হাওর বার্তা ডেস্কঃ বর্তমানে পৃথিবীতে মানুষের গড় উচ্চতা কিন্তু খুব বেশি না। প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মধ্যে পুরুষের জন্য বিশ্বব্যাপী গড় উচ্চতা প্রায় ১৭২ সেমি (৫ ফুট ৭ ১/২ ইঞ্চি) এবং নারীদের গড় উচ্চতা প্রায় ১৫৮ সেন্টিমিটার (৫ ফুট ২ ইঞ্চি)। তবে মাঝে মাঝে হাতেগোনা কয়েকজনকে এর বাইরে দেখা যায়। এখানে আসলে সবার কথা বলছি না। বলছি গড় উচ্চতার কথা।

অনেকেই দেখবেন অল্প বয়সে অনেকবেশি লম্বা হয়ে যাওয়ার কারণে অনেক ধরনের শরীর চর্চা করে থাকেন। দীর্ঘদেহী হবার জন্য ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সের মধ্যে অনেকে নানা রকম শরীরচর্চা করার কথা শোনা যায়। আবার অনেকে আছে লম্বা হওয়ার জন্য নানা ধরনের ওষুধ খেয়ে থাকেন কিংবা বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম করেন। তবে খুব একটা কাজে আসে না এসবের কিছুই। আচ্ছা অপারেশন করিয়ে পায়ের হাড় লম্বা করার মাধ্যমে উচ্চতা বাড়ানোর কথা খুব শুনেছেন কি কখনো?

শুনতে অভিনব মনে হলেও এখন জানা যাচ্ছে, পৃধিবীতে প্রতি বছর শত শত লোক এই ধরনের অপারেশন করাচ্ছেন। এই অস্ত্রোপচার খুবই কষ্টকর, এর দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকিও আছে অনেক, কিন্তু কয়েক ইঞ্চি উচ্চতা বাড়াতে অনেকেই এই কষ্ট ও ঝুঁকি নিচ্ছেন অবলীলায়।

তেমনি একজন ১৫ বছর বয়সী স্যাম বেকার। হাইস্কুলের শেষ বছরে উত্তীর্ণ হবার সময় স্যাম দেখলেন, তার সহপাঠীরা সবাই ধীরে ধীরে তার চেয়ে লম্বা হয়ে গেছে। তিনি কলেজে যাওয়ার পর দেখলেন ছেলেদের চেয়ে তো বটেই – অনেক মেয়ের চেয়েও তিনি অনেক খাটো। খাটো ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরা প্রেম করতে চায়না। এমনকি কম উচ্চতার জন্য স্বাভাবিকভাবে কারো সঙ্গে সেভাবে মিশতেও পারতেন না তিনি।

পায়ের হাড় কেটে এভাবে উচ্চতা বাড়ানো যায়

বর্তমানে স্যামের বয়স ৩০। তিনি থাকেন নিউইয়র্কে। তিনি জানতেন তার উচ্চতা বৃদ্ধির বয়স চলে গেছে, কিন্তু তবুও তার একটা আশা ছিল যে হয়তো তিনি আরো খানিকটা লম্বা হবেন। এরপরই আসলে তিনি অপারেশন করান। সময়টা ২০১৫ সালে। স্যাম অপারেশনটা করালেন। তিনি ছিলেন ৫ ফুট ৪ইঞ্চি লম্বা। আর এখন তার উচ্চতা হয়েছে ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি (১৭০ সেন্টিমিটার)।

স্যাম বেকার বলেন, উচ্চতা আপনার জীবনের ওপর অনেক প্রভাব ফেলে। সত্যি বলতে কি অনেক মেয়েই তাদের চেয়ে খাটো ছেলেদের সঙ্গে প্রেম করতে চায়না। সবচেয়ে কষ্টকর যে কথাটা আমার মাথায় ঘুরতো তা হলো আমি হয়তো জীবনে কাউকে বিয়ে করতেই পারবো না।
আমার মনে হতো, লম্বা হবার সঙ্গে জীবনে সাফল্যের সম্পর্ক আছে। তাই আমি আমার নিজের মতো করে ব্যাপারটার একটা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছিলাম।

লম্বা হবেন কীভাবে সেই ভাবনা থেকে এলো উঁচু হিলের জুতো পরা বা স্ট্রেচিং করার মত কিছু সমাধান। তবে এতে মেয়েদের আকৃষ্ট করতে পারলেন না তিনি। তখনই তিনি অপারেশন করে লম্বা হওয়ার কথা জানতে পারেন। তিনি এ নিয়ে খোলাখুলি কথা বললেন তার মায়ের সঙ্গে এবং ঝুঁকিগুলো বিবেচনা করলেন। তারপর তার মনে হলো, অপারেশন টেবিলই তার সমস্যার সমাধান।

এই অপারেশনে রয়েছে অনেক ঝুঁকি

ডাক্তার অপারেশন করার আগেই স্যামকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে এই শল্যচিকিৎসা অত্যন্ত কঠিন। তবে স্যাম নিজে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন যে তিন ইঞ্চি লম্বা হবার পর তার ঠিক কি অবস্থা হবে। তিনি ঠিকভাবে হাঁটতে পারবেন কিনা! দৌড়াতে পারবেন কিনা! অপারেশনের পর সপ্তাহে তিন-চারদিন কয়েক ঘন্টা করে তাকে ফিজিওথেরাপি নিতে হতো। এটা চলেছিল প্রায় ৬ মাস। লোকে এটাকে কসমেটিক সার্জারি বলে। তবে এটি আসলে স্যাম করিয়েছিমেন মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভেবে।

যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, ইতালি, তুরস্ক এমনকি ভারত সহ ১২টিরও বেশি দেশে পা লম্বা করার অপারেশন করা হচ্ছে এখন। কোনো কোনো ব্যক্তি এর মাধ্যমে প্রায় ৫ ইঞ্চি পর্যন্ত উচ্চতা বাড়াতে পেরেছেন। ঠিক কত লোক এই অপারেশন করান তা বলা কঠিন। কিন্তু বিবিসি এ নিয়ে বেশ কিছু দেশের ক্লিনিকের সঙ্গে কথা বলেছে। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতি বছর ১০০ থেকে ২০০টি এ অপারেশন হচ্ছে। অন্য দেশগুলোতে অপেক্ষাকৃত কম -প্রতি বছর ২০ থেকে ৪০টি। দিন দিন এর জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে।

কীভাবে অপারেশন করে পা লম্বা করা হয়?

প্রথমে পায়ের হাড়ে একটি ছিদ্র করা হয়। তারপর সেই হাড় কেটে দু-টুকরো করে তার ভেতরে একটি ধাতব রড ঢুকিয়ে দিয়ে তা স্ক্রু দিয়ে এঁটে দেয়া হয়। এরপর রডটার দৈর্ঘ্য প্রতিদিন এক মিলিমিটার করে ধীরে ধীরে বাড়ানো হয়। এভাবে রোগীর ইচ্ছা অনুযায়ী উচ্চতা অর্জন করা এবং হাড় জোড়া লাগা পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া চলে।

বিশ্বের প্নেক দেশের মানুষই এই উপায় বেছে নিচ্ছেন

অত্যন্ত ব্যয়বহুল অপারেশন
যুক্তরাজ্যে কেয়ার কোয়ালিটি কমিশন নিয়ন্ত্রিত কিছু প্রাইভেট ক্লিনিকে এ অপারেশন হয়, যাতে খরচ পড়ে ৫০ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ জন্য ৭৫ হাজার ডলার থেকে ২ লক্ষ ৮০ হাজার ডলার পর্যন্ত ব্যয় হতে পারে। এটি একটি দীর্ঘ, বেদনাদায়ক এবং ব্যয়বহুল অপারেশন।

এই অপারেশনের কৌশল আবিষ্কার করেন একজন সোভিয়েত ডাক্তার গাভরিল ইলিজারভ। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে আসা আহত সৈন্যদের চিকিৎসা করতেন। গত ৭০ বছরে এই অপারেশনে কিছু পরিবর্তন হয়েছে তবে মূল কৌশল এখনো প্রায় একই আছে।

প্রতি মুহুর্তে জটিলতা দেখা দেবার ঝুঁকি

অপারেশনের পর রোগীকে কয়েক মাস ধরে ফিজিওথেরাপি করতে হয় তার হাঁটাচলার শক্তি ফিরে পাবার জন্য। এসময় প্রতি মুহুর্তে জটিলতা দেখা দেবার ঝুঁকি থাকে। এর মধ্যে স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি, রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া বা পায়ের হাড়ের জোড়া না লাগার মত যে কোনরকম সমস্যা দেখা দিতে পারে।

এই অভিজ্ঞতা হয়েছে বার্নি নামে একজনের। তিনি ২০১৫ সালে এই অপারেশন করিয়ে ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি থেকে ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়েছিলেন। অপারেশনের সময় তার বয়স ছিল ৪৬। অপারেশনের পরে দেখা গেল, তার পায়ের হাড় বেড়ে জোড়া লাগছে না। তার দুই পায়ের হাড়ের মাঝখানে তিন ইঞ্চি পরিমাণ অংশ ধাতব রড, তার দু’পাশে হাড়।

এই অপারেশনের মাধ্যমে অনেকেই তিন থেকে পাঁচ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়েছেন

তিনি হাঁটতে পারতেন, কিন্তু অনুভব করতেন প্রচণ্ড ব্যথা। তার সঙ্গে ছিল এই মানসিক যন্ত্রণা যে এখন হয়তো আর কিছুই করার নেই। তবে পাঁচ বছর পর তার হাড় জোড়া লেগেছে এবং ধাতব রড অপসারণ করা হয়েছে।

বার্নি বলেন, তার সেরে উঠতে বহু সময় লাগবে। কিন্তু এতদিন পর হলেও তার মনে হচ্ছে অপারেশন করা সার্থক হয়েছে। তিনি খর্বকায় মানুষদের যে বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গীর শিকার হতেন। তা থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছেন।

তবে এই অপারেশনের পর কতজনের ক্ষেত্রে জটিলতা হয়, তার কোনো নির্ভরযোগ্য উপাত্ত নেই। তবে ব্রিটিশ অর্থপেডিক সমিতির অধ্যাপক হামিশ সিম্পসন বলছেন, এর ঝুঁকি অনেক। একজন চিকিৎসক প্রফেসর সিম্পসন বলেন, আগের চাইতে এখন এ অপারেশনের প্রযুক্তি উন্নত এবং অধিকতর নিরাপদ হয়েছে। কিন্তু এই অপারেশনের পর নতুন হাড়, মাংসপেশী, স্নায়ু, রক্তবাহী নালী এবং চামড়া তৈরি হতে হয়। তাই প্রক্রিয়াটা এখনও অত্যন্ত জটিল রয়ে গেছে। এবং, জটিলতা দেখা দেবার হারও উঁচু।