ঢাকা ০১:০৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২৫, ৩ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ধর্ষণপ্রবণতা বাড়াচ্ছে মাদক ও পর্নোগ্রাফি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:২৭:১৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ অক্টোবর ২০২০
  • ১৫৩ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনে রেকর্ড হতে চলেছে দেশে। হঠাত্ যেন মানুষের পাশবিক প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। একের পর এক ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও কোনোভাবেই যেন এর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে, চলন্ত বাসে, এমনকি নিজের ঘরে পর্যন্ত নেই নিরাপত্তা।

মনোবিজ্ঞানিরা বলেন, অতৃপ্ত যৌন আকাঙ্খা, দেয়ালে নগ্ন পোস্টার, যৌন উত্তেজক অবৈধ বইয়ের রমরমা ব্যবসা, অশ্লীল ছায়াছবি প্রদর্শন, ব্লু-ফিল্ম, চলচ্চিত্রে নারীকে ধর্ষণের দৃশ্যের মাধ্যমে সমাজে ধর্ষণ করার উত্সাহ যোগান, নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার, ইন্টারনেটে অশ্লীল সাইটগুলো উম্মুক্ত করে দেওয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, ১৮ প্লাস চ্যানেলে নীল ছবি প্রদর্শন, যৌন উত্তেজক মাদক ইয়াবার বহুল প্রসার ইত্যাদি কারণে দিন দিন ধর্ষণ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ধর্ষণ মহামারী রূপ নেবে। নারীর প্রতি একের পর এক সহিংস ঘটনার পেছনে আরেকটি বড় কারণ হিসেবে কেউ কেউ বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করেছেন।

চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এমএন হুদা জানান, প্রায় ঘরে ইয়াবাসহ মাদক সেবন ও বিক্রি হচ্ছে। মাদক সাময়িক যৌন উত্তেজনা ঘটায়। আচরণে পরিবর্তন করে। তখন মানুষ নরপশু হয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটায়। তবে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক সাময়িক যৌন উত্তেজনা বাড়ালেও দীর্ঘস্থায়ীভাবে যৌনক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। তিনি আরো বলেন, ধর্ষণের ঘটনা বাড়ার আরেকটি কারণ হলো পর্ণোগ্রাফি। শিশুদের কাছে এখন অত্যাধুনিক মোবাইল ফোন। তারা সহজেই পর্ণোসাইটে যেতে পারছে। শিশুদের ভবিষ্যতের জন্য পর্ণোসাইটগুলো বন্ধ করা উচিত।

প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মুহিত কামাল বলেন, কোভিড-১৯ এর কারণে এখন মানুষ ঘরে থাকে এবং পর্ণোগ্রাফি দেখে। এতে অনেক পুরুষ যৌন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও ক্লাস বন্ধ, তারাও পর্ণোগ্রাফি দেখে। ২০ হাজারের উপরে পর্ণোসাইট আছে। এছাড়া মাদকের কারণে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। তিনি বলেন, মাদকাসক্ত ও ধর্ষকের বিচারের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ার আরেকটি কারণ। তিনি আরো বলেন, অ্যালকোহল ও ইয়াবা আসক্তরা বিকারগ্রস্ত হয়ে যায়। অনেকে যৌন সম্পর্ক করতে করতে নারীকে গলাটিপে হত্যা করে ফেলে।

সম্প্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন এবং সেটার ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এসব ঘটনার পেছনে ত্রুটিপূর্ণ পারিবারিক শিক্ষা, নারীকে হীন করে দেখার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং দীর্ঘদিন ধরেই বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভিডিও চিত্রে দুর্বৃত্ত যাদের দেখা গেছে, তাদের বেশিরভাগের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে বলে অনুমান করা হচ্ছে। কৈশোর থেকে সদ্য তারুণ্যে পা দেয়া এই বয়সটিতে ক্ষমতা প্রদর্শনের এক ধরণের মানসিকতা কাজ করে বলে জানান মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির যে জোয়ার উঠেছে সেটার কোন নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি না থাকায় কিশোর ও তরুণরা নৈতিক শিক্ষা থেকে ক্রমশ ছিটকে পড়ছে বলেও তারা উল্লেখ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইম্যান এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বলেন, ধর্ষণের জন্য শুধুমাত্র দু’একটি কারণ দায়ী নয়, কারণ হিসেব করতে গেলে বহুমাত্রিক কারণ আমরা খুজে পাবো। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, নারীর জন্য তৈরী হওয়া নীতিমালা, গতানুগতিক চিন্তাধারা, দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা বিচারহীনতা ও বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা, পর্ণোগ্রাফির ছড়াছড়ি ইত্যাদি ধর্ষণের কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। নারী সুরক্ষার আইন ও নীতিমালার বিষয়ে তিনি বলেন, কাগজে-কলমে নারীর সুরক্ষার জন্য আইন ও নীতিমালার দিক থেকে আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় সবার চাইতে এগিয়ে আছি, এটি আমাদের গর্বের জায়গা। কিন্তু এসব নীতিমালা ও আইনের বাস্তবিক প্রয়োগ প্রকৃতপক্ষে হচ্ছে না। যাদের শাস্তি পাওয়া উচিত, যেভাবে শাস্তি পাওয়া উচিত তারা সেভাবে শাস্তির মুখোমুখি হয়নি। ফলে মানুষের মাঝে ধর্ষণের পর শাস্তি ভীতি থাকে না।

ধর্ষণের ঘটনা যখন ঘটে তখন আশপাশের মানুষ তা প্রতিহত করতে পারে কিনা এমন প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, মানুষ চাইলে প্রতিহত করতে পারে। কিন্তু তারা মনে করে এ ধরনের ঘটনায় জড়িয়ে পুলিশি ঝামেলায় কেউ পড়তে চায় না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সব ধরনের আইন আছে। কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। রাজনৈতিক প্রভাব, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ইত্যাদির কারণে এসব আইনের প্রয়োগ সম্ভব হয় না।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

ধর্ষণপ্রবণতা বাড়াচ্ছে মাদক ও পর্নোগ্রাফি

আপডেট টাইম : ১০:২৭:১৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ অক্টোবর ২০২০

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনে রেকর্ড হতে চলেছে দেশে। হঠাত্ যেন মানুষের পাশবিক প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। একের পর এক ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও কোনোভাবেই যেন এর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে, চলন্ত বাসে, এমনকি নিজের ঘরে পর্যন্ত নেই নিরাপত্তা।

মনোবিজ্ঞানিরা বলেন, অতৃপ্ত যৌন আকাঙ্খা, দেয়ালে নগ্ন পোস্টার, যৌন উত্তেজক অবৈধ বইয়ের রমরমা ব্যবসা, অশ্লীল ছায়াছবি প্রদর্শন, ব্লু-ফিল্ম, চলচ্চিত্রে নারীকে ধর্ষণের দৃশ্যের মাধ্যমে সমাজে ধর্ষণ করার উত্সাহ যোগান, নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার, ইন্টারনেটে অশ্লীল সাইটগুলো উম্মুক্ত করে দেওয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, ১৮ প্লাস চ্যানেলে নীল ছবি প্রদর্শন, যৌন উত্তেজক মাদক ইয়াবার বহুল প্রসার ইত্যাদি কারণে দিন দিন ধর্ষণ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ধর্ষণ মহামারী রূপ নেবে। নারীর প্রতি একের পর এক সহিংস ঘটনার পেছনে আরেকটি বড় কারণ হিসেবে কেউ কেউ বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করেছেন।

চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এমএন হুদা জানান, প্রায় ঘরে ইয়াবাসহ মাদক সেবন ও বিক্রি হচ্ছে। মাদক সাময়িক যৌন উত্তেজনা ঘটায়। আচরণে পরিবর্তন করে। তখন মানুষ নরপশু হয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটায়। তবে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক সাময়িক যৌন উত্তেজনা বাড়ালেও দীর্ঘস্থায়ীভাবে যৌনক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। তিনি আরো বলেন, ধর্ষণের ঘটনা বাড়ার আরেকটি কারণ হলো পর্ণোগ্রাফি। শিশুদের কাছে এখন অত্যাধুনিক মোবাইল ফোন। তারা সহজেই পর্ণোসাইটে যেতে পারছে। শিশুদের ভবিষ্যতের জন্য পর্ণোসাইটগুলো বন্ধ করা উচিত।

প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মুহিত কামাল বলেন, কোভিড-১৯ এর কারণে এখন মানুষ ঘরে থাকে এবং পর্ণোগ্রাফি দেখে। এতে অনেক পুরুষ যৌন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও ক্লাস বন্ধ, তারাও পর্ণোগ্রাফি দেখে। ২০ হাজারের উপরে পর্ণোসাইট আছে। এছাড়া মাদকের কারণে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। তিনি বলেন, মাদকাসক্ত ও ধর্ষকের বিচারের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ার আরেকটি কারণ। তিনি আরো বলেন, অ্যালকোহল ও ইয়াবা আসক্তরা বিকারগ্রস্ত হয়ে যায়। অনেকে যৌন সম্পর্ক করতে করতে নারীকে গলাটিপে হত্যা করে ফেলে।

সম্প্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন এবং সেটার ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এসব ঘটনার পেছনে ত্রুটিপূর্ণ পারিবারিক শিক্ষা, নারীকে হীন করে দেখার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং দীর্ঘদিন ধরেই বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভিডিও চিত্রে দুর্বৃত্ত যাদের দেখা গেছে, তাদের বেশিরভাগের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে বলে অনুমান করা হচ্ছে। কৈশোর থেকে সদ্য তারুণ্যে পা দেয়া এই বয়সটিতে ক্ষমতা প্রদর্শনের এক ধরণের মানসিকতা কাজ করে বলে জানান মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির যে জোয়ার উঠেছে সেটার কোন নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি না থাকায় কিশোর ও তরুণরা নৈতিক শিক্ষা থেকে ক্রমশ ছিটকে পড়ছে বলেও তারা উল্লেখ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইম্যান এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বলেন, ধর্ষণের জন্য শুধুমাত্র দু’একটি কারণ দায়ী নয়, কারণ হিসেব করতে গেলে বহুমাত্রিক কারণ আমরা খুজে পাবো। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, নারীর জন্য তৈরী হওয়া নীতিমালা, গতানুগতিক চিন্তাধারা, দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা বিচারহীনতা ও বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা, পর্ণোগ্রাফির ছড়াছড়ি ইত্যাদি ধর্ষণের কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। নারী সুরক্ষার আইন ও নীতিমালার বিষয়ে তিনি বলেন, কাগজে-কলমে নারীর সুরক্ষার জন্য আইন ও নীতিমালার দিক থেকে আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় সবার চাইতে এগিয়ে আছি, এটি আমাদের গর্বের জায়গা। কিন্তু এসব নীতিমালা ও আইনের বাস্তবিক প্রয়োগ প্রকৃতপক্ষে হচ্ছে না। যাদের শাস্তি পাওয়া উচিত, যেভাবে শাস্তি পাওয়া উচিত তারা সেভাবে শাস্তির মুখোমুখি হয়নি। ফলে মানুষের মাঝে ধর্ষণের পর শাস্তি ভীতি থাকে না।

ধর্ষণের ঘটনা যখন ঘটে তখন আশপাশের মানুষ তা প্রতিহত করতে পারে কিনা এমন প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, মানুষ চাইলে প্রতিহত করতে পারে। কিন্তু তারা মনে করে এ ধরনের ঘটনায় জড়িয়ে পুলিশি ঝামেলায় কেউ পড়তে চায় না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সব ধরনের আইন আছে। কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। রাজনৈতিক প্রভাব, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ইত্যাদির কারণে এসব আইনের প্রয়োগ সম্ভব হয় না।