হাওরের অর্থনৈতিক প্রাণ হচ্ছে বোরো ধান। চৈত্রের শেষে কিংবা বৈশাখের প্রথম সপ্তাহে শুরু হয়ে বৈশাখ মাসজুড়ে চলে বোরো ধান কাটার উৎসব। এই ধান ঘরে না তুলা পর্যন্ত কৃষকের মনে স্বস্তি নেই। যে ধান বুনার পর থেকেই হাওরের কৃষকরা সম্ভাবনার স্বপ্ন বুনতে থাকে। কখনো কখনো কালবৈশাখী ঝড়, খরা, বন্যা, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি তাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। ভেস্তে যায় কৃষকের ছেলে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা লাভের সুযোগ। আগাম বন্যায় তাদের লালিত স্বপ্নগুলিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় দু:স্বপ্নের অতল সাগরে।
হাওরে বসবাসরত মানুষ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করেই বেঁচে আছে। বিশেষকরে বর্ষাকালে ঝড়, জলোচ্ছাস, সাইক্লোন হাওরের বেশিরভাগ ঘরবাড়ি লন্ডভণ্ড করে দেয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষিভিত্তিক হাওরের জনজীবনের সংকট তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান, খাদ্য, যোগাযোগ কোনটিই এখনো পরিপূর্ণ আলোকিত নয়।
বাড়িভাঙ্গন হাওর এলাকার একটি বিরাট সমস্যা। বর্ষায় ঢেউয়ের কবল থেকে ঘরবাড়ি রক্ষার জন্য প্রতিবছর হাওরবাসীদের কঠোর পরিশ্রম ও প্রচুর অর্থ খরচ করে বাঁশ ও ঘাসের সাহায্যে প্রতিরক্ষা বাধ নির্মাণ করতে হয়। তারপরও বন্যায় বা আকালে অনেক বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বর্ষার পর ভাঙ্গা বাড়ি পুননির্মাণ করে নদী ও নিয়তির সঙ্গে বসবাস করার সংগ্রামে লিপ্ত হয় হাওরবাসী।
মাছ চাষ, প্রাকৃতিক জলাশয়ে মৎস্য শিকার এবং পশু পালন এই জনপদের মানুষের আরেকটি প্রধান পেশা। দেশের মৎস্য সম্পদের একটি বড় অংশ হাওরেই উৎপাদিত হয়। মোট মাছের ২০ থেকে ২৫ শতাংশের যোগান দেয় হাওর। দেড় কোটি মানুষের জীবন জীবিকা এই মৎস্য সম্পদের উপর নির্ভরশীল। অথচ মৎস্য চাষের উৎস জলমহালগুলো সমাজের প্রভাবশালী বিত্তশালী ব্যক্তিদের দখলে। হাওরাঞ্চলের যে মানুষগুলো খাদ্য উৎপাদনের মূল শক্তি তারাই দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করছে, সমাজে অবহেলিত নিগৃহিত হয়ে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে ঠিকে রয়েছে। হাওরের অসীম সম্ভাবনার বিপরীতে রয়েছে নানাবিধ সমস্যার বেড়াজালে বন্দি বহুল ব্যথিত বাস্তবতা।
প্রকৃত অর্থে হাওর সমস্যার টেকসই সমাধানকল্পে প্রয়োজন এ জনপদের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা এবং পরিবেশ ও প্রাকৃতিক দিক বিবেচনায় নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিক সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ এবং ফসল রক্ষায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন।
হাওর সৌন্দর্যের লীলাভূমি। বর্ষা ও হেমন্তের অপরুপ সাজে সজ্জিত হয়ে ওঠে হাওর প্রান্তর। শীতের প্রারম্ভে হাওরে আসতে থাকে বিচিত্র সব অতিথি পাখি। প্রায় দুইশত প্রজাতির অতিথি পাখির আগমনে পুরো শীতকালে হাওর হয়ে ওঠে প্রাকৃতিক রুপ বৈচিত্র্যের পরিপূর্ণ এক পূণ্যভূমি। রাষ্ট্র যদি হাওরের অপার সম্ভাবনা ও সুযোগকে কাজে লাগায় তাহলে একদিকে যেমন হাওরবাসী উপকৃত হবে তেমনি দেশ অর্থনীতিতে আরো সমৃদ্ধশালী হবে। শত সমস্যার বেড়াজাল ভেদ করে হাওর হয়ে ওঠবে একদিন পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দু। বর্ষাকালে পানিতে আবদ্ধ অলস হাওরবাসীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে পর্যটন সম্ভাবনাময় হাওর।
বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি ১৯৯৬ সালে ডেপুটি স্পিকার থাকাকালীন সময় থেকে হাওর উন্নয়নে নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তার মধ্যে সাবমার্সিবল রাস্তা অন্যতম। পর্যায়ক্রমে তিনি হাওরে শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন। তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্ন হাওরের অপার সম্ভাবনা বাস্তবে রূপদান করা। বর্তমান সরকার হাওর চাকুরিজীবিদের জন্য “হাওরভাতা” চালু করেছেন। এতে করে হাওর অঞ্চলে কর্মরত কর্মকর্তা কর্মচারীদের ভেতর আসবে আন্তরিক সেবাদানের মানসিকতা, উপকৃত হবে হাওরের মানুষ। বর্তমান সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব মোঃ আবদুল হামিদ-এর হাওর অঞ্চলের প্রতি সুনজর এবং হাওরপ্রীতি এ অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদী সর্বস্তরের জনসাধারণ।
প্রাণের উৎস পানি। হাওরের এই পানি জনজীবনকে সম্ভাবনার স্রোতে ভাসিয়ে এ জনপদকে করে তুলবে এক সম্ভাবনাময় স্বপ্নরাজ্যে।
মুহা: রেহান মকবুল
সহকারী অধ্যাপক
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সরকারি কলেজ
ইটনা, কিশোরগঞ্জ