এক যুগে বরাদ্দ বৃদ্ধি ১৬ হাজার শতাংশ রেলে বাড়ছে বরাদ্দ কমছে গতি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ রেলের বরাদ্দ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কিন্তু, বাড়ছে না ট্রেনের গতি ও কাঙ্ক্ষিত সেবার মান। রেলে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে বর্তমান সরকারের সময় অনেক উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তবে বাস্তবায়নে অনিয়ম-দুর্নীতি আর অদক্ষতার কারণে, ফল আসছে না। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথ মেরামতসহ কিছু প্রকল্প বাবদ রেলের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ের পরও কাজ হচ্ছে না। উলটো রেলপথে আরও ঝুঁকি বেড়েছে। আয়ুষ্কাল পার হওয়া ইঞ্জিন ও কোচ বিপদ ডেকে আনছে। ১৫ থেকে ২০ বছর আগে ট্রেনের গতি যেখানে ছিল ঘণ্টায় ৯০ কিমি. বর্তমানে তা ৫৩ কিমি.তে নেমে এসেছে। দুইশর বেশি স্থানে ট্রেনের গতি নেমেছে ১০ কিমি.র নিচে। অথচ সম্প্রতি অত্যাধুনিক ইঞ্জিন ও কোচ আনা হয়েছে ১৩০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানোর জন্য। সেগুলোর কোনোটিই ৬০ কিলোমিটারের উপরে চলছে না।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রের তথ্য, ২০২১-২২ অর্থবছরের রেল বাজেট ১৭ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। আর ২০০৯ সাল থেকে চলতি বাজেট পর্যন্ত মোট বরাদ্দ প্রায় ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। গত প্রায় ১ যুগে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার রেলে বরাদ্দ বাড়িয়েছে ১৬ হাজার ৩৭৫ শতাংশ। একই সঙ্গে আগামী ৩০ বছর ( ২০১৬-৪৫ সাল পর্যন্ত) মেয়াদে ৫ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬২ কোটি টাকার মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এত বিনিয়োগ আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্যে রেল লোকসান গুনে চলেছে। গত ১ যুগে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে গত ২ অর্থবছরেই লোকসানের খাতায় যোগ হয়েছে প্রায় পৌনে চার হাজার কোটি টাকা।

প্রায় ১ যুগে মোট বরাদ্দের অনুকূলে ব্যয়ের চিত্রও হতাশাজনক। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট বরাদ্দের ৪৭.০৬ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫৭.৩৯ শতাংশ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে (মে ২০২১ সাল পর্যন্ত) ৫৯.১১ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে পেরেছে রেল। চলমান ৪১ উন্নয়ন প্রকল্পে মোট বরাদ্দ ১ লাখ ৪২ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। এ টাকার মাত্র ৩২.৪৩ শতাংশ খরচ করা হয়েছে। এছাড়া এসব প্রকল্পের অধিকাংশ সংশোধিত হয়েছে। ১৯টি প্রকল্প অন্তত একবার এবং ৯টি প্রকল্প সংশোধিত হয়েছে একাধিকবার। মেয়াদ বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ানো হয়েছে ব্যয়ও। চলমান ১১টি প্রকল্পে নির্ধারিত সময়ের সঙ্গে ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিক। ২ বছরের কোনো কোনো প্রকল্প এক যুগ ধরে চলছে। আবার এসব প্রকল্পে নির্ধারিত ব্যয়ের চেয়ে গড়ে ৬ গুণ পর্যন্ত ব্যয় বেড়েছে। এত তেলেসমাতির পরও সবকটি প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ২৪.৪৫ শতাংশ। এসব প্রকল্পের বেশিরভাগ অর্থই ভারত, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও আরও কয়েকটি দেশের কাছ থেকে ঋণ হিসাবে নেওয়া হয়েছে।

রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন জানান, ২০০৯ সালের আগে রেলপথ ছিল অবহেলিত। উন্নয়ন নয়- রেলকে ওই সময় ধ্বংস করা হয়েছে। বর্তমান সরকার রেলে ব্যাপক উন্নয়নে কাজ করছে। হাতে নিয়েছে নানা ধরনের প্রকল্প। এগুলোর কাজ শেষ হলে সংস্থাটিতে আমূল পরিবর্তন আসবে। পর্যাপ্ত লাইন না থাকা এবং পুরাতন ইঞ্জিন ও কোচ দিয়ে ট্রেন চালিয়ে কাঙ্ক্ষিত গতি উঠানো সম্ভব হচ্ছে না। আমরা নতুন করে সব লাইন ডুয়েলগেজ ও ডাবল লাইন করছি। মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর করছি। এতে ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চালানো সম্ভব হবে। বরাদ্দ বাড়ছে-একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। রেলে নতুন জেলা যুক্ত হচ্ছে। অনিয়ম-দুর্নীতি বিষয়ে আমি জিরো টলারেন্স। ইতোমধ্যে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে কাউকেই রক্ষা করা হবে না।

গত এক যুগে রেলে ১১৮টি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ইতোমধ্যে ৮১টি প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। যার মধ্যে নতুন রেলপথ নির্মাণসহ নতুন রেলওয়ে স্টেশন ভবন অন্যতম। কিন্তু, বিদ্যমান পুরোনো রেলপথ, রেলওয়ে ব্রিজের অর্ধেকের বেশি জরাজীর্ণ হলেও এসবে নজর দেওয়া হয়নি। প্রায় ৬৭ শতাংশ লেভেলক্রসিং সম্পূর্ণ অবৈধ। এগুলো বন্ধের উদ্যোগ নেই। উলটো বাড়ছে এর সংখ্যা। চলমান রেলপথ, রেলওয়ে ব্রিজ, সিগন্যাল ব্যবস্থা যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনও উপেক্ষিত হচ্ছে। ২৭৮টির মধ্যে ৭৮ শতাংশ ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল শেষ। সব মিলিয়ে রেলের গতি বাড়ানোর মতো কোনো কাজ হয়নি। ফলে উন্নয়নের বিপরীতে জরাজীর্ণ রেলপথে গড়ে ৫৩ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চলছে।

বর্তমানে জরাজীর্ণ লাইন দিয়ে নির্ধারিতের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ট্রেন চলছে খুঁড়িয়ে। অথচ নতুন যাত্রীবাহী কোচ, ইঞ্জিন ১২০ থেকে ১৩০ কিমি. গতিতে চলার কথা। অতিরিক্ত মূল্যে এসব কোচ ও ইঞ্জিন কেনাই হচ্ছে- গতি বাড়িয়ে ট্রেন চালাতে। কিন্তু, বাস্তব গল্পটা পুরোপুরিই উলটে। এখনও শিডিউল বিপর্যয়ের মতো পুরোনা দুর্ভোগ লেগেই আছে।

বর্তমানে রেলে ২৮৮টি ইঞ্জিন রয়েছে। এর মধ্যে মিটারগেজ ১৯৮টি ও ব্রডগেজ ৯০টি। রেলের ইঞ্জিনের সাধারণ আয়ুষ্কাল (ইকোনমিক লাইফ) ধরা হয় ২০ বছর। সে হিসাবে বর্তমানে রেলের ৭৮ শতাংশ ইঞ্জিনই মেয়াদোত্তীর্ণ। স্বাধীনতার আগে কেনা ৯৫টি ইঞ্জিনের বয়সকাল ৪৯ থেকে ৬৯ বছর। চুক্তিভিত্তিক চালক (চালকের বয়স ৭০ বছর) এসব ইঞ্জিন দ্বারা ট্রেন চালাচ্ছেন যেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে।

পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক সরদার শাহাদত আলী যুগান্তরকে জানান, পুরনো ইঞ্জিন-কোচ দিয়ে গতি বাড়ানো সম্ভব নয়। ঘণ্টায় ৫০ থেকে ৬৬ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চালাতে হচ্ছে। অত্যাধুনিক ইঞ্জিন-কোচের সঙ্গে রেলপথ, সিগন্যালিং ব্যবস্থা উন্নয়নসহ বন্ধ স্টেশন চালু করা সম্ভব হলে গতি বাড়বে। অপরদিকে লাইনের পদে পদেই অবৈধ ও প্রহরীবিহীন লেভেল ক্রসিং থাকায় চালক-গার্ড নির্দেশনা অনুযায়ী ট্রেন চালাতেও পারছেন না।

দ্রুত সময়ের মধ্যে জরাজীর্ণ লাইন সংস্কার, চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ সেতু মেরামতসহ নতুন নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্দেশনার তিন বছর পার হলেও যথাযথ সংস্কার হয়নি রেলপথ-সেতু। ক্ষোভ উগরে রেলওয়ে অপারেশন ও ট্রাফিক বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন- রেলওয়ের কোনো উন্নয়নেই তাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। কিন্তু, লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়াতে তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে মন্ত্রণালয়। লোকসান কমাতে বাধ্য হয়েই ট্রেনের ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব দিতে হয় তাদের।

ঢাকা-টঙ্গী-নারায়ণগঞ্জ রেললাইনে প্রতি ৩ থেকে ৪ মিনিট পরপর ট্রেন পরিচালনার জন্য দুটি প্রকল্প (ঢাকা-টঙ্গী ৩য় ও ৪র্থ লেন এবং ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডুয়েলগেজ নির্মাণ) নেওয়া হয়েছিল প্রায় ১৯ বছর আগে। ২-৩ বছরের মধ্যে প্রকল্প দুটি সম্পন্ন করার কথা থাকলেও আজও তা হয়নি। অন্যদিকে মাত্র ৫ বছর আগে টঙ্গী-ভৈরব রেলপথে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার নতুন মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণ হলেও তা ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

রেলওয়ের সাবেক এক মহাপরিচালক জানান, রেলে অধিকাংশ প্রকল্পই রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হয়। যাত্রী বৃদ্ধি, আয়বর্ধক ও লাভজনক বিবেচনায় নাম মাত্র প্রকল্প নেওয়া হয়। গত এক যুগে রেলের ভাড়া দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। আবারও ভাড়া বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু সেবার সঙ্গে গতি বাড়ছে না।

১৮০ কোটি টাকায় ময়মনসিংহের গৌরীপুর থেকে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন সংস্কার করা হয় ২০১৩ সালে। ৭০-৭৫ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চলবে এ লাইনে এমন প্রতিশ্রুতির বদলে বর্তমানে ৩০-৩৫ কিলোমিটার গতিতে চলছে ট্রেন। ২০১৬ সালে শেষ হওয়া টঙ্গী-ভৈরব ডাবল লাইন নির্মাণে বর্তমানে ৬৪ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চলছে। অথচ বলা হয়েছিল এ লাইনে ট্রেন চলবে ৯০ থেকে ১০০ কিলোমিটার গতি নিয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম ৫ ঘণ্টায় আন্তঃনগর ট্রেন চলত। প্রায় ২২ বছর পর এ পথে ট্রেন পৌঁছতে সময় লাগছে প্রায় ৬ ঘণ্টা।

পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে মহাব্যবস্থাপক (জিএম) জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, চলমান প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে গতির সঙ্গে সেবাও বাড়বে। জরাজীর্ণ লাইন সংস্কারে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে মহাব্যবস্থাপক মিহির কান্তি গুহ জানান, রেলবহরে আধুনিক ইঞ্জিন-কোচ যুক্ত হয়েছে। কিন্তু, পশ্চিমাঞ্চল রেলে নির্ধারিতের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ট্রেন চলাচল করছে। এতে গতি বাড়ানোর সঙ্গে সেবা বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।

বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক জানান, বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে কার স্বার্থে। বরাদ্দ বাড়িয়ে যদি গতি বাড়ানো না যায় ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথ-ব্রিজ সংস্কার না হয় তাহলে নতুন প্রকল্প দিয়ে কি হবে। প্রকল্প ঘিরে যে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে সেগুলো চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। রেলে প্রায় প্রতিটি প্রকল্পে মেয়াদ ও ব্যয় বেড়ে যায়! দু-একটি প্রকল্পের মেয়াদ বা ব্যয় বাড়তে পারে। কিন্তু প্রায় সব প্রকল্পেরই যদি একই অবস্থা হয়, তখন বোঝার আর বাকি থাকে না- পুরো প্রক্রিয়াটাতেই গলদ থাকছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর