‘২৫ বছরের মধ্যে ধানের মুখ চোখে দেখিনি। এবার ধান দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। বিলে নোনা পানি প্রবেশ বন্ধ করা, সরকারী খালগুলো উন্মুক্ত না করতো তাহলে এবারও হয়তো ধানের মুখ চোখে দেখতাম না’-বলছিলেন জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা গ্রামের ভৈরব চন্দ্র মন্ডল (৫০)।
তিনি শোভনার ২৬ নম্বর পোল্ডারের গোপালপুর বিলে ৪ বিঘা জমিতে আমন ধান চাষ করেছেন। শুধু তিনি নন, একই গ্রামের কানাই লাল মল্লিক, শিবপুর গ্রামের আমজাদ শেখের চোখে মুখে হাসি। আমন ধানের চেহারা দেখে সকলেই আবেগে আপ্লুত। অথচ গত বছরও তারা এই বিলে ধানের চাষ করতে পারেননি।
ডুমুরিয়া সদর থেকে খুলনা-সাতক্ষীরা সড়ক ধরে নতুন রাস্তার মোড় হয়ে ছয় কিলোমিটার দক্ষিণে গেলে দেখা মেলে শোভনা ইউনিযনের। সেখান থেকে আরও এগোলে শাখাবাই নদী। এক সময়ে এই নদী থেকে নোনা পানি তুলে সারা বছর আটকে রেখে এখানকার বিলেগুলোতে ধান ও সবজি হতো না। এখন সেখানেই সবুজের মেলা বসেছে।
শোভনা ইউনিয়নের কুলতলা গ্রামের রবীন মল্লিক বললেন, জমি রয়েছে অনেক। কিন্তু খর্নিয়া হাটের চাল ছাড়া পেটে ভাত পড়তো না। বিলে নোনা পানিতে থাকতো সয়লাব। খাল জলাশয়গুলো প্রভাবশালীরা আটকে রেখে সেখানে চিংড়ি চাষ করতো। বিলের পানি বের হতে পারতো না। রবীন মন্ডল জানালেন; ৪ বিঘা জমিতে ধান , মাছ, ও ঘেরের আইলে সবজির আবাদ করেছেন।
Khulna
ডুমুরিয়ার শোভনা ইউনিয়নের বালুইঝাকি বিলে মাছের ঘেরের আইলে টমেটো ক্ষেতের পরিচর্যায় ব্যস্ত কুলতলা গ্রামের কৃষক রবীন্দ্রনাথ মল্লিক
শোভনা গ্রামের কানাই লাল মল্লিক (৫০) বললেন, চেয়ারম্যান সরদার আব্দুল গনির ঐকান্তিক চেষ্টায় বিলের অভ্যন্তরের খাল নালাগুলোর সংস্কার হয়েছে। ভরাট হয়ে যাওয়া ৪টি খাল খনন করা হয়েছে। পানি সরানোর প্রতিবন্ধক খালে দেয়া নেট পাটাও তিনি অপসারণ করতে পেরেছেন। তাই অতি বৃষ্টিতেও এবার জলাবদ্ধতা দেখা দেয়নি।
শিবপুর গ্রামের বিশ্বজিত হালদার (৫২) বললেন ; ৩ বিঘা জমিতে আমন মৌসুমে বিআর ২৩ জাতের ধান লাগিয়েছেন। ধানের অবস্থা খুব ভাল। যা ফলন হবে তাতে এবার খাদ্যের চাহিদা মিটবে।
শিবপুর গ্রামের বিশ্বজিত হালদার বললেন, ২৬ নম্বর পোল্ডারে নিজের ৩২ বিঘা জমি থাকার পর ৫ জনের সংসারে চালের চাহিদা মিটতো না। বাজার থেকে চাল কিনতে হতো। ১০ বছর ধান না হওয়ায় জমি বিক্রি করে সংসার চালিয়েছি। কিন্তু এবার যে ধান হয়েছে তাতে আর অভাব থাকবে না।
বলাবুনিয়া গ্রামের অনিমেষ মন্ডল মাছের ঘেরের আইলে টমেটো রোপন করে আয় করেছেন শোভনা গ্রামের মনীন্দ্রনাথ মলি¬ক (৬০) বললেন, বছর দশেক ধানের মুখ চোখে দেখিনি। বিলে লাঙ্গল জোয়াল নিতে পারিনি। প্রভাবশালী চিংড়ি চাষীরা বিলে নোনা পানি প্রবেশ করিয়ে রাখতো। তাদের কথা ছিল ধান না হয়, না হোক চিংড়ির যেন ক্ষতি না হয়। তাই তারা বিলে নোনা পানি আটকে রাখত।
অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক চিত্তরঞ্জন চক্রবর্তী বললেন, ভদ্রা নদী ভরাট হয়েছে। ঘ্যাংরাইল নদীতে ২৬ নম্বর পোল্ডারের পানি নিষ্কাশিত হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত স্লুইস গেট নেই। আরও ২-৩টি স্লুইসগেট নির্মাণ করে বিলের অভ্যন্তরের খালগুলো সংস্কার করা হলে বিলে আর জলাবদ্ধ হওয়ার সুযোগ থাকবে না।
Khulna
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা ইউনিয়নের শোভনা গ্রামের কৃষক সুভাষ চন্দ্র বোস শশা ক্ষেতে পরিচর্যায় ব্যস্ত
শোভনা গ্রামের সুভাষ বোস ২ বিঘা জমিতে শশা ও বেগুণের আবাদ করেছেন। তার খরচ হয়েছে প্রায় ১ লাখ টাকা। তিনি বেগুণ ও শশা বিক্রি করে প্রায় ৩ লাখ টাকা পাবেন বলে আশা করছেন। তিনি বলেন,মাত্র আড়াই থেকে তিন মাসে এই টাকা আয় করতে পারবেন।
মণিশঙ্কর হালদার জানান, তিনি ১০ কাঠা জমিতে ডাটা শাঁক রোপন করেছেন। খরচ হয়েছে মাত্র ২ হাজার টাকা। বিক্রি হবে প্রায় ৫০ হাজার টাকা।
শোভনা ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো: আলতাফ হোসেন জানান, এই ইউনিয়নে মোট আবাদযোগ্য জমি ২ হাজার ৭১০ হেক্টও ( ১ হেক্টর= ২.৪৭ একর) ওই জমিতে আমন, বোরো, সবজির আবাদ হয়। যার মধ্যে ৪০০ হেক্টও জমিতে সবজির আবাদ হয়। যা বিক্রি হয় প্রায় ২ কেটি টাকা। তিনি বলেন, গত ৭-৮ বছর আগেও এখানে সবজির আবাদ করা সম্ভব হত না। বিল এলাকা ছিল নোনা পানি। আর নোনা পানিতে কৃষিজ পন্য ভাল ফলন হয় না। কিন্তু গত ৪-৫ বছর এই ইউনিয়নে কৃষিতে বিপ্লব ঘঠেছে।
শোভনা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সরদার আব্দুল গনি বললেন, ২৬ নম্বর পোল্ডারে বিগত ১০ বছর ফসল হতো না। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিল এলাকায় নোনাপানি প্রবেশ করে চিংড়ি চাষ করতো। এমনকি বিলের মধ্যে নেট পাটা দিয়ে রাখতো এতে বিলের পানি সহজে বের হতে পারতো না। বৃষ্টির সময়ে জলাবদ্ধ থাকতো। তাই জনগণকে সাথে নিয়ে বাঁধ পাটা অপসারণ করা হয়েছে।
এছাড়া বিলের অভ্যন্তরে নোনা পানি প্রবেশও বন্ধ করা হয়েছে। ফলে এই পোল্ডারের ২০টি বিলে ৫০ হাজার একর জমিতে আমন মৌসুমে ধানের ব্যাপক ফলন হয়েছে। গোটা শোভনা ইউনিয়নে আগে যেখানে কাজের সন্ধ্যানে এলাকার বাইরে যেতে হত আর এখন প্রায় প্রতিটি পরিবাওে স্বচ্ছলতা রয়েছে। তিনি বলেন জনগণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাধ পাটা অপসারণ ও নোনা পানি অপসারণ করা সম্ভব হয়েছে।
এ বিলের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা শাখাবাই নদী, শিবপুর ও গোপালনগর খাল খনন করা হয়েছে। এতে অতিবৃষ্টিতেও বিলে পানি জমেনি, নিষ্কাশিত হতে পেরেছে।