ঢাকা ০৫:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সুনডোকু : বই কেনার এক অদ্ভুত স্বভাব

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০২:৩২:০১ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ অগাস্ট ২০২০
  • ২০৩ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আপনি কি বই দেখলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না? হাত নিশপিশ করে? পকেটে বা ব্যাগে অল্প কিছু টাকা আছে, তারপরও নতুন কোনো বই দেখে পছন্দ হয়ে গেলে না কিনে পারেন না? অথচ বাসায় আপনার ইতোমধ্যেই এমন অনেক বই পড়ে আছে, যেগুলোর এক পাতাও আপনি কোনোদিন পড়ে দেখেননি। ভবিষ্যতেও যে পড়বেন তার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ? সুতরাং আপনি খুব ভালোভাবেই বোঝেন, নতুন কেনা বইগুলোর ভাগ্যেও একই পরিণতি হয়তো লেখা আছে। তবুও নিজেকে দমাতে পারেন না?

আপনি এক মহান শিল্পী। যে শিল্পে আপনার অসামান্য মুনশিয়ানা, সেটির নাম সুনডোকু (tsundoku)। শুনেই হয়তো বুঝতে পারছেন, কথাটি জাপানি। এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে আপনারই মতো সেইসব ব্যক্তিকে সংজ্ঞায়িত করতে, যারা প্রচুর অপঠিত বইয়ের মালিক।

এখানে ‘ডোকু’ শব্দটিকে ব্যবহার করা যেতে পারে একটি ক্রিয়াপদ হিসেবে, যার অর্থ ‘পড়া’। অপরদিকে ‘সুন’ শব্দটি এসেছে ‘সুমু’ থেকে, যার অর্থ ‘স্তূপ করা’। অর্থাৎ আক্ষরিকভাবে ‘সুনডোকু’ অর্থ হলো ‘পড়ার উপযোগী বই বা অন্যকিছু স্তূপ করে রাখা’। লিখিত ভাষায় কথাটির উদ্ভব ঘটেছে বহুদিন আগে, ১৮৭৯ সালে। অর্থাৎ জাপানের মেইজি যুগে। এক শিক্ষকের ব্যাপারে ব্যাঙ্গ করে লেখা হয়েছিল, তিনি একজন সুনডোকু সেনসেই। কেননা তার অনেক বই ছিল। কিন্তু তিনি সেগুলো পড়তেন না।

সুনডোকু শব্দের সাথে আরেকটি বহুল প্রচলিত ইংরেজি শব্দেরও মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সেটি হলো ‘বিবলিওম্যানিয়া’। এ শিরোনামে উনবিংশ শতকে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন থমাস ফ্রগনাল ডিবডিন। তার দেওয়া সংজ্ঞানুসারে, ‘বিবলিওম্যানিয়া’ অর্থ হলো ‘বই সংগ্রহের নেশা থামাতে না পারা’। বিবলিওম্যানিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা বিশেষায়িত বিভিন্ন বই সংগ্রহের নেশায় বুঁদ থাকে। সেটি হতে পারে কোনো বইয়ের প্রথম সংস্করণ, লেখকের সই করা কপি কিংবা অলঙ্কৃত কপি। যদি আপনার মাঝেও এ প্রবণতা থাকে, তবে আপনি একজন বিবলিওম্যানিয়াকও বটে।

সুনডোকু আর বিবলিওম্যানিয়া শব্দ দুইটির অর্থ প্রায় কাছাকাছি হলেও এদের মধ্যে একটি বড় তফাৎ রয়েছে। খেয়াল করে দেখুন, বই সংগ্রহই কিন্তু বিবলিম্যানিয়ার প্রধান কথা। অথচ সুনডোকুতে বইয়ের পাহাড় জমানো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কোনো কাজ নয়। আপনি যখন একটি বই কেনেন, সংগ্রহের চেয়ে বইটি পড়ার ইচ্ছাই হয়তো আপনার মনে বেশি কাজ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বইটি যেকোনো কারণেই হোক আপনার আর পড়া হয়ে ওঠে না। কিন্তু বইয়ের মোটামুটি ভালো একটি সংগ্রহ গড়ে ওঠে।

এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, সুনডোকু বা বিবলিওম্যানিয়া কি কেবল বইয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য? একদিক থেকে বলতে গেলে, হ্যাঁ। কারণ, দুই জায়গাতেই সরাসরি বই কিংবা পড়ার উল্লেখ রয়েছে। আপনি স্রেফ একটু বাড়িয়ে কাগুজে বইয়ের জায়গায় ই-বুক ডাউনলোড করে রেখে দেওয়াকেও এই তালিকায় ঠাঁই দিতে পারেন।

তবে একই ধরনের প্রবণতা আসলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমরা অনেকেই আছি, যারা নতুন পোশাক দেখলে কেনার লোভ সামলাতে পারি না। অনেকে আবার হয়তো একটি জিনিস ব্যবহার করি বা না করি, সেটি সংগ্রহে রাখার জন্য গাঁটের পয়সা খরচ করে সেটি কিনে ফেলি।

প্রকৃতপক্ষে, একটি জিনিস যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মালিকানায় না আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেটির প্রতি আমাদের অদম্য আকর্ষণ বজায় থাকে। কিন্তু সেটি পেয়ে গেলেই আমাদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভাটা পড়ে যায়। আবার কোনো কারণে সেই জিনিসটি হারিয়ে গেলে, সেটির প্রতি আমাদের মমত্ববোধ পুনরায় ফিরে আসে।

খেয়াল করে দেখবেন, নেটফ্লিক্সের অ্যাকাউন্ট নেওয়ার আগ পর্যন্ত আপনার মনের মধ্যে কতটা উৎসাহই না টগবগ করতে থাকে। আপনি ভাবতে থাকেন, ‘এবার সব সিনেমা-সিরিজ দেখে ফেলব। কোনোটা বাদ দেব না।’ অথচ অ্যাকাউন্ট নেওয়ার পর হয়তো দেখার সময়ই পান না। আবার অ্যাকাউন্টের মেয়াদ যখন শেষ বা শেষের পর্যায়, তখন কী দিশেহারাই না হয়ে পড়েন!

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

সুনডোকু : বই কেনার এক অদ্ভুত স্বভাব

আপডেট টাইম : ০২:৩২:০১ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ অগাস্ট ২০২০

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আপনি কি বই দেখলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না? হাত নিশপিশ করে? পকেটে বা ব্যাগে অল্প কিছু টাকা আছে, তারপরও নতুন কোনো বই দেখে পছন্দ হয়ে গেলে না কিনে পারেন না? অথচ বাসায় আপনার ইতোমধ্যেই এমন অনেক বই পড়ে আছে, যেগুলোর এক পাতাও আপনি কোনোদিন পড়ে দেখেননি। ভবিষ্যতেও যে পড়বেন তার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ? সুতরাং আপনি খুব ভালোভাবেই বোঝেন, নতুন কেনা বইগুলোর ভাগ্যেও একই পরিণতি হয়তো লেখা আছে। তবুও নিজেকে দমাতে পারেন না?

আপনি এক মহান শিল্পী। যে শিল্পে আপনার অসামান্য মুনশিয়ানা, সেটির নাম সুনডোকু (tsundoku)। শুনেই হয়তো বুঝতে পারছেন, কথাটি জাপানি। এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে আপনারই মতো সেইসব ব্যক্তিকে সংজ্ঞায়িত করতে, যারা প্রচুর অপঠিত বইয়ের মালিক।

এখানে ‘ডোকু’ শব্দটিকে ব্যবহার করা যেতে পারে একটি ক্রিয়াপদ হিসেবে, যার অর্থ ‘পড়া’। অপরদিকে ‘সুন’ শব্দটি এসেছে ‘সুমু’ থেকে, যার অর্থ ‘স্তূপ করা’। অর্থাৎ আক্ষরিকভাবে ‘সুনডোকু’ অর্থ হলো ‘পড়ার উপযোগী বই বা অন্যকিছু স্তূপ করে রাখা’। লিখিত ভাষায় কথাটির উদ্ভব ঘটেছে বহুদিন আগে, ১৮৭৯ সালে। অর্থাৎ জাপানের মেইজি যুগে। এক শিক্ষকের ব্যাপারে ব্যাঙ্গ করে লেখা হয়েছিল, তিনি একজন সুনডোকু সেনসেই। কেননা তার অনেক বই ছিল। কিন্তু তিনি সেগুলো পড়তেন না।

সুনডোকু শব্দের সাথে আরেকটি বহুল প্রচলিত ইংরেজি শব্দেরও মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সেটি হলো ‘বিবলিওম্যানিয়া’। এ শিরোনামে উনবিংশ শতকে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন থমাস ফ্রগনাল ডিবডিন। তার দেওয়া সংজ্ঞানুসারে, ‘বিবলিওম্যানিয়া’ অর্থ হলো ‘বই সংগ্রহের নেশা থামাতে না পারা’। বিবলিওম্যানিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা বিশেষায়িত বিভিন্ন বই সংগ্রহের নেশায় বুঁদ থাকে। সেটি হতে পারে কোনো বইয়ের প্রথম সংস্করণ, লেখকের সই করা কপি কিংবা অলঙ্কৃত কপি। যদি আপনার মাঝেও এ প্রবণতা থাকে, তবে আপনি একজন বিবলিওম্যানিয়াকও বটে।

সুনডোকু আর বিবলিওম্যানিয়া শব্দ দুইটির অর্থ প্রায় কাছাকাছি হলেও এদের মধ্যে একটি বড় তফাৎ রয়েছে। খেয়াল করে দেখুন, বই সংগ্রহই কিন্তু বিবলিম্যানিয়ার প্রধান কথা। অথচ সুনডোকুতে বইয়ের পাহাড় জমানো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কোনো কাজ নয়। আপনি যখন একটি বই কেনেন, সংগ্রহের চেয়ে বইটি পড়ার ইচ্ছাই হয়তো আপনার মনে বেশি কাজ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বইটি যেকোনো কারণেই হোক আপনার আর পড়া হয়ে ওঠে না। কিন্তু বইয়ের মোটামুটি ভালো একটি সংগ্রহ গড়ে ওঠে।

এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, সুনডোকু বা বিবলিওম্যানিয়া কি কেবল বইয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য? একদিক থেকে বলতে গেলে, হ্যাঁ। কারণ, দুই জায়গাতেই সরাসরি বই কিংবা পড়ার উল্লেখ রয়েছে। আপনি স্রেফ একটু বাড়িয়ে কাগুজে বইয়ের জায়গায় ই-বুক ডাউনলোড করে রেখে দেওয়াকেও এই তালিকায় ঠাঁই দিতে পারেন।

তবে একই ধরনের প্রবণতা আসলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমরা অনেকেই আছি, যারা নতুন পোশাক দেখলে কেনার লোভ সামলাতে পারি না। অনেকে আবার হয়তো একটি জিনিস ব্যবহার করি বা না করি, সেটি সংগ্রহে রাখার জন্য গাঁটের পয়সা খরচ করে সেটি কিনে ফেলি।

প্রকৃতপক্ষে, একটি জিনিস যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মালিকানায় না আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেটির প্রতি আমাদের অদম্য আকর্ষণ বজায় থাকে। কিন্তু সেটি পেয়ে গেলেই আমাদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভাটা পড়ে যায়। আবার কোনো কারণে সেই জিনিসটি হারিয়ে গেলে, সেটির প্রতি আমাদের মমত্ববোধ পুনরায় ফিরে আসে।

খেয়াল করে দেখবেন, নেটফ্লিক্সের অ্যাকাউন্ট নেওয়ার আগ পর্যন্ত আপনার মনের মধ্যে কতটা উৎসাহই না টগবগ করতে থাকে। আপনি ভাবতে থাকেন, ‘এবার সব সিনেমা-সিরিজ দেখে ফেলব। কোনোটা বাদ দেব না।’ অথচ অ্যাকাউন্ট নেওয়ার পর হয়তো দেখার সময়ই পান না। আবার অ্যাকাউন্টের মেয়াদ যখন শেষ বা শেষের পর্যায়, তখন কী দিশেহারাই না হয়ে পড়েন!