নাইট উপাধি পাওয়া শিল্পী শাহাবুদ্দিন বলেছেন, ফাঁকি দিয়ে কখনও উপরে যাওয়া যায় না। মুক্তিযুদ্ধের তেজ ও জয় থেকেই সাধনার অনুপ্রেরণা পাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি নিজেকে ‘জয় বাংলা’র শিল্পী অভিহিত করেন।
বলেন, এই জয় বাংলা স্লোগানই বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল অস্ত্র ছিল।গতবছর তাকে নাইট উপাধী পুরষ্কার দেয়া হয়।
রবিবার প্রবাসী বাংলাদেশি চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিনকে চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় সংবর্ধনায় বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি একথা বলেন।
অনুষ্ঠানে শাহাবুদ্দিন বলেন, “আমার বাংলাদেশি পাসপোর্ট ছাড়া অন্য কোনো পাসপোর্ট নাই। সেখানকার(ফ্রান্স) রেসিডেন্ট কার্ড আছে। আমি বাংলাদেশি। এরপরও আমি জানতাম, ওরা স্বীকৃতি দিবেই। এই আত্মবিশ্বাস আমার ছিল।
“শিল্পী যেখানেই থাকুক না কেন, শিল্পীদের কখনো ব্যারিয়ার বা সীমানা নাই। আগের দিনে গুরুরা বলতেন- সাধনা-চর্চা, তারপর গুণাবলী, ট্যালেন্ট ইত্যাদি আছে। ফাঁকি দিয়ে কখনো উপরে যাওয়া যায় না।
“এই যে চর্চা, এই যে সাধনা- হয়তো মুক্তিযুদ্ধে থাকাকালীন সময়ে যে তেজ ও বিজয়, ওইটা আমাকে প্রেরণা দিয়েছে এবং জাগ্রত করেছে।”
শাহাবুদ্দিনের এই বক্তব্যের সমর্থন মেলে শিল্পীকে নিয়ে তার এক বন্ধুর স্মৃতিচারণায়।
জামালউদ্দিন আহমেদ নামে তার বন্ধু অনুষ্ঠানে বলেন, একবার শিল্পাঙ্গনে একটা প্রদর্শনী হচ্ছিল। ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতসহ অনেক বড় বড় ব্যক্তি প্রদর্শনী উদ্বোধনের জন্য অপেক্ষা করছেন।
“সবাই তার (শাহাবুদ্দিন) খোঁজ করছে। আমার কাছে জানতে চাইছে, কোথায় শাহাবুদ্দিন? আমি দেখলাম, উনি দূরে এক বেবিটেক্সিওয়ালার সঙ্গে কথা বলছেন।”
আসতে বলার পর শাহাবুদ্দিন তাকে ‘ধুর’ বলে তাড়িয়ে দেন জানিয়ে জামাল বলেন, “পরে জানতে পারি, যুদ্ধের সময় তিনি এই বেবিটেক্সিওয়ালার বাসায় অস্ত্রসহ একরাত ঘুমিয়েছেন। তার বউ ওনাকে রান্না করে খাইয়েছিল।”
ওই সময় শাহাবুদ্দিন তাকে বলেছিলেন, “এই ব্যক্তি আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। আমি ওনাকে রেখে কোথায় যাব? আগে ওনার সাথে দেখা করি।”
“এই হলো শাহাবুদ্দিন ভাই,” বলেন জামালউদ্দিন।
মানুষের ভালোবাসাও কাজের পেছনের প্রেরণা হিসাবে পান জানিয়ে শিল্পী বলেন, আত্মবিশ্বাসটা ১৯৭৪ পর্যন্ত আরও বেশি ছিল।
“যেই পঁচাত্তর হয়েছে, আমি ধসে গিয়েছিলাম,” বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন তিনি।
তখনকার মানসিক অবস্থার বর্ণনায় তিনি বলেন, “আমার মনে হচ্ছিল- এই চারুকলা যেখানে পাঁচ বছর দাঁড়িয়ে ছিলাম, এই তো এখানে কত ড্রয়িং করেছি, আমার মনে হয়, জীবনে আর বাংলাদেশ দেখা হবে না। বুকে ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। সেই দেশে এই সব ঘটনা ঘটে!”
পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে থেমে থেমে দেশের শিল্প সাহিত্য অঙ্গনের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শিল্পীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। পুরো শিশুর মতো হাসি হাসি চেহারায় থাকা এই শিল্পীকে যখন তারই শিক্ষক রফিকুন নবী উত্তরীয় পরিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন যেন খানিকটা বিব্রতই বোধ করলেন তিনি। যার ছাপ ছিল তা চেহারায়।
তিনি বলেন, “আমার জীবনের সোনালী অধ্যায় যদি বলতে চাও, সেটা আমার চারুকলা। অনেক কিছু বলতে পার, কিন্তু যে পাঁচ বছর এখানে ছিলাম, সেটাই।
“তখন শিক্ষক-ছাত্রদের সম্পর্ক একটা পরিবারের মতো ছিল। যতদূরে যাই, যতই সময় যাচ্ছে, পুরনো একটা স্মৃতি ভেসে আসছে, মনে হয়, আহ কী সোনালী জীবন আমার ছিল! এখানে আজ ৪৫ বছর পর আমার শিক্ষকদের কাছ থেকে ফুলের মালা পাচ্ছি।”
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগও শিল্পীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়।
বক্তব্যে এ প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, “আসলে (আমি) জয় বাংলার শিল্পী। জয় বাংলা এমন একটা জিনিস, সাথে সাথে অন্যদিকে (শত্রুদের) বাতি নিভে যায়। সশস্ত্র যুদ্ধের মূল আর্মস ছিল জয় বাংলা।”
নিজের মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের সঙ্গে এই স্লোগান নিয়ে নানা খুনসুটি হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি বলি তোরা কী জয় বাংলা করিস, কী করেছিস?”
শাহাবুদ্দিনের অন্য চার ভাই এবং বাবাও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। শাহাবুদ্দিন যুদ্ধকালে প্লাটুন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৬ ডিসেম্বর তিনি বেতার ভবনের উপরে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন।