হাওর বার্তা ডেস্কঃ ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু; এক ও অভিন্ন’—উক্তিটি কেবল আমার কাছে একটা অতি ব্যবহূত মন্তব্য নয়, এই উক্তির পেছনে লুকিয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর ২৩ বছরের স্বাধিকারের সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে উপলব্ধি করি? মুক্তিযুদ্ধ আসলে কী? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি সর্বদা খুঁজি। দীর্ঘ সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু এ দেশের মানুষকে মুক্ত করেছিলেন শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন ও অবহেলা থেকে। শুধু বঙ্গবন্ধুই দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগ স্বীকার করেন নাই; এদেশের বহু মানুষকে স্বাধীনতার জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে গর্বের একটা ইতিহাস, একই সঙ্গে সর্বোচ্চ কষ্টের ও অবিস্মরণীয় কাহিনি। মুক্তিযোদ্ধারা এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। এ কারণেই একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আমি গর্ব বোধ করি।
শোষণ, নিপীড়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে শেখ মুজিবের বলিষ্ঠ প্রতিবাদী কণ্ঠ তাকে বঙ্গবন্ধুতে রূপান্তরিত করেছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শেখ মুজিব কীভাবে এই নিবেদিত, বলিষ্ঠ ও প্রতিবাদী কণ্ঠ ধারণ করলেন? এই বৈশিষ্ট্য কি তিনি জন্মলগ্ন থেকে উত্তরাধিকারী সূত্রে পেয়েছেন? পরিবার থেকে পেয়েছেন? নাকি ধাপে ধাপে ক্রমান্বয়ে এই বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন করেছেন? বঙ্গবন্ধুর প্রেরণার উত্সই-বা কী ছিল? এই বিষয়গুলোতে আজকে আলোকপাত করতে চাই। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর প্রেরণার উৎস একদিকে ছিল তার বাঙালিপনা, অন্যদিকে ছিল শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে মজ্জাগত প্রতিবাদী স্বভাব এবং তার পারিবারিক প্রভাব। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর সমন্বয়ে বঙ্গবন্ধু সময়, বাস্তবতা ও ঘটনাপরম্পরায় বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীর প্রারম্ভে তিনি লিখেছেন, ‘একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তন সম্পৃক্তির উত্স ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’
তিনি বাঙালির দুঃখ-কষ্ট সম্পূর্ণভাবে অনুভব করতেন। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানের ক্ষেত্রে শুধু নিয়োজিত শক্তি নয়, অগ্রদূত হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাঙালির সঙ্গে তার যে বন্ধন সেটা শুধু আবেগতাড়িত বন্ধন নয়, এর পেছনে ছিল বুদ্ধিদীপ্ত অন্তর্দৃষ্টিশীলতা। সেটা বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা থেকে বোঝা যায়। ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুটা দিক আছে। একটা হলো ‘আমরা মুসলমান, আর একটা হলো, আমরা বাঙালি। পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে।
বোধহয় দুনিয়ার কোনো ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, পরশ্রীকাতরতা। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সব রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ার খুব কমসংখ্যক দেশে আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজেকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।’ (পৃষ্ঠা ৪৭-৪৮, অসমাপ্ত আত্মজীবনী)। যদিও এখানে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে একধরনের ক্ষোভের অথবা অভিমানের সুর ধ্বনিত হয়, বাঙালির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে তার যে বিশ্লেষণ তা অত্যন্ত পরিণত এবং যুক্তিপূর্ণ। একজন দার্শনিকের মতো তিনি বাঙালির সমস্যার মূল চিহ্নিত করেছেন এবং সমস্যার সমাধানও দিয়েছেন। বাঙালির চরিত্র সম্বন্ধে তার উপলব্ধি, বাঙালি সম্বন্ধে তার জ্ঞান, তার প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টি, বাঙালির সঙ্গে তার নৈকট্যেরও প্রমাণ বহন করে।
বঙ্গবন্ধু যেই সমস্যার কথা বলছেন তা আমাদের সমকালীন সমস্যা। বঙ্গবন্ধু সেই যুগের হয়ে এই সময়ের সমস্যার কথা বলছেন। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু সব সময় প্রাসঙ্গিক, সর্বজনীন ও সমগ্র বাংলার মানুষের কাছে চিরন্তন মুজিব। অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অবলাকেন করে তরুণ মুজিব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন কীভাবে এদেশের মানুষ ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে আসছে যুগে যুগে। বাঙালি জাতি এদের প্রতারণার শিকার হওয়ার যে করুণ ইতিহাস, সেটা অনেক পুরোনো ইতিহাস। অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল মুজিবের কণ্ঠে ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদী অবস্থান, তা বর্তমান প্রজন্মের জন্য শুধু প্রাসঙ্গিক নয়, শিক্ষণীয়ও বটে। সুতরাং বাঙালিত্বের প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে প্রেম, সেটা একতরফা বা পক্ষপাতপূর্ণ আসক্তি না, সেটা অত্যন্ত যৌক্তিক, গঠনমূলক, বস্তুনিষ্ঠ এবং বৈজ্ঞানিক। একই সঙ্গে, বঙ্গবন্ধুর মধ্যে সর্বদা রাজনীতি করার একটা অসাধারণ অদম্য চালিকাশক্তি কাজ করেছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ছাত্রনেতা হিসেবে তার অবদান এই ধারণা সমর্থন করে। সহপাঠীদের উদ্দেশ্য তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘তোমরা পণ্ডিত হও, আমার অনেক কাজ। আগে পাকিস্তান আসতে দাও, তারপর বসে বসে আলোচনা করা যাবে।’ (পৃষ্ঠা ৪১, অসমাপ্ত আত্মজীবনী)
একটা বিষয় পরিষ্কার, যে লক্ষ্য অর্জনে শেখ মুজিব ছিলেন অবিচল। সেই লক্ষ্য যদি দুঃখী মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য হয় সেক্ষেত্রে তিনি জীবন দিতে পারতেন।
একজন অধ্যয়নশীল, স্বাধীনচেতা এবং দূরদর্শিতাসম্পন্ন ছাত্রনেতারই পরিচয় পাওয়া যায় ওপরের চিত্র থেকে। একদিকে যখন হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা, অন্যদিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির কবলে দেশ, তথা সমগ্র ভারতবর্ষ, ঠিক তখন মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ ও দুঃখ-কষ্ট তরুণ মুজিবকে উতলা করে ফেলে। সার্বিকভাবে মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করার একটা সহজাত প্রবৃত্তি তরুণ বয়স থেকেই তার মাথায় জেঁকে বসেছিল। পরাধীনতার কবল থেকে মানুষকে মুক্ত করার ব্যাপারে তরুণ বয়স থেকেই সংকল্পবদ্ধ ছিলেন শেখ মুজিব। আর একটা বিষয় লক্ষণীয়, তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থ, যেমন পড়ালেখা, চাকরি-বাকরি ইত্যাদি থেকে রাজনৈতিক কর্মকে, তথা গণমানুষের স্বার্থকে সর্বদা প্রাধান্য দিয়েছেন। ‘আগে পাকিস্তান আসতে দাও, তারপর বসে বসে আলোচনা করা যাবে’ শুধু তার পরোপকারী মনোভাব ব্যক্ত করে না, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, তথা পাকিস্তান সৃষ্টির সংগ্রামে তার আদর্শিক অবস্থান পরিষ্কার করে।
আরেকটা দিক হলো, পারিবারিকভাবে শেখ মুজিব একধরনের উত্সাহ পেতেন। বিশেষ করে, তার পিতা শেখ লুত্ফর রহমান বিভিন্ন সময় শেখ মুজিবের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা করতেন ও পরামর্শও দিতেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে শেখ মুজিব লিখেছেন, “আব্বা আমাকে…একটা কথা বলেছিলেন, ‘বাবা রাজনীতি করো আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছো এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না।’ আর একটা কথা ‘sincerity of purpose and honesty of purpose’… কোনো দিন আমি ভুলি নাই।” সত্যি বঙ্গবন্ধু পিতার উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে মনে রেখেছেন এবং পালন করেছেন। লক্ষ্য অর্জনে তিনি সর্বদা অবিচল ছিলেন এবং কখনো আপস করেন নাই, যেটা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। এখান থেকে বোঝা যায় তার দৃঢ়তার উত্স কোথায়। আর একটা বিষয় পরিষ্কার যে, শেখ মুজিবের পিতা রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলেন এবং রাজনৈতিক জ্ঞান রাখতেন এবং ছেলেকে রাজনৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ করতেন।
নিজ ছেলে সম্বন্ধে শেখ লুত্ফর রহমানের আর একটা উক্তি খুবই প্রাসঙ্গিক :‘দেশের কাজ করছে, অন্যায় তো করছে না, যদি জেল খাটতে হয়, খাটবে; তাতে আমি দুঃখ পাব না…আমি ওর কাজে বাধা দিব না। আমার মনে হয়, পাকিস্তান না আনতে পারলে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না।’ এছাড়া শেখ মুজিব নিজে বলেছেন, ‘অনেক সময় আব্বা আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা করতেন। আমাকে প্রশ্ন করতেন, কেন পাকিস্তান চাই? আমি আবার কথার উত্তর দিতাম।’ এ থেকে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধুর নিজের যেমন প্রবল আগ্রহ ছিল, মানবদরদি একটা মনন ছিল, একই সঙ্গে প্রেরণা দেওয়ার মতো একজন অভিভাবকও তার ছিল। তার পিতা শেখ লুত্ফর রহমানের বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রভাব ছিল। তবে এ কথা আমরা সবাই জানি যে, শেখ মুজিবের রাজনৈতিক অভিভাবক ছিলেন জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব। যেটা আরেকটি বড় লেখার অনুষঙ্গ হতে পারে। পরিশেষে, আমরা দেখতে পাই, মূলত তিনটি বিষয় বঙ্গবন্ধুর আসাধারণ রাজনৈতিক প্রেরণার পেছনে ভূমিকা রেখেছে: ১) বঙ্গবন্ধুর বাঙালিত্ব, ২) শোষিত-বঞ্চিত মানুষের প্রতি তার নৈতিক, যৌক্তিক ও নিরপেক্ষ দায়বদ্ধতা। যে দায়বদ্ধতা তিনি পালন করেছেন মেধাসম্পন্ন, প্রগতিশীল এবং প্রজ্ঞাশীল রাজনীতির মধ্য দিয়ে। ৩) তার পারিবারিক শিক্ষা, বিশেষ করে পিতা শেখ লুত্ফর রহমানের অনুপ্রেরণা। এই তিনটি চালিকাশক্তির কাঁধে ভর করে তরুণ মুজিব ধাবিত হয়েছিল মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। যেই লক্ষ্য থেকে তাকে কোনো শক্তি বা শাসকগোষ্ঠী কোনো দিন বিচ্যুত করতে পারেনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাঙালির অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তির জন্য কাজ করে গেছেন। বাঙালিকে ভালোবেসেছেন এবং বাঙালির উন্নতির কথা ভেবেছেন।
পরিশেষে আশা ব্যক্ত করতে চাই যে, আমাদের নতুন প্রজন্মের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে হবে এবং একই সঙ্গে শুধু দেশপ্রেমী নয়, বাঙালি সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অনুরাগী হতে হবে। শুধু আবেগনির্ভর রাজনীতি নয়, নৈতিক ও যুক্তিশীল রাজনীতি করতে হবে। একই সঙ্গে বাঙালি মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে নিজেকে জানতে হবে এবং আত্মসমালোচনাও করতে হবে। কেবল তাহলেই মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের সম্মান আমরা দিতে পারব। ভুলে গেলে চলবে না, এদেশ সহজে স্বাধীন হয় নাই, বহু বাঙালির মা-বাবা, ভাইবোনদের রক্তের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল। এই বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের সচেতন থাকতে হবে এবং একই সঙ্গে দায়িত্বশীল হতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মৌলবাদী ধর্মান্ধতা এবং অশিক্ষা-কুশিক্ষা, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে প্রতিহত করে একটি প্রগতিশীল বিজ্ঞানভিত্তিক, গঠনমূলক রাজনৈতিক পথ তরুণ প্রজন্মকে বেছে নিতে হবে।