ঢাকা ০৯:৫৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বোমা নয় নববর্ষের আতশবাজি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০২:৪৩:৫৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ জানুয়ারী ২০১৬
  • ৫৭২ বার

`সিন চুন খোয়াইলা` কথাটা শুনে প্রথমে বেশ খটমটে মনে হলেও চীনারা এটা বলে চমৎকার এক সুরে। সুরটা আমিও রপ্ত করে নিলাম। না নিয়েই বা উপায় কি? নববর্ষে কথাটা চেনা-অচেনা অনেকের কাছ থেকে শুনতে যেমন হচ্ছে তেমনি বলতেও হচ্ছে। ‘সিন চুন খোয়াইলা’ মানে বসন্ত উৎসবের অভিনন্দন। চীনে নতুন বছর শুরু হয় বসন্ত উৎসব দিয়ে। বসন্ত উৎসব বলতে সবুজ পাতা, পাখির গান মনে হলেও তা কিন্তু নয়। চীনে নতুন বছর বা বসন্ত উৎসব শুরু হয় ঘোর শীতের মধ্যে। চারিদিকে তুষার। এরই মধ্যে শুরু হয় নতুন বছরের উৎসব যার নাম বসন্ত উৎসব। একে নববর্ষ বা ‘নিয়ান চিয়ে’ বলা হয়। নববর্ষ উৎসবের অনেক নাম। কেউ বলে কুয়ো নিয়েন, কেউ বলে নংলি শিননিয়েন, কেউ বলে ছুন চিয়ে বা বসন্ত উৎসব। বসন্ত উৎসব চীনের সবচেয়ে বড় উৎসব। এ সময় চীনারা সব ঘরমুখী হয়। বসন্ত উৎসবে বাড়ি না ফিরলে অমঙ্গল হয়।

২০১১-১২ সাল আমার চীনে কেটেছে কর্মসূত্রে। সেই সময় বসন্ত উৎসবে অংশ নেওয়ার সুযোগ হলো। জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে শুরু হলো এই উৎসব। অনেকেই জানেন চীনের বছর হলো চান্দ্র বৎসর। আর ওদের একেকটা বৎসর একেকটা রাশির প্রতীক। ১২ বছর পর পর রাশিগুলো ঘুরে ঘুরে আসে। ২০১২ সালে শুরু হলো ড্রাগন বর্ষ। তাই সে বছর দেখলাম ড্রাগনের ছবি, খেলনা আর প্রতীকের ছড়াছড়ি।

চীনাদের নববর্ষ উদযাপনের বেশ মজার গল্প আছে। চীনা উপকথা অনুযায়ী নিয়ান হলো এক পৌরাণিক জন্তু। সে খুবই ভয়ানক। নববর্ষের প্রথম দিনে নিয়ান গ্রামে এসে সব পশু, শস্য খেয়ে ফেলতো। নিয়ান এমনকি গ্রামবাসী বিশেষ করে শিশুদেরও খেয়ে ফেলতো। এ জন্য গ্রামবাসী নিয়ানের জন্য খাদ্য তৈরি করে দরজার সামনে রেখে দিত। তৈরি খাদ্য পেলে নিয়ান আর শিশুদের খেত না। তারপর এক নববর্ষে নিয়ান গ্রামে এল। লাল কাপড় পরা একটি শিশু সে সময় তার সামনে পড়লো। নিয়ান লাল পোশাক পরা শিশুটিকে দেখে ভয়ে চিৎকার করে পালিয়ে গেল। তখন গ্রামবাসী বুঝতে পারল নিয়ান লাল রং ভয় পায়। তখন থেকে চীনের মানুষ নিয়ানকে ভয় দেখানোর জন্য দরজা-জানালায় মন্ত্র লেখা লাল কাগজ ঝুলিয়ে রাখে বা আঠা দিয়ে সেঁটে রাখে। লাল লণ্ঠনও ঝুলানো হয়। আর নিজেরাও লাল কাপড় পরে। তাই নিয়ান আর কখনো গ্রামে আসে না। নিয়ান ও অন্যান্য অশুভ প্রেতাত্মাকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর জন্য এ সময় বাজি পোড়ানোর নিয়ম রয়েছে। বাজির শব্দ আর আলোতে নাকি প্রেতাত্মারা ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। বাজি পোড়ানো হয় প্রায় পনেরো দিন ধরে। নববর্ষের রাত ১২ টায় শুরু হয় মূল আতশবাজির খেলা আর শেষ দিন অর্থাৎ ১৫ দিনের দিন সন্ধ্যায় অসংখ্য বাজি পোড়ানো হয়।

সে যে কী ব্যাপার তা না দেখলে বলে বোঝানো কঠিন! নববর্ষের কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয় বাজির ধুম। নববর্ষের কয়েকদিন আগে সন্ধ্যায় আমি আমার ঘরে বসে লেখাতে ব্যস্ত। এমন সময় পিলে চমকানো বিকট ধুম ধাড়াক্কা শব্দে চমকে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। একই এপার্টমেন্টে থাকি আমরা তিন জন। একজন রোমানিয়ান নারী নিনা গেরমান আরেকজন পোল্যান্ডের তরুণী আগাথা। যার যার বেডরুম থেকে ছুটে বেরিয়ে আমরা লিভিংরুমের বিরাট জানালার কাছে গিয়ে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছি বিষয়টা কি। আমি ভাবছি গুলি ছুঁড়ছে নাকি কেউ। নাকি বোমা পড়ছে কোথাও। আগাথা তো বিড়বিড় করে বলতে লাগল ‘হ্যাজ দ্য থার্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার স্টারটেড?’ একটু পর বুঝলাম- না গোলাগুলি নয় আতশবাজি।

নববর্ষের রাত ১২টায় যে কাণ্ডটা হলো তা অবর্ণনীয়। আশেপাশের বিভিন্ন বাড়ি আর অ্যাপার্টমেন্ট ভবন থেকে শুরু হলো অজস্র আতশবাজি পোড়ানো। সারা আকাশ রঙিন আলোয় ভরে উঠতে লাগলো ক্ষণে ক্ষণে। কত রঙের আর কত ধরনের যে বাজি তা বলে শেষ করা যাবে না। ফল্গুধারার মতো আগুন আর রঙের খেলা। রাস্তায় বিদেশী, চীনা, ছেলে, বুড়ো, নারী-পুরুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে দেখছে এই অপূর্ব খেলা। কনকনে শীত। মাইনাস ১২ বা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হাত-পা জমে যাচ্ছে ঠাণ্ডায়। তবু ঘরে ফিরতে মন চাচ্ছে না কারও। আতশবাজির এমন অপূর্ব খেলা দেখে তো আমি আনন্দে আত্মহারা। এরই ফাঁকে অর্থনীতি বিশারদ সহকর্মী সাংবাদিক শিহাবুর রহমান জানিয়ে দিলেন কত শত কোটি টাকার বাজি পোড়ানো হচ্ছে। ধোঁয়া আর বারুদের গন্ধে শ্বাস নেওয়া দায়। কান ফেটে যাচ্ছে আওয়াজে। আগাথা বললো, যে পরিমাণ বায়ুদূষণ হচ্ছে তাতে ওজন স্তরে কয়েকটি ছিদ্র আজই হবে। পুরো পৃথিবীর পরিবেশ দূষণ ঘটাতে নাকি চীনের নববর্ষই যথেষ্ট।

এদিকে শিহাবুর রহমান আবার হিসেব করে দেখাচ্ছেন, যে পরিমাণ অর্থের অপচয় হচ্ছে ভূত তাড়ানোর জন্য তা দিয়ে বিশ্বের কতজন মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল। বাজি পোড়ানোর কারণে অনেক সময় নাকি অগ্নিকাণ্ডও ঘটে শহরে। এ জন্য ফায়ার ব্রিগেড সতর্ক থাকে। তারপরও প্রতিবছর আগুন লেগে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। চীনা সরকার এ জন্য বাজি পোড়ানো নিরুৎসাহিত করছে আজকাল। বাজির পরিবর্তে লাউড স্পিকারে শব্দ সৃষ্টি করা হচ্ছে হুবহু বাজির মতো। এতেও নাকি অশুভ প্রেতাত্মারা একই রকম ভয় পাবে। বায়ুদূষণ, সম্পদ অপচয় সব বুঝলেও আতশবাজির দৃশ্য যে অপূর্ব সুন্দর তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমি তীব্র শীত উপেক্ষা করে সেই অপরূপ দৃশ্য প্রাণভরে দেখলাম। মনে হলো চক্ষু সার্থক।

নববর্ষ উপলক্ষে আমার কর্মস্থল চীন আন্তর্জাতিক বেতার (চীনা ভাষায় কোচি কম্বোডিয়ান থাই) বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। একদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলো। সেখানে বাংলা বিভাগের চীনা ও বাঙালি কর্মীরা বাংলা গান গেয়ে শোনালেন। শিহাব আমাদের লিড গায়ক। তার কণ্ঠ ভালো। তবে ঠেকায় পড়ে আমার মতো বেসুরো মানুষকেও কোরাসে যোগ দিতে হলো।
নববর্ষ উপলক্ষে উপহার দেওয়ার রীতি রয়েছে। সাধারণত লাল খামে করে টাকা উপহার দেওয়া হয়। আমরাও উপহার পেলাম চীন বেতারের কাছ থেকে। তবে টাকা নয়, বাস্কেট ভরা বাদাম, পেস্তা, কিসমিস আর অন্যান্য শুকনো ফল। নববর্ষে শপিং মলে নানারকম খেলনা আর লাল কাগজ বিক্রির ধুম। কাগজের তৈরি চীনা লণ্ঠন ঝুলছে বাড়িতে বাড়িতে। আমি নিজেও ঘর সাজালাম এসব খেলনা দিয়ে।

নববর্ষ উৎসবের অংশ হিসেবেই এক সন্ধ্যায় যেতে হলো সিসি টিভি টাওয়ারে। এটি চীনের কেন্দ্রীয় টিভি ও রেডিও টাওয়ার। ৪০৫ মিটার উঁচু টাওয়ার। এটা বেইজিংয়ের সবচেয়ে উঁচু টাওয়ার। এ জন্য একে বেইজিং টাওয়ারও বলা হয়। এখান থেকে পুরো বেইজিং শহর দেখা যায়। ২৩৫ মিটার উঁচুতে একটা বেইজডেক রয়েছে। সেখান থেকে বেইজিং শহরের বিভিন্ন অংশ দেখা যায় টেলিস্কোপের সাহায্যে। এই টাওয়ারের উপর রয়েছে একটি রিভলভিং রেস্টুরেন্ট। এই রেস্টুরেন্ট ধীরে ধীরে ঘোরে। এখানে বুফেতে রয়েছে কয়েক হাজার আইটেম। এই রেস্টুরেন্টে আমাদের মতো শ’খানেক বিদেশী অতিথির উপস্থিতিতে তৈরি হবে ইউয়ান শাও। ইউয়ান শাও এক ধরনের গোলাকার পিঠা। এটা নববর্ষে বিশেষভাবে খাওয়া হয়। আমরা ইউয়ান শাও বানানো দেখলাম, শিখলাম, নিজেরা বানালাম এবং খেলাম। খেতে কেমন? পুর দেওয়া ছোট পিঠার মতো, নেহাত মন্দ নয়। পিঠা তবে তেলে ভাজা নয়, ফুটন্ত পানিতে সেদ্ধ।
সিসিটিভি টাওয়ারে সেদিন বিদেশী অতিথিরা যার যার জাতীয় পোশাক পরে নাচ অথবা গান পরিবেশন করলেন। দেশের সম্মান রাখতে আমাকেও নৃত্য পরিবেশন করতে হলো। ঠেকায় পড়লে মানুষ কি না করে। সেই ছোটবেলায় স্কুলে শেখা নাচ মনে করতে হলো। তবে প্রশংসা পেয়েছিলাম, এটাই যা সান্ত্বনা। পুরো অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হলো সিসিটিভি থেকে।

চীনের নববর্ষে একেকদিন একেক রকম অনুষ্ঠান চলে পনেরো দিন ধরে। এর মধ্যে গৌতম বুদ্ধ, বোধিস্বত্ত মৈত্রেয়র উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠান রয়েছে, রয়েছে কনফুসিয়াস ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠান, আবার রান্না ঘরের দেবতার উদ্দেশ্যেও রয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠান। আরও রয়েছে বিভিন্ন লোকাচার যা সব ধর্মের অনুসারীরাই মেনে চলেন। এমনকি যারা কোনো ধর্ম মানেন না তারাও নববর্ষের পনেরো দিন উৎসব অনুষ্ঠান, লোকাচার, রীতি-রেওয়াজ পালন করেন উৎসাহের সঙ্গে।

নববর্ষের রাতে বিশেষ খাওয়া দাওয়া তো রয়েছেই। নববর্ষের আগে ঘরবাড়ি পরিষ্কার, পূর্ণিমায় লণ্ঠন জ্বালানো, একেকদিন একেক রকম লোকজ খাদ্য পরিবেশন ইত্যাদি রয়েছে নববর্ষ উৎসবের অংশ হয়ে। আর রয়েছে মন্দির মেলা। নববর্ষ উপলক্ষে মেলা বসে শহরের বিভিন্ন স্থানে। এসব মেলার গল্প না হয় আরেকদিন বলবো।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

বোমা নয় নববর্ষের আতশবাজি

আপডেট টাইম : ০২:৪৩:৫৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ জানুয়ারী ২০১৬

`সিন চুন খোয়াইলা` কথাটা শুনে প্রথমে বেশ খটমটে মনে হলেও চীনারা এটা বলে চমৎকার এক সুরে। সুরটা আমিও রপ্ত করে নিলাম। না নিয়েই বা উপায় কি? নববর্ষে কথাটা চেনা-অচেনা অনেকের কাছ থেকে শুনতে যেমন হচ্ছে তেমনি বলতেও হচ্ছে। ‘সিন চুন খোয়াইলা’ মানে বসন্ত উৎসবের অভিনন্দন। চীনে নতুন বছর শুরু হয় বসন্ত উৎসব দিয়ে। বসন্ত উৎসব বলতে সবুজ পাতা, পাখির গান মনে হলেও তা কিন্তু নয়। চীনে নতুন বছর বা বসন্ত উৎসব শুরু হয় ঘোর শীতের মধ্যে। চারিদিকে তুষার। এরই মধ্যে শুরু হয় নতুন বছরের উৎসব যার নাম বসন্ত উৎসব। একে নববর্ষ বা ‘নিয়ান চিয়ে’ বলা হয়। নববর্ষ উৎসবের অনেক নাম। কেউ বলে কুয়ো নিয়েন, কেউ বলে নংলি শিননিয়েন, কেউ বলে ছুন চিয়ে বা বসন্ত উৎসব। বসন্ত উৎসব চীনের সবচেয়ে বড় উৎসব। এ সময় চীনারা সব ঘরমুখী হয়। বসন্ত উৎসবে বাড়ি না ফিরলে অমঙ্গল হয়।

২০১১-১২ সাল আমার চীনে কেটেছে কর্মসূত্রে। সেই সময় বসন্ত উৎসবে অংশ নেওয়ার সুযোগ হলো। জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে শুরু হলো এই উৎসব। অনেকেই জানেন চীনের বছর হলো চান্দ্র বৎসর। আর ওদের একেকটা বৎসর একেকটা রাশির প্রতীক। ১২ বছর পর পর রাশিগুলো ঘুরে ঘুরে আসে। ২০১২ সালে শুরু হলো ড্রাগন বর্ষ। তাই সে বছর দেখলাম ড্রাগনের ছবি, খেলনা আর প্রতীকের ছড়াছড়ি।

চীনাদের নববর্ষ উদযাপনের বেশ মজার গল্প আছে। চীনা উপকথা অনুযায়ী নিয়ান হলো এক পৌরাণিক জন্তু। সে খুবই ভয়ানক। নববর্ষের প্রথম দিনে নিয়ান গ্রামে এসে সব পশু, শস্য খেয়ে ফেলতো। নিয়ান এমনকি গ্রামবাসী বিশেষ করে শিশুদেরও খেয়ে ফেলতো। এ জন্য গ্রামবাসী নিয়ানের জন্য খাদ্য তৈরি করে দরজার সামনে রেখে দিত। তৈরি খাদ্য পেলে নিয়ান আর শিশুদের খেত না। তারপর এক নববর্ষে নিয়ান গ্রামে এল। লাল কাপড় পরা একটি শিশু সে সময় তার সামনে পড়লো। নিয়ান লাল পোশাক পরা শিশুটিকে দেখে ভয়ে চিৎকার করে পালিয়ে গেল। তখন গ্রামবাসী বুঝতে পারল নিয়ান লাল রং ভয় পায়। তখন থেকে চীনের মানুষ নিয়ানকে ভয় দেখানোর জন্য দরজা-জানালায় মন্ত্র লেখা লাল কাগজ ঝুলিয়ে রাখে বা আঠা দিয়ে সেঁটে রাখে। লাল লণ্ঠনও ঝুলানো হয়। আর নিজেরাও লাল কাপড় পরে। তাই নিয়ান আর কখনো গ্রামে আসে না। নিয়ান ও অন্যান্য অশুভ প্রেতাত্মাকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর জন্য এ সময় বাজি পোড়ানোর নিয়ম রয়েছে। বাজির শব্দ আর আলোতে নাকি প্রেতাত্মারা ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। বাজি পোড়ানো হয় প্রায় পনেরো দিন ধরে। নববর্ষের রাত ১২ টায় শুরু হয় মূল আতশবাজির খেলা আর শেষ দিন অর্থাৎ ১৫ দিনের দিন সন্ধ্যায় অসংখ্য বাজি পোড়ানো হয়।

সে যে কী ব্যাপার তা না দেখলে বলে বোঝানো কঠিন! নববর্ষের কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয় বাজির ধুম। নববর্ষের কয়েকদিন আগে সন্ধ্যায় আমি আমার ঘরে বসে লেখাতে ব্যস্ত। এমন সময় পিলে চমকানো বিকট ধুম ধাড়াক্কা শব্দে চমকে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। একই এপার্টমেন্টে থাকি আমরা তিন জন। একজন রোমানিয়ান নারী নিনা গেরমান আরেকজন পোল্যান্ডের তরুণী আগাথা। যার যার বেডরুম থেকে ছুটে বেরিয়ে আমরা লিভিংরুমের বিরাট জানালার কাছে গিয়ে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছি বিষয়টা কি। আমি ভাবছি গুলি ছুঁড়ছে নাকি কেউ। নাকি বোমা পড়ছে কোথাও। আগাথা তো বিড়বিড় করে বলতে লাগল ‘হ্যাজ দ্য থার্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার স্টারটেড?’ একটু পর বুঝলাম- না গোলাগুলি নয় আতশবাজি।

নববর্ষের রাত ১২টায় যে কাণ্ডটা হলো তা অবর্ণনীয়। আশেপাশের বিভিন্ন বাড়ি আর অ্যাপার্টমেন্ট ভবন থেকে শুরু হলো অজস্র আতশবাজি পোড়ানো। সারা আকাশ রঙিন আলোয় ভরে উঠতে লাগলো ক্ষণে ক্ষণে। কত রঙের আর কত ধরনের যে বাজি তা বলে শেষ করা যাবে না। ফল্গুধারার মতো আগুন আর রঙের খেলা। রাস্তায় বিদেশী, চীনা, ছেলে, বুড়ো, নারী-পুরুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে দেখছে এই অপূর্ব খেলা। কনকনে শীত। মাইনাস ১২ বা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হাত-পা জমে যাচ্ছে ঠাণ্ডায়। তবু ঘরে ফিরতে মন চাচ্ছে না কারও। আতশবাজির এমন অপূর্ব খেলা দেখে তো আমি আনন্দে আত্মহারা। এরই ফাঁকে অর্থনীতি বিশারদ সহকর্মী সাংবাদিক শিহাবুর রহমান জানিয়ে দিলেন কত শত কোটি টাকার বাজি পোড়ানো হচ্ছে। ধোঁয়া আর বারুদের গন্ধে শ্বাস নেওয়া দায়। কান ফেটে যাচ্ছে আওয়াজে। আগাথা বললো, যে পরিমাণ বায়ুদূষণ হচ্ছে তাতে ওজন স্তরে কয়েকটি ছিদ্র আজই হবে। পুরো পৃথিবীর পরিবেশ দূষণ ঘটাতে নাকি চীনের নববর্ষই যথেষ্ট।

এদিকে শিহাবুর রহমান আবার হিসেব করে দেখাচ্ছেন, যে পরিমাণ অর্থের অপচয় হচ্ছে ভূত তাড়ানোর জন্য তা দিয়ে বিশ্বের কতজন মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল। বাজি পোড়ানোর কারণে অনেক সময় নাকি অগ্নিকাণ্ডও ঘটে শহরে। এ জন্য ফায়ার ব্রিগেড সতর্ক থাকে। তারপরও প্রতিবছর আগুন লেগে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। চীনা সরকার এ জন্য বাজি পোড়ানো নিরুৎসাহিত করছে আজকাল। বাজির পরিবর্তে লাউড স্পিকারে শব্দ সৃষ্টি করা হচ্ছে হুবহু বাজির মতো। এতেও নাকি অশুভ প্রেতাত্মারা একই রকম ভয় পাবে। বায়ুদূষণ, সম্পদ অপচয় সব বুঝলেও আতশবাজির দৃশ্য যে অপূর্ব সুন্দর তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমি তীব্র শীত উপেক্ষা করে সেই অপরূপ দৃশ্য প্রাণভরে দেখলাম। মনে হলো চক্ষু সার্থক।

নববর্ষ উপলক্ষে আমার কর্মস্থল চীন আন্তর্জাতিক বেতার (চীনা ভাষায় কোচি কম্বোডিয়ান থাই) বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। একদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলো। সেখানে বাংলা বিভাগের চীনা ও বাঙালি কর্মীরা বাংলা গান গেয়ে শোনালেন। শিহাব আমাদের লিড গায়ক। তার কণ্ঠ ভালো। তবে ঠেকায় পড়ে আমার মতো বেসুরো মানুষকেও কোরাসে যোগ দিতে হলো।
নববর্ষ উপলক্ষে উপহার দেওয়ার রীতি রয়েছে। সাধারণত লাল খামে করে টাকা উপহার দেওয়া হয়। আমরাও উপহার পেলাম চীন বেতারের কাছ থেকে। তবে টাকা নয়, বাস্কেট ভরা বাদাম, পেস্তা, কিসমিস আর অন্যান্য শুকনো ফল। নববর্ষে শপিং মলে নানারকম খেলনা আর লাল কাগজ বিক্রির ধুম। কাগজের তৈরি চীনা লণ্ঠন ঝুলছে বাড়িতে বাড়িতে। আমি নিজেও ঘর সাজালাম এসব খেলনা দিয়ে।

নববর্ষ উৎসবের অংশ হিসেবেই এক সন্ধ্যায় যেতে হলো সিসি টিভি টাওয়ারে। এটি চীনের কেন্দ্রীয় টিভি ও রেডিও টাওয়ার। ৪০৫ মিটার উঁচু টাওয়ার। এটা বেইজিংয়ের সবচেয়ে উঁচু টাওয়ার। এ জন্য একে বেইজিং টাওয়ারও বলা হয়। এখান থেকে পুরো বেইজিং শহর দেখা যায়। ২৩৫ মিটার উঁচুতে একটা বেইজডেক রয়েছে। সেখান থেকে বেইজিং শহরের বিভিন্ন অংশ দেখা যায় টেলিস্কোপের সাহায্যে। এই টাওয়ারের উপর রয়েছে একটি রিভলভিং রেস্টুরেন্ট। এই রেস্টুরেন্ট ধীরে ধীরে ঘোরে। এখানে বুফেতে রয়েছে কয়েক হাজার আইটেম। এই রেস্টুরেন্টে আমাদের মতো শ’খানেক বিদেশী অতিথির উপস্থিতিতে তৈরি হবে ইউয়ান শাও। ইউয়ান শাও এক ধরনের গোলাকার পিঠা। এটা নববর্ষে বিশেষভাবে খাওয়া হয়। আমরা ইউয়ান শাও বানানো দেখলাম, শিখলাম, নিজেরা বানালাম এবং খেলাম। খেতে কেমন? পুর দেওয়া ছোট পিঠার মতো, নেহাত মন্দ নয়। পিঠা তবে তেলে ভাজা নয়, ফুটন্ত পানিতে সেদ্ধ।
সিসিটিভি টাওয়ারে সেদিন বিদেশী অতিথিরা যার যার জাতীয় পোশাক পরে নাচ অথবা গান পরিবেশন করলেন। দেশের সম্মান রাখতে আমাকেও নৃত্য পরিবেশন করতে হলো। ঠেকায় পড়লে মানুষ কি না করে। সেই ছোটবেলায় স্কুলে শেখা নাচ মনে করতে হলো। তবে প্রশংসা পেয়েছিলাম, এটাই যা সান্ত্বনা। পুরো অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হলো সিসিটিভি থেকে।

চীনের নববর্ষে একেকদিন একেক রকম অনুষ্ঠান চলে পনেরো দিন ধরে। এর মধ্যে গৌতম বুদ্ধ, বোধিস্বত্ত মৈত্রেয়র উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠান রয়েছে, রয়েছে কনফুসিয়াস ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠান, আবার রান্না ঘরের দেবতার উদ্দেশ্যেও রয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠান। আরও রয়েছে বিভিন্ন লোকাচার যা সব ধর্মের অনুসারীরাই মেনে চলেন। এমনকি যারা কোনো ধর্ম মানেন না তারাও নববর্ষের পনেরো দিন উৎসব অনুষ্ঠান, লোকাচার, রীতি-রেওয়াজ পালন করেন উৎসাহের সঙ্গে।

নববর্ষের রাতে বিশেষ খাওয়া দাওয়া তো রয়েছেই। নববর্ষের আগে ঘরবাড়ি পরিষ্কার, পূর্ণিমায় লণ্ঠন জ্বালানো, একেকদিন একেক রকম লোকজ খাদ্য পরিবেশন ইত্যাদি রয়েছে নববর্ষ উৎসবের অংশ হয়ে। আর রয়েছে মন্দির মেলা। নববর্ষ উপলক্ষে মেলা বসে শহরের বিভিন্ন স্থানে। এসব মেলার গল্প না হয় আরেকদিন বলবো।