবং ২০০০ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু চাকরি ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা অভিন্ন। বিশেষ বিসিএস পরীক্ষায় প্রার্থীগণ ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারী এবং মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হবে। অন্যদিকে সাধারণ বিসিএসে স্বাস্থ্য ক্যাডারের ৭৫ জন প্রার্থী ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারী, ১১০০ নম্বরের লিখিত এবং ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হবে। কথিত আছে যে, বিশেষ বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারীর প্রার্থীগণ সাধারণ বিসিএসের প্রিলিমিনারী প্রার্থীদের চেয়ে কম নম্বর পেয়ে নির্বাচিত হয়ে থাকে। তাহলে বিপিএসসির এ নিয়োগ প্রক্রিয়া কি ৭৫ জনের প্রতি অবিচার নয়?

৪২ তম এবং ৪৩ তম বিসিএস একত্রে করে ৭৫ কে নিয়ে ২০৭৫ জনের বিজ্ঞাপন হতে পারতো। তার চেয়েও ভাল হতো ৪২ তম বিসিএসর ২০০০ এবং ৪৩ তম বিসিএসের ১৮১৪ জনকে একত্রে একটি বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে ৩৮১৪ জনের জন্য একটি বিসিএস পরীক্ষার আয়োজন করা। এতে করে সকল প্রার্থী সমান প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হতো এবং রাষ্ট্রের আর্থিক সাশ্রয় হতো। প্রশ্ন আসতে পারে, সাধারণ বিসিএস এর সাথে টেকনিক্যাল পদের পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয় না। যদি তাই হয়, তবে ৭৫ জনের পরীক্ষা কীভাবে নেয়া সম্ভব? পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৩৬ তম বিসিএসে সহকারী সার্জন ১৮৭ জন, ৩৭ তম বিসিএসে সহকারী সার্জন ২৭২ জন এবং ৩৮তম বিসিএসে সহকারী সার্জন ২২০ জন এবং সহকারী ডেন্টাল সার্জন ০৫ জন নিয়োগ দেয়। কিন্তু পরের বছর ৩৯ তম বিসিএস (বিশেষ) এ সহকারী সার্জন ৪৫৪২ জন এবং সহকারী ডেন্টাল সার্জন ২৫০ জন নিয়োগ দেয়া হয়। ৩৮তম বিসিএসে এবং সহকারী ডেন্টাল সার্জন মাত্র ৫ জন নিয়োগ না দিয়ে কেন বেশি দেয়া হয়নি। ৩৮ তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয় ২০.০৬.২০১৭ তারিখে এবং ৩৯ তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয় ০৮.০৪.২০১৮ তারিখে। মাত্র ১০ মাসের মধ্যে কীভাবে ৪৭৯২ টি পদ শূন্য হলো? গড় হিসেবে প্রতিদিন প্রায় ১৬ জন স্বাস্থ্য ক্যাডার অবসর গ্রহণ করে?

বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন প্রতি বছর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। যেখানে দেখা যায়, কিছু কিছু পদে নামমাত্র সংখ্যক শূন্যপদের বিজ্ঞাপন হয়। এর অর্থ হলো ঐ বছরের হালনাগাদ তথ্যে এর বেশি শূন্যপদ নাই। যেকারণে উক্ত বিষয়ে শতশত যোগ্য প্রার্থী থাকা সাপেক্ষেও তাদেরকে নির্বাচন করা সম্ভব হয় না। এক বা দু’বছর পর এই একই পদে বিশাল অঙ্কের শূন্যপদে বিসিএস বিশেষ বিজ্ঞপ্তি হয়। প্রশ্ন হলো- এক থেকে দু’বছর আগে যেখানে নামমাত্র সংখ্যায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ায় যোগ্যলোক থাকা সত্বেও নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। সেখানে অল্প সময়ে বিপুল সংখ্যকপদে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি আসে কী করে? তাহলে কী বলবো-পিএসসি শূন্যপদের চাহিদা চাইলে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ডাকে সারা দেয়নি, নাকি পিএসসি চায় না? যদি সারা নাই দেয় তাহলে সাংবিধানিক একটি প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের দায়িত্ব দিয়ে লাভ কী?

আবার দেখুন, ৩৮তম বিসিএসে সহকারী সার্জন ২২০ জন এবং সহকারী ডেন্টাল সার্জন ০৫ জন নিয়োগ দেয়। কিন্তু পরের বছর ৩৯ তম বিসিএস (বিশেষ) এ সহকারী সার্জন ৪৫৪২ জন এবং সহকারী ডেন্টাল সার্জন ২৫০ জন নিয়োগ দেয়া হয়। হয়তো ৩৮তম বিসিএসে সহকারী সার্জন হিসেবে ২২০০ জন যোগ্যপ্রার্থী পাওয়া যায় কিন্তু শূন্যপদ মাত্র ২২০ টি থাকায় বাকি ১৯৮০ জনকে নিয়োগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। আবার হতে পারে এই ১৯৮০ জন যোগ্য প্রার্থী পরবর্তিতে বয়সের জালে আটকা পড়ে আর বিসিএসে আবেদন করতে পারেনি এবং বাংলাদেশ ১৯৮০ জন মেধাবী সহকারী সার্জনের সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হলো। কিন্তু পরের বছরই বিশেষ বিসিএস এর মাধ্যমে অধিকতর কমযোগ্যদের নিয়োগ দিয়ে জনগণকে কাঙ্খিত সেবাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা হলো। অনুরূপভাবে সহকারী ডেন্টাল সার্জনের ক্ষেত্রে যদি ১০০ জন যোগ্য ও মেধাবী প্রার্থী থেকে বিজ্ঞাপিত মাত্র ০৫ জনকে নিয়োগ দিয়ে বাকি ৯৫ জনকে বঞ্চিত করা হলো।

এইটাতো হলো মাত্র ২ বা ৩টি বিসিএস পরীক্ষার মাত্র একটি পদের পরিসংখ্যাণ। অনুরূপভাবে শিক্ষা, প্রাণিসম্পদ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ইত্যাদি নামে বিশেষ বিসিএস পরীক্ষার আয়োজন করে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন একদিকে যেমন যোগ্যপ্রার্থীদের বঞ্চিত করছে অন্যদিকে অধিকতর কমমেধাবীদের নিয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের জনবল কাঠামো পূরণ করছে। যা ভবিষ্যতে জাতিকে ঘোর অমানিশার চাদরে ঢেকে দিবে। বাধাগ্রস্থ করবে জাতির পথ চলাকে। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নয়ন যাত্রায় পথ চলতে জাতি পদে পদে হোঁচট খাবে। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন এখন থেকেই সঠিক পরিসংখ্যাণ করে শূন্যপদের ধারাবাহিকতার সামঞ্জস্য  রক্ষাপূর্বক দক্ষ জনবল নিয়োগ দিয়ে জাতির উন্নয়ন যাত্রাকে ত্বরান্বিত করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

লেখক: কবি ও গল্পকার

কন্ট্রোল সুপারভাইজার

আইসিটি ডিভিশন, প্রধান কার্যালয়

জীবন বীমা কর্পোরেশন