ধুমপান বিষয়ে নীতিগত প্রশ্ন

জাহেদ সরওয়ার

‘ধুমপানে বিষপান’ মাঝে মাঝেই সরকারি বেসরকারি তরফ থেকে এই স্লোগান দেয়া হয়। সরকারীভাবে ধুমপান বন্ধ করার বিভিন্নরকম উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু ধুমপান কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স বাতিল করার সিদ্ধান্ত কখনো নেয়া হয় না। আমরা যখন সিনেমা দেখি। সিনেমায় ধুমপান বা মদ্যপান করলে সাথে সাথে লেখা আসে। ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর। নিয়মিত ধুমপানে ক্যান্সার, হাটঅ্যাটাকসহ আরো অনেক রোগ হয়।ধুকে ধুকে মারা যায় মানুষ। কিন্তু টোবাকো কোম্পানির বিরুদ্ধে কখনো মামলা হয় না। টোবাকো কোম্পানি নিকোটিন আসক্ত মানুষগুলো চিকিৎসার ভার বহন করতে কখনো শোনা যায় না। অন্যদিকে একটা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের জানমাল রক্ষা করা।কিন্তু সেই রাষ্ট্রেই টোবাকো কোম্পানি রাষ্ট্রিয় ছাড়পত্র নিয়েই এই গণহত্যার ব্যবসা করে। এতবেশি মানুষ ধুমপান আসক্ত যে এটা একটা বিশাল ইন্ডাস্ট্রি বিশ্বজুড়ে।এখন রাষ্ট্রিয়ভাবে ধুমপান বিরোধী স্লোগানের বদলে রাষ্ট্রতো ইচ্ছে করলে নিজে এইধরণের জানহানিকর ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল করতে পারে।কিন্তু পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রইতো আসলে তা করে না।রাষ্ট্রপক্ষ থেকে একটা যুক্তি মাঝে মাঝে শোনা যায় যে তামাক উৎপাদন বা সিগ্রেট প্রস্তুতকারী ইন্ডাস্ট্রির সাথে হাজার হাজার শ্রমিক জড়িত। এবার প্রায় ৯০ জন সাংসদ তামাকের ওপর কর বৃদ্ধি না করতে লিখিতভাবে জানিয়েছেন। কারণ অনেক সাংসদের এলাকায় সাধারণ মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। এটার মাধ্যমে তাদের ভরণপোষণ হয়।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে হাজার হাজার শ্রমিক তামাক উৎপাদন করে বাঁচে আর কোটি কোটি মানুষ সেই তামাক খেয়ে মরে, পরিবারকে সবশান্ত করে এখন ন্যায়ের প্রশ্নে কোনটা এগিয়ে থাকবে? “তামাক ব্যবহারের পরিণতি হিসেবে প্রতিবছর বাংলাদেশে ৩০ বছরের বেশি বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৫৭ হাজার লোক মারা যায়। তামাক পাতা শুকানোর কাজে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবছর হাজার হাজার মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে তামাক চুল্লিতে। আর এসব কাঠের যোগান দিতে গিয়ে উজাড় হচ্ছে বন। গত মৌসুমে শুধু বান্দরবান জেলায় ৬ হাজারেরও বেশি তামাক চুল্লি নির্মাণ করা হয়েছিল। শুধু খাগড়াছড়ি জেলার তামাক চুল্লিতে বছরে ১ লাখ মণ কাঠ পোড়ানো হয়।
invincible416_1267516610_2-Top-45-Creative-Anti-Smoking-Advertisements-001অতিরিক্ত সারের ব্যবহারের কারণে তামাক চাষে মাটির ব্যাপক ক্ষতি হয়। কারণ ধানের চেয়ে তামাক চাষে ৩ গুণ বেশি ইউরিয়া সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। তামাক চাষের জন্য একটি জমি ২ থেকে ৩ বার ব্যবহার করা যায়। তারপর এই জমিতে আর ভাল তামাক হয় না এবং অন্যান্য ফসলের ফলনও ব্যাপকভাবে কমে যায়। এছাড়া তামাকপাতা বিক্রির মৌসুমে দেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলার প্রায় সব স্কুলে বসে তামাকের হাট। বান্দরবান জেলার বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (লামা উপজেলার লাইনঝিরি দাখিল মাদ্রাসার দুই শ’ গজের মধ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, লামামুখ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে ঢাকা টোব্যাকো, লাইনঝিরি বাজারসংলগ্ন আবুল খায়ের টোব্যাকো কোম্পানির বায়িং হাউস) আশপাশে তামাক কোম্পানির বায়িং হাউস থাকায় শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট হয় প্রতিনিয়ত। অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পান না স্থানীয়রা।

চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে দীর্ঘসময় যুক্ত থাকার কারণে গোটা কৃষক পরিবারই বছরের অধিকাংশ সময় শ্বাস-প্রশ্বাস, ত্বক, ফুসফুস ও দেহের বিভিন্ন অঙ্গে দুরারোগ্য ব্যাধি ছাড়াও দৈনন্দিন মাথা ঝিম ঝিম করা, বমি বমি ভাব, বুক ধড়ফড় করা, কোমর ব্যথা, হাঁটু ব্যথা, চোখ জ্বালাপোড়া, মেরুদন্ড ব্যথা, গ্যাস্ট্রিক, ক্ষুধা মন্দা ইত্যাদি অসুখে ভোগেন। পাশাপাশি শিশু-কিশোররা গ্রীন টোব্যাকো সিনড্রোম রোগে আক্রান্ত হয়, ফলে দেশব্যাপী হাজার হাজার তামাক চাষী বিশেষত নারী ও শিশু-কিশোর ব্যাপক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে জীবনযাপন করছে।

এমনিতেই প্রচুর মুনাফা, সঙ্গে কোটি কোটি টাকার কর ফাঁকির কারণে ফুলে ফেঁপে উঠছে তামাক কোম্পানিগুলো। ফলে একদিকে তামাকের বিরুদ্ধে আন্দোলন নস্যাতের চেষ্টা অন্যদিকে কম ক্ষতিকর লাইট, লো, মাইল্ড, ফিল্টার ইত্যাদি বিভ্রান্তকর তথ্য প্রচারের মাধ্যমে খরচ করছে কোটি কোটি টাকা। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত তামাকের বিষে কম বেশি করার সুযোগ নেই। পাতার রঙ যতই সবুজ হোক না কেন, এর অদ্যন্ত বিষে ভরপুর এবং সবসময়ের জন্যই সমান বিষ। তারপরও বাংলাদেশে বেড়েই চলছে ভয়াবহ এই বিষের চাষ ও তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার। মূলত বিড়ি, সিগারেট, জর্দ্দা, গুল ও সাদা পাতার মাধ্যমে তামাকজাত পণ্য সেবন করছে ৪ কোটিরও বেশি মানুষ। বাসা-বাড়ি, অফিস আদালতসহ বিভিন্ন স্থানে বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ায় পাশের মানুষটিও ধূমপান না করেও সেকেন্ড হ্যান্ড ধূমপানের শিকার হচ্ছেন, বিশেষ করে নারী ও শিশুরা। ফলে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ মিলিয়ে ধূমপায়ীর সংখ্যা ৮ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। যা বাংলাদেশের মতো জনবহুল ও স্বল্পোন্নত দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের-উৎকণ্ঠার-দুঃশ্চিন্তার। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে ডেকে আনবে মারাত্মক বিপর্যয়।

মাঝে মাঝে পত্রিকায় দেখা যায় আকিজ বিড়ির মালিক আকিজ বা আবুল বিড়ির আবুল খায়েরকে নিয়ে বিশাল বিশাল ফিচার। এর মানে কি? এর মানে হলো হাজার হাজার মানুষের হত্যাকারীদের সন্মান জানানো। অথচ এদেরকেই অপরাধী হিসাবে শনাক্ত করে ধরা উচিত ছিল। তো এই যে জানমালের ক্ষতির বিশাল নেটওয়াক সেটা একটা রাষ্ট্রে টিকে থাকে কিভাবে সংবিধানের মুখোমুখি? আর মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন বলে যেই আইনটা আছে সেটার নামেই তো সমস্যা আছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ বাক্যটা মাদককে প্রশ্রয় দেয়। মাদককে নিয়ন্ত্রণ নয়, শব্দটা হওয়া উচিত মাদক নিষিদ্ধ আইন।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর