বাংলাদেশের পতাকা ২০০ দেশে পৌঁছে দিতে চাই: ফ্লাগগার্ল নাজমুন নাহার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ২০ বছর আগে পৃথিবী দেখার নেশায় ঘর ছেড়েছিলেন এক কিশোরী। শঙ্কা, দুর্গম পথ, মৃত্যুভয় সবকিছু উপেক্ষা করে পৃথিবী জুড়ে একাকী যার বিচরণ।

তিনি এরই মধ্যেই বিশ্বের ১৪০টি  দেশভ্রমণ করেছেন।  জাতিসংঘের  সদস‌্যভুক্ত প্রতিটি দেশেই বাংলাদেশের পতাকা পৌঁছে দেবেন— এই প্রত‌্যয় তার। তিনি বাংলাদেশের মেয়ে,  ফ্লাগগার্ল নাজমুন নাহার।
পৃথিবীর পথে পথে অনেক ঘুরেছেন তিনি। দেশের পতাকা হাতে পৃথিবীতে এই প্রথম কোন নারী এতোগুলো দেশ ভ্রমণ করেছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের মানুষের হৃদয়ে সাড়া জাগিয়েছেন তিনি। পতাকার সম্মানকে সর্বোচ্চ উচ্চতায় তুলে ধরতে তিনি হেঁটে চলেছেন পৃথিবীর পথে।  শুধু নিজেকে নন,  তিনি গৌরবান্বিত করেছেন বাংলাদেশকে।

নাজমুন নাহার কথা বলেছেন রাইজিংবিডির সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাসলিমা পারভীন বুলাকী।

নাজমুন নাহার : উনিশ বছর বয়সেই পর্যটক হিসেবে পথ চলা শুরু। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত দিয়ে স্বপ্ন যাত্রা শুরু। তাও আবার একাকী। তখন তিনি নিজেও জানতাম না যে একদিন সত‌্যি সত্যিই ১৪০টি দেশভ্রমণ করে ফেলবো। সর্বশেষ  সর্বশেষ ব্রুনাই ভ্রমণ করেছি।

নাজমুন নাহার : প্রথমে নিজ খরচে ভারত, নেপাল, সিঙ্গাপুরসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ সফর করি। তারপর শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে ২০০৬ সালে সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার সুযোগ পাই। সেখানে আসার পর থেকে কঠোর পরিশ্রম শুরু করি। থাকা খাওয়ার ন‌‌্যূনতম খরচ বাদ দিয়ে সবটা ভ্রমণের জন্য জমাতাম। কাজের পাশাপাশি পৃথিবীর ম্যাপের ওপর গবেষণাও চালাতে থাকি। কীভাবে কম খরচে ভ্রমণ করা যায়, সেসব নিয়ে ভাবতে থাকি। প্রতিবছর গ্রীষ্মের ছুটিতে কখনো কখনো টানা তিন মাস কাজ করেছি। কখনো প্রতিদিন টানা ১৭ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করেছি। এভাবে ভ্রমণের অর্থ যোগাড় করেছি।

আমি ভাবতাম কখন অল্প খরচে ভ্রমণ করা যায়। কখন সস্তায় টিকেট পাওয়া যায়। এসব যখন একসঙ্গে মিলে যেত, তখন ভ্রমণের জন‌্য বেড়িয়ে পড়তাম। ভ্রমণে কম খরচে থেকেছি পৃথিবীর বিভিন্ন ট্রাভেলার্স হোস্টেলে, কখনো তাবুতে,  কখনো কোচ সার্ফিংয়ের মাধ্যমে।

নাজমুন নাহার : দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় অভিজ্ঞতার ঝুলি কম নয়। মধ্যরাতে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে আটকা পড়েছি। সাহারা মরুভূমিতে মরুঝড়ের মধ্যে পড়েছে, রক্তাক্ত হয়েছি। পোকা মাকড়ের কামড় খেয়েছি। অন্ধকারে অচেনা শহরে,  আফ্রিকার জংলী  শহরে পথ হারিয়েছি। তিনমাস আফ্রিকাতে আলু খেয়ে ছিলাম।  কখনো না খেয়ে  থেকেছি। কখনো কাঠ, কখনো পাথরের ওপর ঘুমিয়েছি। কখনো আদিবাসীদের সঙ্গে জঙ্গলে ঘুমাতে গিয়ে বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হয়েছি। কখনো রাতের অন্ধকারে বর্ডার ক্রস করতে না পেরে অপরিচিত পরিবারের সঙ্গে থাকতে হয়েছে।

১৪২০০ ফুট উচ্চতায় পেরুর রেইনবো মাউনটেইনে অভিযাত্রায় আন্টিচুডের সমস্যার কারণে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। মৃত্যুকে জয় করে সেই পর্বতশৃঙ্গে উঠতে সক্ষম হয়েছি। সমুদ্রের তলদেশে স্কুবা ডাইভিং-এর সময় পাইপ লিক হয়ে লবণাক্ত পানি খেয়েও বেঁচে ফিরেছি। পশ্চিম আফ্রিকার গিনি কোনাক্রিতে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে ৩টার সময় আটকা পড়েছিলাম। সেসময় ২৬ ঘণ্টা অনাহারে থেকেছি।  আদিবাসীদের সঙ্গে কাটানো সেই লোমহর্ষক ঘটনা মনে পরলে আজও শিহরে উঠি। কিরগিস্তানের আলা আরচা পর্বত আরোহন করে নামার সময় পড়ে গিয়ে ছোট্ট একটি বুনো গাছের সঙ্গে ঝুলে ছিলাম।  পড়ে গেলে হয়তো সেদিনই মৃত্যু হতো। গাছে ঝুলে থাকা আমাকে আয়মেরিক ও জুলিয়ান নামক দু’জন অভিযাত্রী বাঁচিয়েছিলেন।

পেরুর মাচুপিচুতে

বাংলাদেশের পতাকা ওড়াচ্ছিলাম আইভরি কোস্টের আবিদজান সমুদ্র সৈকতে। পাড় দিয়ে হাটঁছিলাম, ছোট ছোট ঢেউ আসছিল।  আমার দিকে তেড়ে আসলো বড় ডেউ।  আমি ভেসে গিয়েছিলাম। ভয়ঙ্কর ঢেউ আমাকে আরও গভীরে নিলো। কীভাবে যেন বেঁচে গেলাম সে যাত্রায়।

কখনও ৪৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পুড়েছি। পশ্চিম আফ্রিকার পথে পথে আমাকে অনেক কঠিন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু সবই মানসিক শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করেছি। সিয়েরালিওন থেকে লাইবেরিয়া যাওয়ার পথে ১১টি ভয়ঙ্কর কূপ পার হতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, রাস্তা কোথায় ভয়ঙ্কর উঁচু, খাড়া, কোথাও পিচ্ছিল। কোথাও রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের ডাল সরিয়ে চলতে হয়েছিল।

বিপদসংকুল ওই জায়গাগুলোতে কোনো না কোনো হৃদয়বান ব্যক্তি সাহায্য করেছেন। পখ দেখিয়েছেন। যখনই কোনো সমস্যায় পড়েছি, কেউ না কেউ এগিয়ে এসেছেন। বিভিন্ন শহরে প্রায় তেরোটি লোকাল ফ্যামিলির সঙ্গে থেকেছি। আফ্রিকার জীবন সম্পর্কে নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। খুব কাছ থেকে তাদের সংষ্কৃতিকে জানতে পেরেছি। তারা যত গরীবই হোক না কেন, সবাই হাসিমুখে ‘ইউ আর ওয়েলকাম’ বলেছেন। তাদের ভালবাসা-সম্মান আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ হয়েছি।

বিশ্ব মানচিত্রের সবচেয়ে কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছি মৌরিতানিয়ায়। সেখানে সাহারার তপ্ত মরুঝড়ে আক্রান্ত হয়ে ধারালো বালির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছি। সেনেগালের রোজ লেকে যাওয়ার  সময় তিন ঘণ্টা জঙ্গলে হেঁটেছি। সেন্ট লুইতে একাকী পথ হারিয়ে আট কিলোমিটার অন্ধকার পথ  হেঁটেছি। সেসময় আবু নামক এক যুবকের সহযোগিতায় বাস স্টেশনে গিয়েছি। প্রতিটি কষ্ট আর চ্যালেঞ্জ আমাকে নতুন করে বেঁচে থাকার সাহস জুগিয়েছে। মানুষ ও প্রকৃতির কাছ থেকে অনেক শিখেছি।

অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট বেরিয়ার রিফ আর হোয়াইট হেভেন বিচে যাওয়ার জন্য সেইলিং বোটে ছিলাম। সানডে প্যাসেজ পার হওয়ার সময় উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে আমাদের সেইলিং বোট ভাসছিল। জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সমুদ্র যাত্রা ছিল সেটি। বোটটি সমান্তরালে ছিল না। বাতাসে পাল ওড়ছে, বোটের একপাশ ছুঁয়ে আছে পানির সঙ্গে আরেক পাশ উঠে গেছে অনেক ওপরে। সেপাশে আমরা যাত্রীরা লোহার রোড ধরে ছিলাম। বার বার টের পাচ্ছিলাম যদি কোনোভাবে হাতটা রড থেকে ছুঁটে যায় তো পানির মধ্যে পড়ে যাবো। এমন আরও অনেক অভিজ্ঞতায় ঠাঁসা আমার জীবন।

তবে, যেখানে ভ্রমণ বিপৎজনক মনে হতো, তার জন্য কৌতুহলি আর লড়াকু ছিলাম। অভিযাত্রা, অভিযান, আবিষ্কারের নেশায় আমি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হাঁটছি আজো।

নাজমুন নাহার : মানুষের জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত। জীবনটা বিধাতার আশীর্বাদ। সুযোগ পেয়েছি পৃথিবীতে আসার। যে পৃথিবীতে আমি জন্ম নিয়েছি সেই পৃথিবীটা কেমন? তার ভিন্ন গোলার্ধের মানুষগুলো কেমন? তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি কেমন?এগুলো জানার ও দেখার ইচ্ছা ছোট বেলা থেকেই ছিল। তাই এই ছুটে চলা।

নাজমুন নাহার : বাবার কাছে দেশ-বিদেশের অনেক ভ্রমণ কাহিনী শুনতাম। দাদা আলহ্বাজ মৌলভী আহাম্মদ উল্লাহ একজন ভ্রমণ পিয়াসু মানুষ ছিলেন। তিনি ১৯২৬ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত আরবের অনেক দেশেই ভ্রমণ করেছেন। ঘোড়ায় চড়ে, জাহাজে করে ভ্রমণ করতেন। দাদাকে দেখে, তার মুখে গল্প শুনে আমি সেইসব জায়গাতে হারিয়ে যেতাম। মূলত সেসব গল্পই আমাকে আগ্রহী করে তোলে। ছোটবেলায় প্রচুর বই পড়তাম। ভ্রমণ বিষয়ক যেকোন লেখাই আমাকে খুব টানতো।

নাজমুন নাহার : প্রথমত আমি কখনোই নিজেকে নারী হিসেবে ভাবি না। বাবা আমাকে একজন মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখিয়েছেন।  আমি বিশ্বাস করি, স্বপ্নের কোনো জেন্ডার ডিফারেন্স নেই। স্বপ্ন যে কোনো মানুষই দেখতে পারে আর সেই স্বপ্নকে পূরণ করার জন্যই নির্ভয়ে পৃথিবীর পথে নেমেছি। নারী হিসেবে নয়, পৃথিবীর পথে পথে যে কোনো সমস্যা যে কোনো মানুষেরই হতে পারে।

ঘানাতে মিশন স্কুলের বাচ্চাদের সঙ্গে

নাজমুন নাহার : যেখানেই কোনো সমস্যা দেখেছি, সেখানে আমাকে কৌশলী হতে হয়েছে। যেখানে বিপদের আশঙ্কা দেখেছি সেখানে সতর্ক হয়েছি। ব‌্যাস এটুকুই।

নাজমুন নাহার : যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক পিস টর্চ বিয়ারা আওয়ার্ড। অনন্যা শীর্ষ দশ সম্মাননা, গেম চেঞ্জার অ্যাওয়ার্ড, মিস আর্থ কুইন অ্যাওয়ার্ড, জাম্বিয়া সরকারের গভর্নর হ্যারিয়েট কায়োনার কাছ থেকে ‘ফ্ল্যাগ গার্ল’ উপাধি, অতীশ দীপঙ্কর গোল্ড মেডেল সম্মাননা, জনটা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, তিন বাংলা সম্মাননা, রেড ক্রিসেন্ট মোটিভেশনাল অ্যাওয়ার্ড, সফল নারী সম্মাননা, লক্ষ্মী তারুণ্য সম্মাননাসহ দেশে-বিদেশে মোট পঞ্চাশটির মতো সম্মাননা। এছাড়া, বিভিন্ন সময়ে শিরোনাম হয়েছি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিখ্যাত গণমাধ্যমের।  এগুলোও আমার কাছে এক একটি সম্মাননা।

নাজমুন নাহার : এখন শুধু একটি পরিকল্পনা। বাংলাদেশের পতাকাকে পৃথিবীর ২০০টি দেশে পৌঁছে দেওয়া। পাশাপাশি আমি ভ্রমণ বিষয়ক বই লিখে যাচ্ছি। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও বাংলাদেশের পতাকা হাতে বেড়িয়ে পরবো। জাতিসংঘের প্রতিটি দেশ ভ্রমণের মাধ্যমে পৃথিবীর সঙ্গে বাংলাদেশকে পরিচিত করিয়ে দেবো। প্রতিটি দেশে বাংলাদেশের পতাকা ওড়বে। সেখানে আমি শান্তির বার্তা পৌঁছে দেবো— এই আমার প্রত্যাশা।

উল্লেখ‌্য, নাজমুন একজন ভূগোলবিদ, গবেষক, চিন্তাবিদ, লেখক এবং শান্তির দূত হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি উদ্বুদ্ধকরণ বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি তরুণদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর