হাওর বার্তা ডেস্কঃ মাদকের বিরুদ্ধে বরাবরই কঠোর অবস্থানে সরকার। তবুও নানা কৌশলে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে মাদক। ফলে সব শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষের নাগালে মাদক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারিতেও থামানো যাচ্ছে না মাদক কারবারিদের। নিয়মিত মাদক কারবারিদের সঙ্গে যোগ হয়েছে মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও। এক সময় ফেনসিডিলের ব্যাপক ব্যবহার থাকলেও সেই স্থান দখল করেছে ইয়াবা।
অন্যদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে দেশে ৪০ লাখ মাদকাসক্তের মধ্যে ৪ লাখ নারী। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৯১ শতাংশ কিশোর ও তরুণ, ৪৫ শতাংশ বেকার, ৬৫ শতাংশ আন্ডার গ্য্রাজুয়েট এবং ১৫ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত।
মাদকের বিরুদ্ধে প্রায় দুই বছর আগে ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করে সরকার। সেই সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদক কারবারিদের সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটে। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবমতে, ২০১৮ সালের ১৫ মে থেকে একই বছরের ১৬ জুলাই পর্যন্ত মাদকবিরোধী অভিযানে ২০২ জন নিহত হয়। সরকারের এমন কঠোর অবস্থানের পর কিছুদিন মাদকের বিস্তার কমলেও আবারো বেড়েছে। এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় ইয়াবা। ইয়াবা শুধু বাইরে থেকেই আসছে না, দেশের ভেতরেও তৈরি হচ্ছে বলে সন্দেহ করছে গোয়েন্দারা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা শাখার এক কর্মকর্তা জানান, সাধারণত মিয়ানমার থেকে ইয়াবা বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও দেশেই সংক্ষিপ্ত পরিসরে ইয়াবা তৈরি হচ্ছে বলে সন্দেহ করছেন তারা। এ ধরনের কিছু যন্ত্রাংশও র্যাব আটকও করেছে। মিয়ানমারের ইয়াবা নকল করে দেশেও তৈরি হচ্ছে বলে জানান তিনি। সীমান্তবর্তী দেশ থেকে প্রায় ২৫ প্রকার মাদক বাংলাদেশে আসে। এগুলোর মধ্যে ফেন্সিডিল, ইয়াবা, ম্যান্ডেলা মদ, ম্যান্ডেলা বিয়ার, হিরো হুইস্কি, গ্র্যান্ড রয়েল হুইস্কি, লন্ডন রাম, টাইগার রাম, ম্যান্ডেলা রাম, আন্দামান গোল্ড বিয়ার, রয়েল ডিস্টিলারি, বস আপ, রেড হর্স ডিস্টিলারি, জিনস মদ, অরেঞ্জ মদ ও বাংলা মদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেওয়া তথ্যমতে, ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তের ১৫৩টি এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য ঢুকছে। ইয়াবা আসছে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে। ভারত থেকে আসছে ফেনসিডিল এবং গাঁজা। এ ছাড়া যশোর সীমান্ত দিয়ে পণ্যবাহী যানবাহনে আসছে হেরোইন।
প্রতিদিনই মাদক ব্যবসার সাথে নতুন নতুন লোকজন জড়িত হচ্ছে। লাভজনক হওয়ায় তারা অন্য ব্যবসার পাশাপাশি এ ব্যবসায়ও জড়িয়ে পড়ছে।
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, রাজধানীর নামকরা অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মাদকের দিকে ঝুঁকছেন। মতিঝিল এজিবি কলোনির নির্দিষ্ট কিছু স্থানে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত কিশোর বয়সি ছেলেরা ইয়াবা সেবন করে বলে স্থানীয় একটি সূত্র জানায়। দেশে মাদকের বিস্তার ঘটেছে ব্যাপকহারে। পুরনো মাদকের সাথে যোগ হয়েছে অনেক নতুন নাম। মাদক বহন ও পাচারে ব্যবহার হচ্ছে নিত্যনতুন কৌশল। বেড়েছে মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের সংখ্যাও। সেই সঙ্গে মাদক সংক্রান্ত মামলার সংখ্যাও বেড়েছে। শুধু পরিবর্তন হয়নি মাদকের বিস্তার রোধে সম্পৃক্ত গোয়েন্দাদের সংখ্যা।
মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রতিষ্ঠান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা শাখাটি চলছে ২২ বছর পূর্বের জনবল কাঠামো দিয়ে। ঢাকা বিভাগের ১৭টি জেলায় অবৈধ মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য গোয়েন্দা ইউনিটের বর্তমান জনবল মাত্র ১০ জন। গোয়েন্দা টিমের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অবৈধ মালামাল তল্লাশি করার অত্যাধুনিক যন্ত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে না থাকায় অনেক সহজে মাদক রাজধানীতে প্রবেশ করে। এছাড়া মাদক উদ্ধারে এখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সোর্স নির্ভর করতে হচ্ছে। অনেক সময় সোর্সের দেওয়া তথ্যও ভুল থাকে। ফলে তল্লাশি করতে গিয়ে নানা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মানজারুল ইসলাম (ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ) বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের অবস্থান খুবই কঠোর। অধিদপ্তরের প্রতিটি টিম প্রায় প্রতিদিনই মাদকসহ আসামি গ্রেপ্তার করছে। মাদক ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়ত তাদের কৌশল বদল করছে। এখন ঢাকা শহরে কোথাও মাদকের নির্দিষ্ট স্পট নেই। মাদক ক্রেতা-বিক্রেতারা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় করছে। এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে বলে জানান তিনি।
মাদকের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থানের ফলে মাঝেমধ্যে কোণঠাসা হয়ে পড়ে কারবারিরা। ওই সময়ে দেখা দেয় মাদকের দুষ্প্রাপ্যতা। তখন বিস্তার ঘটে ভেজাল মাদকের। এক বোতল মদ বা ফেনসিডিল দিয়ে কয়েক বোতল মদ/ফেনসিডিল তৈরি হয়। ইয়াবার পরিবর্তে হিস্টাসিন ট্যাবলেটে লাল রং লাগিয়ে এবং ইয়াবার মতো দেখতে হওয়ায় ক্লোফেনাক ট্যাবলেটকেও ইয়াবা বলে বিক্রি হচ্ছে।
তিন বছর আগে জাতিসংঘের এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কমপক্ষে ৬৫ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত। এর মধ্যে ৮৭ শতাংশ পুরুষ আর নারী ১৩ শতাংশ। মাদকাসক্ত নারীদের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। আর ৮৪ শতাংশ পুরুষ মাদকাসক্তের মধ্যে ৮০ শতাংশ যুবক। তাদের ৪৩ শতাংশ বেকার। ৫০ শতাংশ অপরাধের সঙ্গে জড়িত। সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী, শিশু ও কিশোররা মাদক ব্যবসায় জড়িত।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের হেড অব সাইকোথেরাপি ও একাডেমিক কোর্স ডিরেক্টের অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল তার এক লেখায় বলেছেন, বেসরকারি জরিপ অনুযায়ী দেশে মাদকাসক্তদের সংখ্যা ৭০ থেকে ৯০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদের মধ্যে প্রায় ৯১ শতাংশ কিশোর ও যুবক।
অন্যদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে দেশে ৪০ লাখ মাদকাসক্তের মধ্যে ৪ লাখ নারী। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৯১ শতাংশ কিশোর ও তরুণ, ৪৫ শতাংশ বেকার, ৬৫ শতাংশ আন্ডার গ্য্রাজুয়েট এবং ১৫ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত।
আবার বাংলাদেশ মাদকবিরোধী সংস্থা (মানস)’র এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখ। এর মধ্যে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা ১৬ শতাংশ। মানসের ওই পরিসংখ্যানে আরো উল্লেখ করা হয়, ৫ বছর পূর্বে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা ছিল ৫ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ২০ দশমিক ৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ মাদক উৎপাদন হয় না। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে মাদক দেশে প্রবেশ করছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ভৌগোলিকভাবে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল (মিয়ানমার, লাউস, থাইল্যান্ড), হোল্ডেন ক্রিসেন(আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান) ও গোল্ডেন ওয়েজ (নেপাল, ভুটান, তিব্বত) এই তিন মাদকবলয়ের ভেতর বাংলাদেশের অবস্থান। তাই মাদক ট্রাফিকিং রুট হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ৩২ জেলা ও ১৩২টি উপজেলার সাথে ভারতের সীমান্ত রয়েছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী টেকনাফ উপজেলার নাফ নদীর জাদিরমুরা পয়েন্ট থেকে শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার ইয়াবা পাচারের জন্য সর্বাধিক ব্যবহূত ক্রসিং পয়েন্ট।