হাওর বার্তা ডেস্কঃ কুমিল্লা নগরীর একটি শপিং মলে টেইলার্স (দর্জি) দোকান ছিল দিপু রবি দাসের। সংসারে তার চার ছেলে-মেয়ে। একটু সুখের আশায় বড় ছেলে নটরাজ রবি দাসকে বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নেন দিপু। ঠিক এমন সময়ে পরিচয় হয় তার পাশের আরেকটি টেইলার্স দোকানের মালিকের সঙ্গে। মাছুম নামের ওই দর্জি দিপুকে টোপ দেন তার ছেলেকে দক্ষিণ আফ্রিকা নেয়ার। আর এর মাধ্যমেই তিনি পা দেন মানবপাচারকারীদের ফাঁদে। দিপু কুমিল্লা নগরীর পশ্চিম রেইসকোর্স এলাকার বাদল রবি দাসের ছেলে তিনি।
এরই মধ্যে ফাঁদে পড়ে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুইয়েছেন দিপু। তার ছেলেকে মানবপাচারকারীরা প্রথমে ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে যায়। এরপর সেখানে ছেলেকে নির্যাতন করে তার কাছ থেকে নেয়া হয় আরো ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। গত ছয় মাসের বেশি সময় ধরে ছেলে নটরাজের কোনো খোঁজই পাচ্ছেন না দিপু। এরই মধ্যে তিনি জানতে পেরেছেন ছেলেকে বিক্রি করে দিয়েছে মানবপাচারকারীরা। সব হারিয়ে নিঃস্ব দিপু এ ঘটনায় জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার মাধ্যমে মানবপাচার আদালতে মামলা করেছেন। মামলা করে উল্টো আসামিদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
চট্টগ্রামের মানবপাচার আদালতে হওয়া ওই মামলার আসামিরা হলেন, কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার রায়পুর গ্রামের মতিউর রহমানের ছেলে মাসুদুর রহমান, মো.মাছুম, মামুনুর রহমান ও তাদের মা নাসিমা খানম। তারা বর্তমানে কুমিল্লা নগরীর রেইসকোর্স এলাকার ধানমন্ডি রোডের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন।
জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার চট্টগ্রাম লিগ্যাল এইড অফিসের প্যানেল আইনজীবী অ্যাডভোকেট আশরাফি বিনতে মোতালেব জানান, আদালতের বিচারক জান্নাতুল ফেরদৌস মামলাটি আমলে নিয়ে কুমিল্লা কোতোয়ালি থানাকে ঘটনাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। গত ১০ ডিসেম্বর ওই আদেশ দেন তিনি। মামলার বাদী একেবারে অসহায় হওয়াতে আমরা তাকে আইনি সহায়তা করছি। আশা করছি সুষ্ঠু তদন্তে আসামিদের অপকর্ম বেরিয়ে আসবে।
মামলার বাদী দিপু রবি দাস বলেন, নগরীর ইস্টার্ন ইয়াকুব প্লাজায় তার দোকান ছিল। পাশেই দোকান ছিলো আসামিদের। এই সুবাদে তাদের সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। একপর্যায়ে তারা আমাকে বলে তাদের মামা দক্ষিণ আফ্রিকা থাকেন। সেখানে আমার ছেলেকে পাঠালে ভালো বেতন পাবে এবং ভালো থাকবে। এরপর তারা ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে গত বছরের ১২ জানুয়ারি আমার ছেলেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে যায়। ছেলেকে নেয়ার পর থেকে তার সুর পাল্টে ফেলে। নটরাজের উপর শুরু করে নির্যাতন।
এরপর গত ১৮ জুন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আমার কাছ থেকে আরো ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা আদায় করে তারা। তাদের টাকা দিতে গিয়ে আমি ব্যবসা হারিয়ে এখন নিঃস্ব। এরপর থেকে আমার ছেলের কোনো খোঁজ নেই। পরে জানতে পারি তারা পাকিস্তানি এক লোকের কাছে আমার ছেলেকে বিক্রি করে দিয়েছে। গত ১১ নভেম্বর আমার ছেলের খোঁজ নিতে আসামিদের কল করলে তারাও বলে আমার ছেলেকে তারা বিক্রি করে দিয়েছে। এ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমাকে মামলা দিয়ে ফাঁসাবে এবং মেরে গুম করে ফেলবে। পরে নিরূপায় হয়ে ওই সংস্থার সহযোগিতায় মামলা করেছি। এখন তাদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
দিপু আরো জানান, তাদের পুরো পরিবারটাই মানবপাচারের সঙ্গে যুক্ত। এমন অনেক মানুষকে তারা বিদেশে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। নির্যাতন করে টাকা আদায় করেছে। কুমিল্লায় প্রশাসনের কাছে গত ছয় মাস ধরে ঘুরেও কোনো বিচার পাইনি।
নগরীর শাসনগাছা এলাকার সেলিম মিয়ার স্ত্রী মর্জিনা বেগম বলেন, ওই মানবপাচারকারীরা আমার ছেলেকে বিদেশ নেবে বলে ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা নিয়েছে। আমি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেও টাকা ফেরত পাইনি। তারা সব ম্যানেজ করে ফেলে। অনেক পরিবার তাদের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে।
তবে এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অভিযুক্ত মাসুদুর রহমান বলেন, আমাদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল তার (দিপু) ছেলেকে দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে দেয়া। আমরা তাকে সেখানে পৌঁছে দিয়েছি। এখন সে কোথায় আমরা জানি না। আর যারা অভিযোগ করেছে তাদের সঙ্গে আমাদের এসব বিষয়ে মামলা চলছে। তদন্ত করলে দেখবেন আমরা নির্দোষ। আমরা ব্যবসা করে খাই, মানব পাচার করি না। আমাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক।