১/১১ ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়

খুজিস্তা নূর–ই-নাহারীন মুন্নী:

হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ নিয়ে অপেক্ষা আর কতকাল! অবশেষে মুখ খুললেন আমাদের প্রাণ প্রিয় নেত্রী, দেশরত্ন শেখ হাসিনা। সংগ্রামের ভিতরে তার জন্ম ও বেড়ে উঠা। শিরায় শিরায় অন্যায় আর অসত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, অমিত সাহস নিয়ে প্রতিবাদ প্রতিরোধ তার স্বভাব। জন্মের পর থেকে দেখেছেন তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কঠিন সংগ্রাম, মুখোমুখি হয়েছেন অনিশ্চিত অন্ধকার সময়ের। বাবাকে বারবার যেতে হয়েছে জেলে ও ফাঁসির মঞ্চে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সুমহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তার পিতাকে কারাবন্দি করে ফাঁসির রায় দিয়ে কবর খুঁড়েছে। দুই ভাই গেছে মুক্তিযুদ্ধে। পরিবারের সঙ্গে তিনি নয় মাস বন্দিদশায় কাটিয়েছেন। ৭৫ এর ১৫ আগস্টের কালো রাতে দেশের বাইরে থাকায় ছোটবোন শেখ রেহানাসহ অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে যান। কিন্তু সেই অভিশপ্ত রজনীতে বাবা, মা , ভাইসহ স্বজন হারানোর যন্ত্রণা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। নির্ঘুম নিশুতি রাত কেবলই কাঁদায়। ৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে অন্ধকার সামরিক শাসন কবলিত মাতৃভূমিতে আশার বাতি জ্বালিয়ে মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শুরু করেন। তার নেতৃত্বেই অন্ধকার কবর থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক

, গণতান্ত্রিক শক্তির নবজাগরণ ঘটে। কিন্তু ষড়যন্ত্র যেন তাঁর পিছু ছাড়ছে না। এ পর্যন্ত ২১ বারের বেশি তাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর তাকে মোকাবেলা করতে হয়েছে ২০০৭ সালের ১/১১ এর কালো Sheikh-hasina-jailঅধ্যায়। তবুও দমেননি। চারদিকে ষড়যন্ত্রের জাল ভয় আর আতঙ্ক তৈরি করা হলেও তার তেজস্বী নেতৃত্ব অদৃশ্য কালো শক্তিকে পরাস্থ করেছে। ভাবতে অবাক লাগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি রক্ত বিন্দুর প্রতি আমাদের যেখানে কৃতজ্ঞ ও চিরঋণী থাকার কথা ছিল, সেখানে ক্ষমতার লোভ বা ভয়ে নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তার রক্ত ও আদর্শের উত্তরাধিকারের সাথে প্রতারণা, বেইমানী, নিশ্চিহ্ন করার বিশ্বাস ঘাতকতার ধারাটির অপতৎপরতা আজ অবধি বিদ্যমান। কিন্তু প্রতিটি সময় ষড়যন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করে দেশের উন্নয়নের ধারাকে গতিশীল রাখা, সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাঁর দূরদর্শিতা, সাহস এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ক্রমান্বয়ে।

১/১১ এর ভুক্তভুগী মাত্রই জানেন এর তীব্রতা এর দহন, অপমান আর অসহায়ত্বের করুণ কাহিনী । আমার মত কত হাজার পরিবার বিনা দোষে নির্যাতিত, লাঞ্ছিত বার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সুখ আর স্বপ্নগুলো হারিয়েছে তার খবর কে রাখে!

২৩ জানুয়ারি ২০০৭। ভয়ঙ্কর কালো রাত। মধ্যরাতে হঠাৎ দরজায় বিরতিহীন কলিংবেলের শব্দ। বাইরে দাঁড়িয়ে শ’খানেক কালো ড্রেস পড়া লোক। টিংকু তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো, দরজা খুলে দিলো। রাতের নিস্তব্ধতা চিড়ে সবাই হুড়মুড় করে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়লো। পুরো বাড়ির লাইট জ্বালিয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে শান্তির জায়গাটি গ্রাস করে নিল এক অচেনা আতঙ্ক।

ওরা আমার শাড়ির আলমারি দেখল, গহনা দেখল, ড্রেসিং টেবিল, বুকশেলফ সবকিছু। একজন ড্রইং রুম থেকে একটি শোপিস তলোয়ার এনে বলল, পেয়েছি স্যার। অফিসারটি ধমক দিয়ে বললেন, ‘এটা শোপিস, রেখে আস’। তারা চারতলা শেষ করে তিন তলায় নামলেন। আমি দুই বাচ্চা নিয়ে বেড রুমে বসে আছি। সুযোগ বুঝে একজন উপরে উঠে এলেন। বললেন, আপনার গহনা আর টাকাগুলো দিন, আবার দেখতে হবে।

একজন অফিসার তাকে বললেন, ‘অনুমতি ছাড়া এখানে এসেছেন কেন নিচে নামুন’। ভেতরে ভেতরে আমি ভয় পাচ্ছি। একা মহিলা মানুষ। চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। পুরো বাড়িতে শ’খানেক পুরুষ লোক। অজানা আশঙ্কায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। একজন খুশিতে চিৎকার করে বলল, পেয়েছি স্যার। মনে হলো নিউটনের মধ্যাকর্ষণ শক্তির মতোন কিছু একটা আবিষ্কার করে ফেলেছে। ওদের স্যার নামক লোকটি বললেন, ‘কি পেয়েছেন’? উত্তর এলো শর্টগান। আমি বললাম,” লাইসেন্স আছে” । তারা বললেন, একতলা-দুতলার চাবি দিন। আমি বললাম, ওটা জি-হাঞ্জের অফিস, চাবি আমার কাছে নেই। ওরা সব ফার্নিচার ভেঙে ফেলল। টিংকুর সাথে ড্রাইভার,কাজের লোক, বাসার ম্যানেজার, গ্রামের বাড়ি থেকে আসা কয়েকজন মেহমানকে ধরে নিয়ে গেল। তারা চাকরি ও চিকিৎসার জন্যে এসেছিলেন। আচ্ছা, এতগুলো গরীব অসহায় লোককে ওরা ধরে নিয়ে গেল কেন? ওদের কী দোষ?

আমি ভোর ৫টায় ফজরের নামাজ আদায় করে এবিএম জাকিরুল হক টিটনকে সঙ্গে নিয়ে র‌্যাব-৩ এর অফিসে গেলাম। টিংকুর স্নেহসান্যিধ্যে থাকা টিটনই সেই বিপদের সময় মুরগির খাঁচা ভরা ট্রাকে চরে উত্তরা থেকে ছুটে এসেছে। বাইরে বসে আছি, এমন সময় র‌্যাবের অফিসার সুলতান-ই-নুর এলেন। প্রথমে কথা বলতে চাইলেন না, আমি নাছোড়বান্দা। সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললেন, আমার অনেক কাজ আছে। বললাম, আমার বাসা আপনার এলাকার ভেতর। আমার স্বামীকে কে বা কারা ধরে নিয়ে গেছে। আপনার কাছে এসেছি সে কোথায় জানতে।এবার তিনি ভেতরে ঢুকতে দিলেন।

পরদিন পত্রিকা খুলে একেবারে মিথ্যা সম্পূর্ণ কল্পকাহিনী দেখতে পেলাম। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সবার নিষেধ উপেক্ষা করে আপা মানে আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার সাথে সুধা সদনে দেখা করতে গেলাম। আপাকে বললাম, ওরা টিংকুকে বলির পাঁঠা বানাচ্ছে। সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতে চাচ্ছে। সাংবাদিকদের দিয়ে যা খুশী তা লিখিয়ে ওর বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে চাচ্ছে। আমি এখন কী করব? আপা বললেন, “তোমাদের বঙ্গবন্ধু বছরের পর বছর জেল খেটেছেন, আর তুমি এত অল্পে ভেঙে পড়লে কী করে হবে!” পরদিন প্রেসিডিয়ামের একটি সভায় আপা দাবি করেন, “কোন নির্দোষ ব্যাক্তি যেন শাস্তি না পায়”। একেকটি দিন যেন একেকটি মাসের সমান। বিকেল হলেই ধর-ফর, সন্ধ্যা নামলেই ভয়। ‘শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, আর পারছি না’। নিচতলায় ড্র্য়িং রুমে বিভিন্ন খতম চলছে। আমার হাতে তসবিহ্। সবসময় অজু রাখি, কখন কোন অবস্থার মুখোমুখি হতে হয় কে জানে। ঘুম হয় না, প্রচন্ড মাথা ব্যথা। অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেললাম্। তিন দিনের দিন আমার এক আত্মীয়র মোবাইল ফোনে একটা কল এলো । অন্যপ্রান্ত থেকে আমাদের অতি আপন এক সেনা কর্মকর্তা বললেন, “এ রাতটা বড় কঠিন টিংকুর জন্য। কাল সকালে ওরা হার্ট ফেইলোর, স্ট্রোক অথবা ক্রস ফায়ার দেখাতে পারে, তোমরা সদকার ব্যবস্থা করো”। আরও বললেন, “নেত্রীকে জানা্ও, এদের টার্গেটের শীর্ষে তিনি, এরা ধীরে ধীরে ওনার দিকে অগ্রসর হবে” । ঘটনাটি একটি চিরকুটে লিখে ইঞ্জিনিয়ার চন্দনকে দিয়ে ধানমণ্ডি ৩ নম্বরে ড. আওলাদ হোসেনের কাছে পাঠালাম নেত্রীকে জানানোর জন্য।

হঠাৎ খবর এলো দুই কোটি টাকা দিলে আমার স্বামীকে ওরা ছেড়ে দেবে। এতো টাকা কোথায় পাব? টাকার জন্য সবাইকে ফোন করতে লাগলাম। এরপর আবার চিরকুট এলো, টাকার ব্যাপারটা সবাই জেনে গেছে, আমার টেলিফোন টাকা চাওয়া উচিত হয়নি। এখন ১ কোটি টাকা দিলে ওরা ওকে এমনভাবে টর্চার করবে যাতে তার কিডনি বিকল না হয়, অন্ধ না হয়। আমি দিশা হারিয়ে ফেললাম। ৭ দিন পর মাঝরাতে আমার ড্রাইভার মিশির আলী, ম্যানেজার বেলাল এবং গ্রামের লোকদের ছেড়ে দিল। আমার মুখোমুখি বসে ওরা কাঁদতে লাগল। বলল, মধ্যযুগীয় কায়দায় চোখে কালো কাপড় বেঁধে টর্চার করেছে। ইলেকট্রিক শক দিয়েছে। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে মুখের উপর হাজার ভোল্টের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছে। মাথা নীচে পা উপরে দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। ওরা ওদের উপর অকথ্য র্নিযাতন করেছে। ওদের সারা শরীরে কালো কালো দাগ। তবে জানলাম টিংকু বেঁচে আছে। বাকি রাতটুকুন চোখে আর ঘুম এলো না। পরদিন সবাইকে নিয়ে রওনা হলাম ড. কামাল হোসেনের চেম্বারের উদ্দেশ্যে। বুঝলাম গাড়িকে ফলো করা হচ্ছে। সঙ্গে ছাত্র নেতা সালাউদ্দিন শেলু। প্রথমে ব্যারিস্টার তাঞ্জিব, পরে ব্যারিস্টার সারা হোসেনের সাথে দেখা করলাম। তাঁকে বললাম, “এদের কী দোষ! এদেরকে নির্দয়ভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, এদের মামলা আপনাকে লড়তে হবে”। সারা হোসেন রাজী হলেন। সন্ধ্যার একটু পরে ফোন এলো, কারা যেন ল-ইয়ারকে অনুরোধ করেছে মামলা না নিতে। ওরা নাকি দেশের ভালোর জন্য কাজ করছে। অল্পদিনের মধ্যে ওরা টিংকুকে ছেড়ে দিবে। সত্যিই কি দেশের ভালোর জন্য করছে! মনে মনে খানিকটা আশ্বস্ত হলাম। দু-দিন পর বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত, আরও দুই নারীর সঙ্গে উত্তরায় একটি ছয়তলা ভবনের ছাদে উঠে মোনাজাতে অংশ নিলাম। এদের একজনের স্বামী তখন কারাগারে। তার মুখ হাসি হাসি। তিনি কুড়িয়ে পাওয়া একটি খবরের কাগজ পড়ে শোনাচ্ছেন। নাজমুল হুদা, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, তৈমুর আলম খন্দকার, গিরিলাল মোদি, সালমান এফ রহমান, মোহাম্মদ নাসিম, পঙ্কজ দেবনাথ, আওলাদ হোসেন, যমুনা গ্রুপের নূরুল ইসলাম বাবুলসহ আরও অনেককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি বললেন, মুন্নি আপা, আমাদের শেষ এদের শুরু। আমাদেরকে এতদিন অনেকে অনেক কথা বলেছে, এখন! সেই রাতেই টিংকুকে আমাদের মগবাজার বাসায় নিয়ে এলো। তারপর ক্যান্টনমেন্ট থানায়। সেখান থেকে সুপ্রিম কোর্ট। প্রচন্ড ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এর মধ্যে বিভিন্ন দিক থেকে তীর্যক মন্তব্য কানে আসে “চোরের বউ।” বুঝলাম সবই সাজানো। টিংকু বলল, সেনা সমর্থনে তত্বাবধায়ক সরকারে দেশ চলছে অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিকভাবে। ৯০এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই হয়তো কেও টার্গেট করে রেখেছিল আমাকে। টিংকু বলল ‘তবে চিন্তা করো না, হাবিয়া দোযখ থেকে এবার বেহেশতে এলাম’। আদালত থেকে ওদের কে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নেয়া হলো। জেলে ওর ঠিকানা হল সেল নম্বর ৭ বকুলে। এসবি ক্লিয়ারেন্স ছাড়া তার সাথে দেখা হবে না। মালিবাগ এসবি অফিস থেকে ক্লিয়ারেন্স বের করতে লাগবে তিন দিন। ছাত্রলীগের অর্পণা অভয় দিয়ে বলল, “চিন্তা করবেন না সব ব্যবস্থা করে দেব”।

শুরু হলো আমাদের চিঠি চালাচালি। টিংকু চিরকুট পাঠিয়ে জানালো, ১টি বড় ফ্রিজ, ৪২ ইঞ্চি টেলিভিশন, ১টা মাইক্রোওভেন, ১ টি বড় টেবিল ফ্যান, ১টা রেডিও ও কফি মেকার সহ হাড়ি, পাতিল, প্লেট, গ্লাস, চামচ পাঠাতে। জবাবে লিখলাম, “পরিবর্তিত সময়ে, সময় এবং স্রোত দুটোই উল্টো দিকে বইতে শুরু করেছে, বর্তমান ক্ষমতাশীনদের মানুষ ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে, দেশের সুশীলরাও ওদের সঙ্গে আছে, চারদিকে সৎ-যোগ্য ও ত্যাগী মানুষদের জয়-জয়কার! এখন একটু সংযত হও। যারা দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতেতে মানুষের জন্য ভূমিকা রাখছে তারা সবাই গণহারে অসৎ হয়ে গেলে!’

দুদিন পর তার সঙ্গে দেখা হলো। মনে হল খানিকটা শুকিয়ে গেছে। দুই সন্তানসহ আমাদের তিনজনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলল, অনেক অত্যাচার করেছে বিনা কারণে। আমি নির্দোষ। এরা কি করতে চাইছে কেন চাইছে নিজেরাও জানেনা। ওদের কোন হোমওয়ার্ক নেই। ওরা ডেবিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ডের পার্থক্য বুঝেনা। খুব অল্প সময়ে এদের উপর মানুষের আস্থা সরে যাবে।

দ্বিতীয় বার দেখা করার জন্য একমাস অপেক্ষা করতে হবে। মতিঝিলের নিজের ব্রোকারেজ হাউজের অফিসে যাওয়া শুরু করি। অন্য একটি ব্রোকারেজ হাউসের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক রেজাউল করিম বললেন, ‘আপনার স্বামী দোষী! ‘আপনি কি করে জানলেন? “পত্রিকা পড়ে” সোজা-সাপটা উত্তর। চিৎকার করে উঠি, পত্রিকায় যা কিছু ছাপা হয় সবই কি সঠিক? আপনি না ইঞ্জিনিয়ার! মনে মনে বলি সমাজের সামনে মানুষের চরিত্র হননে তারা সফল। পঙ্কজ দেবনাথের স্ত্রী মনিকা মনোয়ারা ক্লিনিকে ভর্তি। অতিরিক্ত মানসিক চাপে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাই সময়ের আগে সিজারিয়ান অপারেশন করতে হচ্ছে। মনোয়ারা ক্লিনিকে গেলাম। মনিকা কাঁদছে ওর সাথে আমরা সবাই কাদঁছি। এই মুহূর্তে যে শিশুটির জন্ম হবে তার চারদিকে প্রতিকূল পরিবেশ। ফুটফুটে একটা মেয়ে হলো, যার বাবা এখন জেলে। কবে দেখা হবে ওর বাবার সাথে?

দ্বিতীয়বার টিংকুর সাথে দেখা করতে গেছি, ওর খুব মন খারপ। বলল, তাকে ভীষণ চাপ দিচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আব্দুল জলিল ও বর্তমান যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে মামলা দিতে। জানতে চাইলাম, তুমি কি ঠিক করেছো? সে বলল, ওদের কে পরিস্কার বলে দিয়েছে উনারা তার নেতা। প্রয়োজনে জীবন দেবে, কিন্তু মামলা করবে না। টিংকুর উপর একদিকে মামলা করার চাপ অব্যাহত থাকলো অন্যদিকে তাকে বুঝানোর জন্য ইঞ্জিনিয়ার হাবীব ফোনে অনুরোধ করতে থাকলেন।

বুঝতে পারি আমি নজরবন্দি। চোখ রাখছে কেউ। বাসায় কেউ আসতে চায় না। বিপদে পড়বে এই আশঙ্কায় অনেকে এড়িয়ে চলেন। নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে আবার রোজ বিকেলে রমনা পার্কে হাঁটতে যাই।

একদিন অপরিচিত একজন আমার পাশে হাঁটতে শুরু করলেন। আমায় প্রস্তাব দিলেন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এক কোটি টাকার চাঁদাবাজির মামলা দিলে টিংকুকে মুক্ত করা সম্ভব। অবাক হয়ে তাকে বললাম, এতোবড় অন্যায় মিথ্যাচার আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বিষয়টি নেত্রীকে অবহিত করার জন্য মতিয়া চৌধুরীর বাসায় গেলাম। তার স্বামী প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম বজলুর রহমানের সামনেই খুলে বললাম। তিনি নেত্রীকে জানাবেন বলে আমায় আশ্বস্ত করলেন। তবে নেত্রী থেকে এই মুহূর্তে দূরে থাকার পরামর্শ দিলেন। তারা দু’জন বললেন, ‘মনে সাহস রাখো, আর কখনও কোন অবস্থাতেই নিজেকে দূর্বল মনে করবে না। এই মুহূর্তে তুমি দূর্বল হলে অন্যরা তোমাকে পেয়ে বসবে।’ এর মাত্র অল্প কিছুদিন পর আজম যে চৌধুরী, তাজুল ইসলাম ফারুকসহ অন্য আরও কয়েকজন নেত্রীর বিরুদ্ধে চাঁদা বাজির মামলা দিলেন। হয়তবা বাধ্য হয়েই।

তৃতীয়বারের মতো টিংকুর সাথে দেখা করতে গেলাম, এবার অনেক বই নিয়ে এসেছি, বেশির ভাগই উপন্যাস। ও বলল, ‘একটা ডিভিডি সেট আছে আমাদের কাছে। নতুন হিন্দি সিনেমা, আর বাংলা সিরিজ নাটকের সিডি পাঠাও। ৭ নম্বর সেলে নতুন সদস্য যমুনা গ্রুপের নুরুল ইসলাম বাবুল, জনকন্ঠ সম্পাদক আতিকুল্লাহ খান মাসুদ। তাকে জানালাম, ঢাকা শহরে এখন জোর গুজব দুই নেত্রীকে নাকি জেলে ঢোকাবে। দুই নেত্রীর মুখোশ পরে গানের সাথে এনিমেশন করে মোবাইল ফোনে ফোনে তাদেরকে বিদ্রূপ করা হচ্ছে। টিংকু বলল, ‘বড় দুই দলের লোক ছাড়া গণবিচ্ছিন্ন লোক দিয়ে দেশ চালানোর চিন্তা উর্বর মস্তিস্কের ফসল। এতে দেশের সর্বনাশ হবে’।

পঞ্চমবার যখন দেখতে গিয়েছি তখন টিংকুকে খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। ওদের সেলে নতুন যোগ হয়েছেন আব্দুল আওয়াল মিন্টু, আবুল খায়ের লিটু, মীর নাসির উদ্দিনের ছেলে মীর হেলাল, ইকবাল হাসান মাহমুদের ছেলে আবিদ। পুরনোদের মধ্যে আছেন গিরিলাল মোদী, তার ভাই গিরিশলাল মোদী, পঙ্কজ দেবনাথ, আওলাদ হোসেন, মাহমুদ হাসান বাবুল, তৈমুর আলম খন্দকার, কমিশনার কাইয়ুম, সিএম কয়েস সামী, মুন্সী আনোয়ার, মো. রাজ্জাক, হাসেম চেয়ারম্যান আর হাসান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আটক করা হয়েছে ড. আনোয়ার হোসেন, ড. হারুন আর রাশিদ, ড. নীম চন্দ্র ভৌমিককে। টিংকু বলল, একটি টেবিল ও ছয়টি চেয়ার পাঠাতে হবে কার্ড খেলার জন্য। ও’ বলল, চিন্তা করো না দেশের সমস্ত বড়লোকরাই এখন জেলের ভেতর। ওরা নিজেরাই কনফিউজড, ত্রাস সৃষ্টি করার জন্যেই সবাইকে জেলে পুরছে, দেশে ভীতির শাসন কায়েম করতে চাচ্ছে। ক্ষমতার মোহে অন্ধের মতো যা খুশী তাই করছে। যে মামলাগুলো দিচ্ছে এগুলোর একটিও ধোপে টিকবে না। সব সাজানো মামলা। যারা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদকে মদের মামলা দেয়, কোনদিন মদ পান না করেও মদের মামলায় দেশ ছাড়া করে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে তারা আর যাই হোক বেশিদিন নয়। বলেই দরাজ গলায় প্রাণখোলা হাসিতে ফেটে পড়লো। বুঝলাম টিংকু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।

মানুষের চোখে তখন ঘুম নেই, মানসম্মান হারানোর ভয়, নাজেহাল হওয়ার আশঙ্কা আর আতঙ্কগ্রস্থতা তাঁদের তাড়া করে ফিরে। টিংকুর কোম্পানির পাওয়ার অব এটর্নি তখন আমার কাছে। ওদের সাদা টাকার অভাব নেই। আমি টিংকুর রাজনৈতিক সহযোদ্ধা এস এম কামাল হোসেনকে অভয় দিলাম। আমাদের কোম্পানির প্যাডে উনার ইনকামট্যাক্স সার্টিফিকেট সম্পূর্ণ ঠিক করে দিলাম।

ষষ্ঠবার গিয়ে টিংকুকে কেমন যেন অস্থির মনে হচ্ছে। সে বলল, ক্ষমতাসীনরা দেশের পুঁজিপতিদের ধরে এনে এলোপাথাড়ি মামলা দিচ্ছে যেগুলোর কোন ভিত্তি নেই। আমি বললাম, এমন হলে পুঁজিপতিরাতো দেশে বিনিয়োগের পরিবর্তে বিদেশকেই নিরাপদ মনে করবে। এ টাকা দিয়ে দেশের লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হতে পারতো, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন তথা সার্বিক পুঁজির বিকাশে তা বিরাট ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু এখন সব টাকা অন্ধকার পথে বিদেশে পাচার হয়ে যাবে ওরা কি বুঝতে পারছে না যে দেশের কত বড় ক্ষতি ওরা করছে? টিংকু বলল, অর্থনৈতিকভাবে দেশটাকে পঙ্গু বানিয়ে ফেলছে। পঙ্গু দেশকে অন্যদের উপর নির্ভর করা ছাড়া আর কোন পথ থাকবে না।

সপ্তমবার যখন দেখা করতে যাই তখন ওর ডিভিশন হয়েছে, কিন্তু ও অন্য কোথাও যাবে না। ৭নং সেলে থাকতে থাকতে কেমন একটা মায়া জন্মে গেছে। এই সেলের বেশিরভাগ বন্দিই ভিভিশন পেয়েছে। কিন্তু ওরা কেউ যাবে না। এখানে ওরা একে অপরের কষ্টের আত্মীয়। সমস্ত অপমান অবমাননা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সাক্ষী। সেলে নতুন যোগ হয়েছে ইকবালুর রহিম। ও টিংকুকে খবর পাঠিয়েছিল টিংকু যেন ওকে ৭নং সেলে নিয়ে আসে। ডিআইজি শামসুল হায়দার চৌধুরীর ডাক নাম জুয়েল। জামালপুরে আমাদের কাছাকাছি বাসা। এ ছাড়া আমার ভাইয়ের জিগরী দোস্ত। এই সুযোগে আমি ওনার কাছে প্রায়ই অনেক আবদার করতাম। তার একটি ছিল ইকবালুর রহিমকে ৭নং সেলে নিয়ে আসা। টিংকু বলল, ‘ইকবাল সারাদিনই কান্নাকাটি করছে ওর মনটা বড় নরম। ইকবালকে ওরা চাপ দিচ্ছে বাহাউদ্দিন নাসিমের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য। ইকবাল ওর বউ আর তিনটি ছোট ছোট বাচ্চার কথা ভেবে রাজি হয়ে যাচ্ছে। আমি ইকবালকে ভয় দেখিয়েছি, মামলা করলে রাতের বেলা তোকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলব। এখন ইকবাল আরও বেশি কান্নাকাটি করছে’। এবার আমার পঙ্কজ দেবনাথের সাথে দেখা হলো। উসকো-খুশকো চুল। চোখ দুটো লাল পরনে পুরনো ময়লা পাঞ্জাবী। বললেন, ভাবী দুর্নীতিবাজ হয়ে গেলাম, তাও আবার প্রথম ৫০ জনের মধ্যে। ওর চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে লাগল। আমি বললাম ধৈর্য ধরেন ওরা বেছে বেছে তাদেরকেই ধরছে যারা প্রতিবাদী ও সংগঠক। এইজন্যই আপনাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। পঙ্কজ বললেন, জানেন আমার বাচ্চাদের দুধ কেনার পয়সা নাই অথচ ওরা মনিকার বিরুদ্ধেও মামলা করেছে। মনিকাকে দুটি বাচ্চা নিয়ে ১৩ মাইল হেটে কলকাতায় নিরাপদ আশ্রয় নিতে হয়েছে। বললাম জানি, টিংকু মনিকাকে সাহায্য করার জন্য লন্ডনের (বর্তমান যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) সৈয়দ সাজেদুর রহমান ফারুক এবং কলকাতার অনুপ কুমার সাহাকে ( তুলসি) জেল থেকে লুকিয়ে টেলিফোন করেছে।

অষ্টমবার যখন যাই তখন আমাদেরকে বসতে বলে টিংকুকে খবর পাঠিয়েছে। আমাদের পাশের চেয়ারে আমানুল্লাহ আমান ও তিনটি ছেলে-মেয়ে ওরা ওদের বাবার সাথে দেখা করতে এসেছে। আমার বাচ্চাদের বললাম, দেখ, ওদের বয়সও তোমাদের মতন কিন্তু ওদের বাবা-মা দুজনই জেলে। টিংকু এলো। সাথে আবিদ। আবিদদের আজ পূর্নমিলনী। ওর মা আর সারাও আসবে। ওদের তিনজনের আজ দেখা হবে। সারা ২০-২২ বছরের একটি মেয়ে। যে বয়সে মানুষ পুরো পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখে সে বয়সে ও জেলখানার চার দেয়ালে বন্দি। মেয়েটির চোখে মুখে অজানা এক আতঙ্ক। কী অপরাধ মেয়েটির? বাবা যদি কোন অন্যায় করে থাকে তার সাজা তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে কেন পেতে হবে? ওরা কি আলাদা সত্তা নয়? টিংকু বলল, আবিদ খুব মন খারাপ করে থাকে। বিশেষ করে ওর বোনটার কথা ভেবে বলে, চাচা আমার বোনটার বিয়ে হবে না। ওদের আরেক সঙ্গী ব্যারিষ্টার হেলাল সান্ত্বনা দিয়ে বলে চিন্তা করিস না, তোর বোনের যার সাথে বিয়ে হবে ওরাও নিশ্চয় এখন জেলাখানায় আছে ।

নবমবার গেলে টিংকু নীচের দিকে তাকিয়ে আছে কথা বলছে না। খানিকটা চিন্তিত দেখাচ্ছে। বললাম, শরীর খারাপ? উত্তর দিল না। বলল, এতদিন হয়ে গেল কোন মামলা দিতে পারল না, তবুও আটকে রেখেছে। দুই নেত্রীকে ওরা সাবজেলে রেখেছে। কিন্তু এরপর কী করবে সে ব্যাপারে ওদের কোন নির্দেশনা নেই। দেশের সব মেধাকে জেলে বন্দি করে ওরা কী করতে চাইছে সেটা তারাই ভালো জানে। বুঝলাম, জেলের চার দেয়ালে ও হাপিয়ে উঠেছে। তবে নতুন একটা ঘটনা হলো, ও’ আমাদের তিনজনের জন্য তিনটি শেফালি ফুলের মালা এনেছে। নিজ হাতে গেঁথে। আমার মেয়ে মালা পেয়ে খুব খুশি হলো।

ওয়ান-ইলেভেনে কেউ কেউ নতুন একটা ইস্যু বের করেছে ইয়াবা সুন্দরী। রাত বিরাতে ওরা সুন্দরী মেয়েদের বাড়িতে হানা দেয়। সুন্দরী মেয়েরা কি শুধু গভীর রাতেই ইয়াবার ব্যবসা করে! নাকি ক্ষমতার উম্মক্ততায় ওরা যা খুশী তাই করছে। আমরা সবাই নিশ্চুপ, প্রতিবাদের ভাষা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তারা সকল প্রশ্নের উর্ধ্বে, সকল জবাবদিহিতার উর্ধ্বে। এদের চোখ আছে, কিন্তু দূরদৃষ্টি নেই। কান আছে কিন্তু মানুষের বুকফাটা আর্তনাদ সেখানে পৌছায় না। মুখ আছে কিন্তু চিন্তার গভীরতা না থাকায় সঠিক বাক্যটি বেরিয়ে আসতে পারে না। মন আছে কিন্তু মস্তিস্কের সাথে সমন্বয়হীনতার কারণে সঠিক সিদ্ধান্তটি গ্রহন করতে পারে না। তাদের মানবিকতা হারিয়েছে ক্ষমতার দম্ভে।সবচেয়ে বেশি যেটা নেই, তা হচ্ছে নিজেদের ক্ষমতা এবং দৌড় সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা। নিজেদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে ওরা একবারেই অজ্ঞ। ওরা সবকিছু লেজেগোবরে করে ফেলেছে। গ্রাম এবং মফঃস্বল শহরগুলোতে বিভিন্ন অজুহাতে বাড়িঘর ভাঙছে, দোকানপাট ভাঙছে, হাট-বাজার নষ্ট করছে। দেশের কোথাও দুর্নীতি কমেনি, কিন্তু রেইট বেড়ে গেছে। দেশে চলছে নীরব দুর্ভিক্ষ। অর্থনৈতিক মন্দার চাপে মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। র‌্যাংগস ভবনের নিচে গাড়ির শ্রমিকদের লাশ পরে আছে কিন্তু বোবা সুশীল সমাজ। মাত্র কিছুদিন আগে যে ক্ষমতাসীনদের তারা ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেছিল আজ সেখানে শুধুই ধিক্কার। দুর্নীতিবাজদের ধরতে গিয়ে এক দল দুই হাতে টাকা কামাচ্ছে, এতে নিজেদের মধ্যে অনেকেই অসন্তুষ্ট হচ্ছে। সব মিলিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। বিশেষ করে যেদিন শেখ হাসিনাকে অপদস্ত করে গ্রেফতার করে আদালতে নিয়েছে সেদিনই সেই সরকারের বিরুদ্ধে জনমত এক জায়য়গায় মিলিত হয়েছে। বাইরে সর্বগ্রাসী হতাশা আর ক্ষোভ তাদের গ্রাস করে রেখেছে।

আগষ্ট মাস, অফিসে কম্পিউটারের মনিটরের দিকে তাকিয়ে বাজার পর্যবেক্ষণ করছি, হঠাৎ দেখি প্রচণ্ড নিম্নমুখি প্রবণতা। কোন কারণ নেই। পুঁজিবাজার নীতি-নির্ধারণে কোন পরিবর্তন আছে বা আসছে বলেও আমার জানা নেই। তাহলে কি দেশের অবস্থা খারাপ? অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠল। ঢাকা স্টক একচেঞ্জের প্রেসিডেন্ট রকিবুর রহমানকে ফোন করতেই তিনি বলল, বাসায় চলে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলমাল হয়েছে। শুনতে পেলাম খেলার মাঠে ছাত্রদের সাথে সেনা সদস্যদের আচরণ নিয়ে বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ১৪৪ ধারা জারি হতে পারে। পথ-ঘাট সব ফাঁকা। যে যেদিক পারছে ছুটে পালাচ্ছে। আজ গাড়িতে উঠতে ইচ্ছে হল না। রিক্সায় বাড়ি ফিরবো। ‘আহ!’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নিজের ভিতর কেমন একটা প্রশান্তি অনুভব করলাম। ভাষা থেকে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের সূতিকাগার। সময়ের সাহসী সন্তানেরা দেশের প্রয়োজনে ঠিকই প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছে। মানুষও সমর্থন দিয়েছে।

‘আমাদের সময়’ পত্রিকায় একটা খবর বের হলো। ‘শেরাটন’ এর সামনে বাস পোড়ানোর মামলায় নেত্রীসহ আরো অনেকের সাথে টিংকুকেও আসামী করা হবে। রাতেই মোবাইলে প্রাইভেট নাম্বার থেকে ফোন এলো। ঐ প্রান্ত থেকে বলল, ‘আপনার স্বামীর অপকর্মের সমস্ত ভিডিও আছে আমাদের কাছে। আর বাস পোড়ানোর মামলায় তার ফাঁসি হওয়ার সম্ভাবনা’। উত্তর দিলাম, ‘কোন সমস্যা নেই, আপনাদের ভিডিও দিয়ে যা খুশি করতে পারেন। আর বাস পোড়ানোর কথা বলছেন, টিংকু তখন দুই মাস দেশের বাইরে ছিল, পাসপোর্টে সীল আছে, প্রমাণ করতে পারবো’। চারদিক থেকে টাকার চাপ। কোথায় পাব এত টাকা? জাতীয় চার নেতার মত জেলের ভেতরে সবাইকে ওরা ব্রাশ ফায়ার করে মারবে। নয়তো গ্রেনেড হামলা করবে। আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি। সামসুল হায়দার চৌধুরীর কাছে গেলাম। উনি বলল, আমার জীবন থাকতে জেলের ভিতর কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার প্রশ্নই ওঠে না। নিশ্চিন্ত হলাম। সংসার খরচ, মামলা চালানোর টাকার অভাবে পড়লাম। টিংকু তালিকা দিল। তার পাওনা টাকা তুলতে।৫০লাখ টাকার একটা টাকাও পাইনি। যারা নেয়নি তারা ৪ লাখ দিল। মানুষ কতোটা নিষ্ঠুর অমানবিক হয় বিপদে পড়লে বোঝা যায়। একদিন আমেরিকা প্রবাসী একজন এলেন আমার অফিসে। পুরনো চেনা মানুষ। বললেন, টিংকু আর বের হবে না। অনেক বড় সাজা হবে। সরকার ১০ বছর ক্ষমতায় থাকবে। এ পর্যন্ত সহ্য করলাম। পরে বললেন, টিংকু আর বের হবে না যখন, চলো আমরা বিয়ে করি। বুয়েট পাস একজন মানুষ এতোটা নিষ্ঠুর নষ্ট হতে পারে? অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। তারপর অফিস থেকে বের করে দিলাম।

১০ জানুয়ারি, ২০০৮-এ টিংকুকে ছাড়ার পর পুনরায় নাটকীয়ভাবে এরেস্ট করে জেলে ঢুকালো। এবার টাকার চাপ আরও দ্বিগুণ। কিন্তু আমার পক্ষে টাকা দেওয়া কোন ভাবেই সম্ভব নয়। এপর্যায়ে মইন ইউ আহমেদের সাথে দেখা করতে চাইলাম, কিন্তু টিংকু কিছুতেই রাজি হল না। বলল খবরদার তুমি কারো কাছে যাবে না। শেষ পর্যন্ত ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০০৮-এ ও’ ছাড়া পেল। নতুন করে শুরু হলো মেজর জাকিরের অত্যাচার। দিন নেই রাত নেই আমার মোবাইলে ফোন করে টিংকুকে দেখা করতে বলে। টিংকু দেখা করে এলো।

Tingkuওর প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা। বলল, ‘আর পারছি না’।ভিসা করা ছিল। পরদিন ওকে আমেরিকা পাঠিয়ে দিলাম। দীর্ঘদিন বিদেশ থাকার পর একসময় ও ফিরে এলো। পুরো শরীর চেকআপ করিয়েছে শুধু মাথা ছাড়া। ২০০৮ এর ডিসেম্বরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হলো। দেশে দিন বদলের হাওয়া লেগেছে। দেশের সামনে ‘ভিশন ২০২১’। ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে। কিন্তু ভালো যাছে না টিংকুর শরীরটা। ওর মন মেজাজ চিন্তা-চেতনা কোন কিছুই আগের মত নেই। কেমন একটু এলোমেলো। মাঝে মাঝে ভয় হয়, আবার ভাবি অত বড় একটা ধকল গেছে পরিবর্তন হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু পরিবর্তনটা যে এতো বেশি হয়ে গেছে ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। টর্চার সেলে ওকে যে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে, ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়েছে তার ফলশ্রুতিতে ওর ব্রেইনের কোষ মিউটেশন হয়ে টিউমার, টিউমার থেকে ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে। পরিণাম ওর এই অকাল মৃত্যু। আমি এখন কার শাস্তি চাইব? কার কাছে চাইব? কি অপরাধ ছিল টিংকুর? কেন ওকে বাঁচতে দেওয়া হলো না?

১/১১ তে আমরা যারা বিনা কারণে অত্যাচারিত, অপমানিত, লাঞ্ছিত হয়েছি, নির্যাতিত হয়েছি তাঁরা সমস্বরে বলতে চাই ” বিচার হোক”। কারণ ভুক্তভোগি মাত্রই জানেন এর ভয়াবহতা, দহন কষ্ট আর কান্নার ইতিহাস। ৯ বছর পর নেত্রী যখন মুখ খুলেছেন, আমরা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। যে কোন অন্যায়েরই বিচার হওয়া উচিত। সে সময়ে একমাত্র শেখ হাসিনার সাহসী সিদ্ধান্ত তাঁর অটল অবস্থান ওদের সমস্ত ষড়যন্ত্রের পথ নস্যাৎ করে দিয়েছে। সময় প্রমাণ করেছে দুঃসময়ে তাঁর নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপ সঠিক ছিল। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছেই সবিনয় নিবেদন, ১/১১ র ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ শক্তিগুলোর মুখোশ উন্মোচন করুন। যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে, মানুষের অধিকার হরণ করেছে, চরিত্র হরণ করেছে, জুলুম নির্যাতন করেছে তাদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করুন। আমাদের না বলা কষ্ট ও বেদনার কথা দেশের মানুষ জানুক।

২২ জানুয়ারির একতরফা ক্ষমতা আকড়ে থাকার বিএনপি দলীয় নির্বাচনের বিকল্প ১/১১ হয়তো অনিবার্য ছিল। কিন্তু তারা তো ভোটার তালিকা করে নিরপেক্ষ নির্বাচন দেবে! তবে কেন রাজনীতিবিদদের উপর এমন নির্যাতন আনা হলো? কেন দু’নেত্রীকে মাইনাস করতে চাওয়া হলো? কেন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোর করে টাকা নেয়া হলো? কেনইবা মানুষের সকল গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার হরণ করে রিমান্ড, কারানির্যাতন, আতঙ্ক, ভয়ভীতি ও দেশত্যাগে বাধ্য করা হলো? ১/১১ এর খলনায়কদের বিচার এখন সময়ের দাবি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর