হাওর বার্তা ডেস্কঃ কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। সমাজের অনেক সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিশোর গ্যাং সমস্যা। বিপথগামী কিশোররা এলাকায় মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন, চাঁদাবাজি এমনকি হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। কিশোরদের এলাকাভিত্তিক গ্যাংয়ের মধ্যে ঘটছে সহিংসতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব বিপথগামী কিশোরদের আটকের পর আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে স্বজনদের কাছে তুলে দিলেও এর ফল পাওয়া যাচ্ছে খুবই কম। যার ফলে পুলিশ-র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উদ্বিগ্ন।
গতকাল সোমবার দুপুরে রাজধানীর কুর্মিটোলায় র্যাব সদর দপ্তরে ‘র্যাব সেবা সপ্তাহ’ উপলক্ষ্যে আয়োজিত ‘দরিদ্র মেধাবী ও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষা সহায়তা দেওয়া’ অনুষ্ঠান শেষে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, বর্তমানে কিশোর গ্যাং একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা চাই না তারা ড্রাগ (মাদক) নিয়ে নষ্ট হয়ে যাক। বিষয়গুলোর প্রতি পরিবারের সদস্যদের সচেতন হতে হবে। এটা আপনাদের দায়িত্ব। দায়িত্ব না নিতে পারলে সন্তান জন্ম দিয়েছেন কেন? এ দায়িত্ব পরিবারকে নিতেই হবে।
এদিকে অ্যাপভিত্তিক ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের যোগাযোগ বাড়ায় অপরাধ বেড়েছে। কিশোররা বিভিন্ন লাইক-কমেন্ট করে প্রথমে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলে কিশোরীদের সঙ্গে। পর্যায়ক্রমে এই সম্পর্ক ভিডিওর মাধ্যমে অশ্লীলতায় পৌঁছে যায়। যার কারণে সম্প্রতি ব্ল্যাকমেইল করে কিশোরীদের ধর্ষণ ও হত্যার মতো কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।
রাজধানীর কলাবাগানে সম্প্রতি এক শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। পরে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় গ্রেফতার ধর্ষক ফারদিন ইফতেখার দিহান এলাকায় এক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। যদিও দিহানের বয়স ২২ বছর। পুলিশ বলছে, দিহান কিশোর বয়স থেকে কলাবাগান এলাকায় কিশোর গ্যাং গ্রুপে জড়িত ছিল।
অন্যদিকে টিকটকের ‘কিশোর গ্যাং’গুলো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। করোনার মহামারিতে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকায় এসব অসামাজিক ভিডিওতে লাইক কমেন্ট পাওয়ার জন্য একের পর এক অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোররা।
এছাড়াও বিভিন্ন পার্ক, খোলা জায়গায়, ফুটপাতে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে একত্রিত হয়ে ভিডিও কন্টেন্ট তৈরির নামে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, ইভটিজিং, পথচারীদের গতিরোধ, বাইক মহড়াসহ বিভিন্ন অসৌজন্যমূলক আচরণ করে থাকে। গ্রুপগুলো একে অপরের ভিডিও কন্টেন্টে ‘লাইক’ ও ‘কমেন্ট’ করার আহ্বান জানায়। এক গ্রুপ লাইক বা কমেন্ট করার পর অপর গ্রুপটি যদি না করে এ নিয়েও গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। যা হাতাহাতি, মারামারি ও খুনোখুনিতে গড়ায়।
র্যাবের অনুষ্ঠানে আইজিপি আরো বলেন, কলাবাগানের ঘটনাটি দেখেন, সেখানে ধর্ষণ হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ক্রাইম (অপরাধ)। আমরা যেন আইনের আধুনিকায়ন করতে গিয়ে জটিলতা তৈরি না করি। পত্রিকার পাতা খুললেই কিশোর গ্যাং। আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক শিশুদের হেফাজতে নিতে হলে নানা ধরনের নিয়ম রয়েছে। তাদের বিচার শিশু আদালতে করতে হবে। আমাদের দেশে কয়টি শিশু আদালত রয়েছে? শিশুদের ধরে আনলে রাখতে হবে সংশোধনাগারে। কিন্তু সংশোধনাগার কয়টি আছে? তবে কী আমরা কিশোর গ্যাং ও শিশু অপরাধীদের গ্রেফতার করব না? শিশু আদালত নেই, তাতে কী বিচার হবে না? হবে, সবকিছুই করতে হবে। তবে শিশুদের সচেতনতার জন্য পরিবারকে দায়িত্ব নিতে হবে। এটি বাবা-মার সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্বও বটে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, সমাজে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। নিজেদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে কিশোররা। তাদের আচরণে পরিবর্তন হচ্ছে। কিশোর বয়সে হিরোইজম ভাব থাকে। এই হিরোইজমকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে হবে। আবার কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের গ্যাং কালচার গড়ে উঠছে। অনেক ক্ষেত্রে ভিনদেশি সংস্কৃতি ইচ্ছামতো তাদের আয়ত্বে চলে যাওয়ায় তাদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সমাজের শিক্ষক, অভিভাবক, জনপ্রতিনিধি বা যাদের কথা শুনবে—এমন ব্যক্তিদের নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগে এই কিশোর গ্যাং কালচার থেকে বিপথগামী কিশোরদের সুপথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
গত তিন বছরে শুধু র্যাব সদস্যরাই প্রায় ৪০০ গ্যাং কালচারের কিশোরকে গ্রেফতার করেছে। তবে আইনি জটিলতার কারণে অভিযান অনেকটা থমকে গেলেও ফের অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। গোয়েন্দা তথ্যমতে, প্রতিটি গ্রুপেই রয়েছে কমপক্ষে ১৫ জন করে সদস্য। রাজধানীতে প্রায় ৬০টি কিশোর গ্যাংয়ের সন্ধান পেয়েছে।
এর মধ্যে ৩৪ গ্রুপই সক্রিয় রয়েছে। ঢাকার শিশু আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের নথি অনুযায়ী গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ৮৮টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত ১ জানুয়ারি রাজধানীর মহাখালীতে কিশোর গ্যাং গ্রুপের ছুরিকাঘাতে আরিফ হোসেন (১৭) নিহত হয়।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নুরজাহান খাতুন বলেন, কিশোর বয়সের মধ্যে ‘অ্যাডভেনচার ফিলিং’ বা ‘হিরোইজম’ ভাব তাদের মধ্যে দেখা যায়। কিশোর বয়সে এমন একটা পরিবেশে বেড়ে ওঠে—সেখানেই অপরাধী হয়ে উঠতে সহায়তা করে। তারা এই বয়সে এমন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে বা ফলো করে, সেখান থেকেই তারা অপরাধের দিকে ধাবিত হয়। এখানে অসত্ অনুষঙ্গের সংস্পর্শে চলে।