আজ ১২ রবিউল আউয়াল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শুভাগমন দিবস। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে আইয়ামে জাহেলিয়াতের অন্ধকার দূর করে তৌহিদের সুমহান বাণী নিয়ে আরবের মুরুর বুকে মা আমিনার কোল জুড়ে সমগ্র বিশ্বমানবতার রহমত হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি এসেছিলেন অশান্তির অমানিশা দূরে ঠেলে শান্তির ধর্ম ইসলামের দাওয়াত প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌছে দিতে। তাঁর আগমনেই সমগ্র বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাইতো সারা বিশ্বের সব মুমিনের কাছে আজকের দিনটির গুরুত্ব অত্যধিক। সর্বকালের সর্বযুগের মহামানব রহমাতুলল্লি আলামিন হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ পবিত্র দিনে ধরার বুকে আগমন করেন বিধায় বিশ্বমুসলিম আনন্দের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দিনটিকে খুশির দিন হিসাবে পালন করে থাকেন। মুসলিম উম্মাহর অনেকের কাছে এ দিনটি পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী হিসেবে পরিচিত। আবার অনেকে এ দিনটিকে সীরাতুন্নবী হিসেবেও পালন করে থাকে। কারণ ১২ রবিউল আউয়ালেই তিনি ওফাতবরণ করেন।
তিনি জন্মের পূর্বেই পিতৃহারা হন এবং জন্মের অল্পকাল পরই বঞ্চিত হন মাতৃস্নেহ থেকে। অনেক প্রতিকুলতার মধ্যদিয়ে চাচা আবু তালিবের সঙ্গে থেকে প্রতিপালিত হন। যৌবনে তিনি ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। পঁচিশ বছর বয়সে তিনি মক্কার ধনাঢ্য ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী হজরত খাদিজার সঙ্গে বিবাহ বন্ধে আবদ্ধ হন। চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হওয়ার পর তিনি মহান রাববুল আলামীনের পক্ষ থেকে নবুওয়তের মহান দায়িত্ব লাভ করেন।
আইয়ামে জাহেলিয়াতের পথহারা জাতিকে মুক্তি ও সত্য পথের দিশা দিতে তিনি তাদের কাছে তুলে ধরেন তাওহীদের বাণী। কিন্তু বর্বর ও মূর্খ জাতি তাঁর দাওয়াত গ্রহণ না করে তাঁর উপর নির্যাতন শুরু করে, অল্প সংখ্যক লোক ব্যতিত সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে একের পর এক বিভিন্নমুখী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে।
কোনো ষড়যন্ত্রই তাকে তাওহিদের বাণী প্রচারে দমাতে পারেনি। আল্লাহর সাহায্যের ওপর ভর করে অল্প সংখ্যক সঙ্গী-সাথী নিয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জীবনবাজি রেখে দ্বীনের কাজে নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে যান। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সত্যসন্ধানী মানুষের সংখ্যা।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইসলামের দাওয়াত থেকে বিরত রাখতে না পেরে কাফেরদের রাগ-ক্ষোভ প্রচণ্ড রকম বেড়ে যায়। তাদের অত্যাচারের মাত্রা সীমাতিক্রম করে। এক পর্যায়ে তারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুনিয়া থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে হত্যার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে।
এমতাবস্থায় আল্লাহর পক্ষ থেকে জন্মভূমি ত্যাগের নির্দেশ আসে। আল্লাহর নির্দেশ এবং দ্বীন কায়েমের স্বার্থে তিনি জন্মভূমি ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করেন। আল্লাহর আইন বাস্তবায়নে সেখানে তিনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ‘মদিনা সনদ’ নামে একটি লিখিত সংবিধানও প্রণয়ন করেন। যা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান। যে সংবিধানে ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমানসহ অন্যান্য সব জাতির মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
মদিনার জীবনে তিনি দুই ধরনের শত্রুর মোকাবেল করেন। একদিকে মদিনার প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা হারানো ইসলামের লেবাসধারণকারী মুনাফিক সম্প্রদায় এবং অপরদিকে মক্কার কাফেরদের অব্যাহত ষড়যন্ত্র। যারা সর্বদাই ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতির পাশাপাশি বিশ্বনবীকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করতে বদ্ধপরিকর ছিল। যার ফলশ্রুতিতে সংঘটিত হয় বদর ও ওহুদ যুদ্ধ।
বদর যুদ্ধে আল্লাহর অশেষ রহমতে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করলেও মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র ও একটি ভুলের কারণে ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানদেরকে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়। শাহাদাতবরণ করেন অনেক সাহাবা এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দন্ত মোবারক শহীদ হয়।
অনেক ত্যাগের বিনিময়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সুদীর্ঘ ২৩ বছরের শ্রম সাধনায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিজয় অর্জন করেন। যার পরিপূর্ণতা আসে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে। তাইতো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজ্বের ভাষণে দ্বীনের পরিপূর্ণতার ঘোষণা দেন। আল্লাহ বলেন- ‘আজ থেকে তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন তথা জীবন ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ করে দেয়া হলো। তোমাদের জন্য দ্বীন তথা জীবন ব্যবস্থা হিসেবে একমাত্র ইসলামকে মনোনীত করা হয়েছে।’ ইসলামকে পরিপূর্ণ করার মধ্য দিয়ে দুনিয়ার মিশন শেষে ৬৩ বৎসর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন।
পরিশেষে…
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম দিবস ও ওফাত দিবস উদযাপনের প্রকৃতি যেমনই হোক না কেন, অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। যারা তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তাদের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। কাফের ও ইসলামের লেবাসধারী মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র এখনো চলছে। ইসলাম বিরোধীদের পাশাপাশি ধর্মের লেবাসধারীরাও ইসলামকে কলঙ্কিত করতে চায়। মুলমানদেরকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করা উম্মাতে মুহাম্মাদীর ঈমানি দায়িত্ব।
সুতরাং মনে রাখতে হবে কাফের, মুশরিক ও মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র যেমন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারেনি। বর্তমানেও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শুভাগমনের আনন্দ এবং ওফাতের শোককে শক্তিতে পরিণত করে ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে তাঁর আদর্শ এবং মিশনকে জমিনে বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই বিজয়ী হবে ইসলাম। তাই হোক রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম দিবস ও ওফাত দিবসের অঙ্গীকার। আল্লাহ তাআলা সবাইকে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নে কুবল করুন আমিন।