থামছে না স্বজনদের আহাজারি, চান প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বরিশাল মেটোপলিটন পুলিশের সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিমের মৃত্যুর খবর পেয়ে গত দুইদিন ধরেই স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও এলাকাবাসী নিহতের বাসায় ভিড় জমাতে থাকে। স্বজনদের আহাজারিতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।

বুধবার সকালে বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, পুত্রকে হারানোর শোকে নিহতের বাবা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। স্ত্রী ও ভাই-বোনেরা কান্না করছেন। তাদের কান্নায় আশপাশের এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। যেন আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। তার স্ত্রী বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। স্বজনরা তাদের শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। বাবাকে না পেয়ে একমাত্র সন্তান চার বছরের শিশু সাফরান বারবার স্বজনদের জড়িয়ে কান্না করছে। তার কান্না দেখে নিহতের বোন ও ভাইরাও কান্নায় ভেঙে পড়েন। কোন সান্তনাই যেন তাদের কান্না থামাতে পারছে না।

নিহতের বোন সাথী আক্তার জানান, টিভিতে/খবরের কাগজে আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা শিরোনাম হতে দেখেছি। আজ আমার ভাইও যে আবরারের মতো খবরের শিরোনাম হবে তা কখনো ভাবিনি। কল্পনা করতেও পারিনি। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে ওয়াসরুমে নেয়ার কথা বলে আমার ভাইকে হাসপাতালের দোতলায় মেঝেতে ফেলে ৮/১০ জনে হত্যা করেছে। আমার ভাইয়ের এমন কী অপরাধ ছিল যে তাকে নির্যাতন করে হত্যা করতে হবে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর সুষ্ঠু বিচার চাই।

নিহতের বড় ভাই রেজাউল করিম জানান, আনিসুল করিম শিপন সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে বরিশাল মহানগর পুলিশে (বিএমপি) কর্মরত ছিলেন। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন আনিসুল। বাবা ফাইজুদ্দিন আহমেদ মুক্তিযোদ্ধা। গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার সম্মানিয়া ইউনিয়নের আড়াল গ্রামে তাদের গ্রামের বাড়ি।

তবে তারা গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের বরুদা এলাকায় প্রায় ৪০ বছর যাবৎ বসবাস করছেন। জেলা শহরের রাণী বিলাস মনি সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয় থেকে ২০০০ সালে এসএসসি পাশ করেন। তিনি কাজী আজিম উদ্দীন কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের ৩৩তম ব্যাচে লেখাপড়া করে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। আনিসুল ছিলেন মেধাবী ও সদালাপী এবং বন্ধুবৎসল। তিনি ৩১তম বিসিএস-এ উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশের চাকরিতে যোগদান করেন।

তিনি জানান, ২০১১ সালে আনিসুল করিম শিপন বিয়ে করেন শারমিন সুলতানাকে। এ দম্পতির চার বছর বয়সী সাফরান নামে একটি ছেলে রয়েছে। শিপন খুব চাপা স্বভাবের ছিলেন। মানসিকভাবে অনেক চাপ নিলেও তিনি কখনো কাউকে কিছু বলতেন না। গত কয়েকদিন ধরে তার কিছুটা মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাকে নিয়ে ঢাকার আদাবর এলাকার মাইন্ড এইড হাসপাতালে যান তিনি (রেজাউল করিম) ও তার বোন।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কাউন্টারে যখন ভর্তির ফরম পূরণ করা হচ্ছিল, তখন কয়েকজন কর্মচারী তাকে টেনে হিঁচড়ে দোতলার একটি রুমে নিয়ে যান। সেখানেই সেখানে তাকে হত্যা করা হয়। অথচ এর কিছুক্ষণ পর তাদের জানানো হয় আনিসুল অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। এরপর স্বজনরা তাকে দ্রুত হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক আনিসুলকে পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন।

তিনি আরো জানান, এ ঘটনায় ওই হাসপাতাল থেকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ। সেখানে দেখা যায়, বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটের দিকে পুলিশ কর্মকর্তা আনিসুল করিমকে টানাহেঁচড়া করে একটি কক্ষে ঢোকানো হয়। তাকে হাসপাতালের ছয়জন কর্মচারী মিলে মাটিতে ফেলে চেপে ধরেন। এরপর নীল পোশাক পরা আরও দু’জন কর্মচারী তার পা চেপে ধরেন।

এ সময় মাথার দিকে থাকা দু’জন কর্মচারী হাতের কনুই দিয়ে তাকে আঘাত করছিলেন। হাসপাতালের ব্যবস্থাপক আরিফ মাহমুদ তখন পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। একটি নীল কাপড়ের টুকরা দিয়ে আনিসুলের হাত পেছনে বাঁধা হয়। চার মিনিট পর আনিসুলকে যখন উপর করা হয়, তখনই তার শরীর নিস্তেজ ছিল। এ সময় একজন কর্মচারী মুখে পানি ছিটালেও আনিসুল নড়াচড়া করছিলেন না।

শিপন হত্যার ঘটনায় বাবা মুক্তিযোদ্ধা ফাইজুদ্দিন আহমেদ বাদী হয়ে রাজধানীর আদাবর থানায় মামলা দায়ের করেছেন।

আনিসুল করিম শিপনকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করে তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও পুলিশের আইজিপির হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন নিহতের ভাই রেজাউল করিম।

অন্যদিকে বুধবার দুপুরে আনিসুল করিম শিপনের বাসায় তার বাবা, ভাই, বোন ও স্বজনদের সমবেদনা জানাতে যান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও জোনে কর্মরত উপকমিশনার (ডিসি) ও গাজীপুরের সাবেক এসপি মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।

এ সময় সাংবাদিকদের তিনি জানান, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড হাসপাতালে পুলিশের সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম শিপনের মৃত্যুটি স্বাভাবিক নয়। এটি প্রকৃতই একটি হত্যাকাণ্ড। কারণ হাসপাতালটির বৈধ কাগজপত্র নেই, প্রশিক্ষিত জনবল নেই। তারপরও সেখানে চিকিৎসা চলানো হচ্ছে। এ হাসপাতালে শুধু ওয়ার্ড বয় নয়, ওই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যারা জড়িত রয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ঘটনায় হত্যা মামলাও রজু হয়েছে। হত্যা মামলায় দ্রুত চার্জশিট দেয়া হবে। তদন্তও দ্রুত গতিতে চলছে।

হারুন অর রশীদের সঙ্গে ঢাকা থেকে আগত এএসপি আনিসুল করিম শিপনের প্রায় ২০ জন ব্যাচমেট ছিলেন। পরে তারা আনিসুলের কবর জিয়ারত করেন। তারাও এ ব্যাপারে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেছেন।

অনুমোদনহীন হাসপাতালটির বিরুদ্ধে সব ধরনের অনুসন্ধান করছে পুলিশ। ওই ঘটনায় জড়িত কেউ ছাড় পাবে না। যারাই নামকাওয়াস্তে এ হাসপাতাল করে মানুষকে হয়রানি করছে এবং এর সঙ্গে কোন প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক ও কর্মকর্তা জড়িত আছে কি-না তা তদন্ত করে প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে।

ডিসি হারুন জানান, ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হাসপাতালের পরিচালক ড. মো. নিয়াজসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার মধ্যে ১০ জনকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। হাসপাতালের পরিচালক অসুস্থ থাকায় এখন তার চিকিৎসা চলছে। সুস্থ হলে তাকেও রিমান্ড নেয়া হবে।

একইদিন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার শরিফুল ইসলাম, গাজীপুরের এসপি শামসুন্নাহার, এডিশনাল এসপি রাসেল শেখ, আমিনুল ইসলামসহ জেলা পুলিশের কর্মকর্তা, স্বজন ও বন্ধুরা সমবেদনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের সান্তনা দিতে গাজীপুরের বরুদা এলাকার নিহতের বাড়িতে ছুটে যান।

এদিকে শিপনের হত্যকারীদের বিচার দাবিতে কালো ব্যাচ ধারণ, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। বুধবার বেলা ১১টার দিকে শহরের ভাওয়াল রাজবাড়ি সড়কে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে এসব কর্মসূচি পালন করা হয়।

নিহত শিপনের সহপাঠী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় স্কুল ও কলেজের সহপাঠী এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে আয়োজিত এসব কর্মসূচিতে কাপাসিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান আমানত হোসেন খান, কাউন্সিলর হাসান আজমল ভূইয়া, আয়েশা বেগমসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ অংশ নেন। এ সময় বক্তারা অবিলম্বে শিপন হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর