ঢাকা ০৬:৪০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হারিয়ে যাওয়া দেশীয় ঢেলা মাছ ফিরছে বাজারে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:০৭:০৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২১
  • ২৩০ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ছোটবেলায় চোখের অসুখ হলে মলা-ঢেলা খাওয়ার পরামর্শ শোনেননি এমন মানুষ বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। মলা এখনো কিছুটা পাওয়া গেলেও বিলুপ্তপ্রায় ঢেলা মাছ এখন বাজারে বিরল। তবে সুখবর হলো, সেই ঢেলা মাছ ফিরছে বাজারে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পুষ্টিসমৃদ্ধ ও বিলুপ্তপ্রায় ঢেলা মাছের পোনা উত্পাদনে সফলতা অর্জন করেছে। ইনস্টিটিউটের ময়মনসিংহের স্বাদুপানি গবেষণা কেন্দ্রে গত দুই বছর ধরে গবেষণা পরিচালনা করা হয়। গবেষক দলে ছিলেন কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এইচ এম কোহিনুর, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শাহা আলী, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সেলিনা ইয়াসমিন ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রবিউল আওয়াল।

বিএফআরআই সূত্র জানায়, স্থানীয় ব্রহ্মপুত্র নদসহ বিভিন্ন উত্স থেকে ঢেলা মাছের পোনা সংগ্রহ করে কেন্দ্রের পুকুরে তা নিবিড়ভাবে প্রতিপালন করা হয়। এ সময় তাদের খাদ্যাভ্যাস পরীক্ষা করা হয় এবং সে অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করা হয়। তাছাড়া বছরব্যাপী জিএসআই ও হিস্টোলজি পরীক্ষণের মাধ্যমে এর সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ করা হয়। হিস্টোলজি পরীক্ষাকালে দেখা যায়, ঢেলা মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম হচ্ছে মে-জুন মাস। তবে এপ্রিল মাসের শেষের দিক থেকে এর প্রজননকাল শুরু হয়। ঢেলা মাছের ডিম ধারণক্ষমতা হচ্ছে প্রতি গ্রামে ৭০০ থেকে ৮০০টি।

গবেষণাকালে দেখা যায়, একটি স্ত্রী ঢেলা প্রায় ছয় থেকে আট গ্রাম ওজনের হলেই প্রজনন উপযোগী হয়। প্রজনন উপযোগী পুরুষ ঢেলা আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট চার থেকে পাঁচ গ্রাম হয়। প্রকৃতিতে স্ত্রী ঢেলার চেয়ে পুরুষ ঢেলা অপেক্ষাকৃত কম পাওয়া যায়। বিভিন্ন উত্স থেকে ঢেলা মাছ সংগ্রহকালে দেখা গেছে, প্রকৃতিতে স্ত্রী ও পুরুষ ঢেলা প্রাপ্তির অনুপাত হচ্ছে ৪ :১ অর্থাত্ চারটি স্ত্রী ঢেলার সঙ্গে মাত্র একটি পুরুষ ঢেলা থাকে।

এই গবেষণায় ১০ জোড়া ঢেলা মাছকে হরমোন প্রয়োগ করা হয়। হরমোন প্রয়োগের আট থেকে ৯ ঘণ্টা পর ডিম ছাড়ে এবং ২২ ঘণ্টা পরে নিষিক্ত ডিম থেকে রেণু পোনা উত্পাদিত হয়। এ সময় ডিম নিষিক্ততার পরিমাণ ছিল প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ। উত্পাদিত পোনা বর্তমানে ইনস্টিটিউটের হ্যাচারিতে প্রতিপালন করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, একসময় দেশের নদ-নদী ও হাওর-বিলে প্রচুর পরিমাণে ঢেলা মাছ পাওয়া যেত। পরবর্তী সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন, অতি আহরণ ও জলাশয় সংকোচনের কারণে ঢেলা মাছের প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র বিনষ্ট হয়ে যায় এবং এ মাছটি বিলুপ্তির তালিকায় চলে আসে। ফলে ঢেলামাছ এখন প্রায় দুষ্প্রাপ্য এবং উচ্চমূল্যে বাজারে বিক্রি হয়। ইনস্টিটিউটে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উত্পাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ায় ঢেলা মাছ সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে এবং চাষের মাধ্যমে এর উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

এ প্রসঙ্গে ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, এখন ঢেলা মাছ পাওয়া যায় না বললেই চলে। পুষ্টিসমৃদ্ধ ঢেলা মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উত্পাদন কৌশল উদ্ভাবিত হওয়ায় মাঠপর্যায়ে এর পোনা উত্পাদন ও প্রাপ্যতা সহজতর হবে। ফলে ঢেলা মাছকে সহজেই এখন চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অন্যান্য দেশীয় মাছের তুলনায় ঢেলা মাছে প্রচুর খনিজ পদার্থ আছে। প্রতি ১০০ গ্রাম ঢেলা মাছে ভিটামিন ‘এ’ ৯৩৭ আইইউ, ক্যালসিয়াম ১২৬০ মিলিগ্রাম এবং জিঙ্ক ১৩.৬০ শতাংশ, যা অন্যান্য দেশীয় মাছের তুলনায় অনেক বেশি। তিনি বলেন, ভিটামিন এ শিশুদের রাতকানা রোগ থেকে রক্ষা করে, ক্যালসিয়াম হাড় গঠনে সহায়তা করে। তাছাড়া জিঙ্ক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, যা করোনাকালীন খুবই উপযোগী।

এর আগে বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণা পরিচালনা করে পাবদা, গুলশা, টেংরা, বৈরালীসহ ২৪টি দেশীয় ও বিলুপ্তপ্রায় মিঠা পানির মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবন করেছে। ফলে এসব মাছের উত্পাদন ও প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে পিয়ালী, কাজলী, বাতাসি, কাকিলা, রানি ও গাং টেংরাসহ আরো ১০টি মাছ নিয়ে গবেষণা চলছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

হারিয়ে যাওয়া দেশীয় ঢেলা মাছ ফিরছে বাজারে

আপডেট টাইম : ১১:০৭:০৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২১

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ছোটবেলায় চোখের অসুখ হলে মলা-ঢেলা খাওয়ার পরামর্শ শোনেননি এমন মানুষ বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। মলা এখনো কিছুটা পাওয়া গেলেও বিলুপ্তপ্রায় ঢেলা মাছ এখন বাজারে বিরল। তবে সুখবর হলো, সেই ঢেলা মাছ ফিরছে বাজারে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পুষ্টিসমৃদ্ধ ও বিলুপ্তপ্রায় ঢেলা মাছের পোনা উত্পাদনে সফলতা অর্জন করেছে। ইনস্টিটিউটের ময়মনসিংহের স্বাদুপানি গবেষণা কেন্দ্রে গত দুই বছর ধরে গবেষণা পরিচালনা করা হয়। গবেষক দলে ছিলেন কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এইচ এম কোহিনুর, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শাহা আলী, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সেলিনা ইয়াসমিন ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রবিউল আওয়াল।

বিএফআরআই সূত্র জানায়, স্থানীয় ব্রহ্মপুত্র নদসহ বিভিন্ন উত্স থেকে ঢেলা মাছের পোনা সংগ্রহ করে কেন্দ্রের পুকুরে তা নিবিড়ভাবে প্রতিপালন করা হয়। এ সময় তাদের খাদ্যাভ্যাস পরীক্ষা করা হয় এবং সে অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করা হয়। তাছাড়া বছরব্যাপী জিএসআই ও হিস্টোলজি পরীক্ষণের মাধ্যমে এর সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ করা হয়। হিস্টোলজি পরীক্ষাকালে দেখা যায়, ঢেলা মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম হচ্ছে মে-জুন মাস। তবে এপ্রিল মাসের শেষের দিক থেকে এর প্রজননকাল শুরু হয়। ঢেলা মাছের ডিম ধারণক্ষমতা হচ্ছে প্রতি গ্রামে ৭০০ থেকে ৮০০টি।

গবেষণাকালে দেখা যায়, একটি স্ত্রী ঢেলা প্রায় ছয় থেকে আট গ্রাম ওজনের হলেই প্রজনন উপযোগী হয়। প্রজনন উপযোগী পুরুষ ঢেলা আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট চার থেকে পাঁচ গ্রাম হয়। প্রকৃতিতে স্ত্রী ঢেলার চেয়ে পুরুষ ঢেলা অপেক্ষাকৃত কম পাওয়া যায়। বিভিন্ন উত্স থেকে ঢেলা মাছ সংগ্রহকালে দেখা গেছে, প্রকৃতিতে স্ত্রী ও পুরুষ ঢেলা প্রাপ্তির অনুপাত হচ্ছে ৪ :১ অর্থাত্ চারটি স্ত্রী ঢেলার সঙ্গে মাত্র একটি পুরুষ ঢেলা থাকে।

এই গবেষণায় ১০ জোড়া ঢেলা মাছকে হরমোন প্রয়োগ করা হয়। হরমোন প্রয়োগের আট থেকে ৯ ঘণ্টা পর ডিম ছাড়ে এবং ২২ ঘণ্টা পরে নিষিক্ত ডিম থেকে রেণু পোনা উত্পাদিত হয়। এ সময় ডিম নিষিক্ততার পরিমাণ ছিল প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ। উত্পাদিত পোনা বর্তমানে ইনস্টিটিউটের হ্যাচারিতে প্রতিপালন করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, একসময় দেশের নদ-নদী ও হাওর-বিলে প্রচুর পরিমাণে ঢেলা মাছ পাওয়া যেত। পরবর্তী সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন, অতি আহরণ ও জলাশয় সংকোচনের কারণে ঢেলা মাছের প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র বিনষ্ট হয়ে যায় এবং এ মাছটি বিলুপ্তির তালিকায় চলে আসে। ফলে ঢেলামাছ এখন প্রায় দুষ্প্রাপ্য এবং উচ্চমূল্যে বাজারে বিক্রি হয়। ইনস্টিটিউটে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উত্পাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ায় ঢেলা মাছ সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে এবং চাষের মাধ্যমে এর উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

এ প্রসঙ্গে ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, এখন ঢেলা মাছ পাওয়া যায় না বললেই চলে। পুষ্টিসমৃদ্ধ ঢেলা মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উত্পাদন কৌশল উদ্ভাবিত হওয়ায় মাঠপর্যায়ে এর পোনা উত্পাদন ও প্রাপ্যতা সহজতর হবে। ফলে ঢেলা মাছকে সহজেই এখন চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অন্যান্য দেশীয় মাছের তুলনায় ঢেলা মাছে প্রচুর খনিজ পদার্থ আছে। প্রতি ১০০ গ্রাম ঢেলা মাছে ভিটামিন ‘এ’ ৯৩৭ আইইউ, ক্যালসিয়াম ১২৬০ মিলিগ্রাম এবং জিঙ্ক ১৩.৬০ শতাংশ, যা অন্যান্য দেশীয় মাছের তুলনায় অনেক বেশি। তিনি বলেন, ভিটামিন এ শিশুদের রাতকানা রোগ থেকে রক্ষা করে, ক্যালসিয়াম হাড় গঠনে সহায়তা করে। তাছাড়া জিঙ্ক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, যা করোনাকালীন খুবই উপযোগী।

এর আগে বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণা পরিচালনা করে পাবদা, গুলশা, টেংরা, বৈরালীসহ ২৪টি দেশীয় ও বিলুপ্তপ্রায় মিঠা পানির মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবন করেছে। ফলে এসব মাছের উত্পাদন ও প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে পিয়ালী, কাজলী, বাতাসি, কাকিলা, রানি ও গাং টেংরাসহ আরো ১০টি মাছ নিয়ে গবেষণা চলছে।