ঢাকা ০৮:০৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫, ২৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুই বন্ধু ১৭ বছর পর দুই বোন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:২১:১২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১১ মার্চ ২০২০
  • ১৯৩ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ফিলাডেলফিয়ার অ্যাশলে ও লাটোয়ার মধ্যে খুব সুন্দর একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। চেহারা এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মিলের কারণে অনেকেই তাদের বোন বলে ভুল করত। কিন্তু ১৭ বছর পর জানা গেল তারা সত্যিই আপন বোন। বন্ধুত্ব থেকে কীভাবে বোনের পরিচয় বের হয়ে এলো সে গল্প লিখেছেন

আরফাতুন নাবিলা অ্যাশলে এবং লাটোয়ার পরিচয় 

ফিলাডেলফিয়ার সালজবার্গার মিডল স্কুলে পড়তেন অ্যাশলে থমাস এবং লাটোয়া উইম্বারলি। তবে তারা একই ক্লাসে পড়তো। তাদের মধ্যে পরিচয়ও ছিল না। ২০০৪ সালে দুজনেরই কমন এক বন্ধুর জন্মদিনে তাদের পরিচয় হয়। পরিচয় শেষে তৈরি হয় বন্ধুত্ব। এরপর কেটে গেছে ১৭ বছর। বন্ধুত্বের সম্পর্কে ভুল বোঝাবোঝি বা ফাটল ধরা তো দূরে থাক, দিনে দিনে তাদের সম্পর্ক হয়েছে আরও গভীর। মাঝে মাঝে যদি দেখা নাও হতো, ১৭ বছরের প্রতিটি দিনেই তারা ফোনে কথা বলেছেন। বলতে গেলে একজন অন্যের সঙ্গে একদম আঠার মতো লেগে থাকতেন। তাদের এই বন্ধুত্বকে লাটোয়ার বাবা কেনেথও কখনো খারাপ চোখে দেখেননি। বরং তিনি অ্যাশলেকে নিজের মেয়ের মতোই দেখতেন। অ্যাশলের বর্তমান বয়স ৩১ এবং লাটোয়ার ২৯।

নানা বিষয়ে দুজনের অদ্ভুত মিল

ছোটবেলা থেকে দুজনের মাঝে এত গভীর সম্পর্ক দেখে অনেকেই অ্যাশলে এবং লাটোয়াকে বোন বলে ভুল করতেন। অবশ্য এর বেশ কিছু কারণ ছিল। তাদের দুজনের চেহারায় অনেক মিল ছিল, দুজনের দাঁতের মাঝে ফাঁক এমনকি গালের হাড়ের গঠনও ছিল একই রকম। তারা দুজনেই দাঁতের ফাঁকটুকু ভরাটের জন্য ব্রেস পরতেন। গান থেকে শুরু করে পোশাক এবং চুলের ফ্যাশন, সবকিছুতেই তাদের সমান আগ্রহ ছিল। তারা জুতোও পরতেন একই মাপের। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তাদের দুজনের প্রেম এবং বিয়েও হয়েছে আপন দুই ভাইয়ের সঙ্গে। যদিও সে সময় নিজেদের সত্যি পরিচয় সম্পর্কে জানা ছিল না তাদের। প্রায় একই সময়ে তারা মা হন। এমনকি চাকরি না করে দুই বোনই হয়েছেন উদ্যোক্তা। করছেন ব্যবসা। লাটোয়া একটি শিশুদের ট্রান্সপোর্টেশন কোম্পানি এবং গ্লোবাল রাইডস ট্রান্সপোর্টেশন কোম্পানি চালান। অ্যাশলে চালু করেছেন একটি হেয়ার স্টুডিও। তাদের এই বন্ধন ছিল অবিচ্ছেদ্য। বন্ধুত্বের সম্পর্কটুকু হয়তো এভাবেই কেটে যেত। যতদিন না তারা জানতে পারতেন তাদের সম্পর্ক আসলে বন্ধুত্বের নয়, আপন বোনের।

সত্য জানা গেল যেভাবে

বন্ধুত্ব ছাড়াও নিজেদের মধ্যে বোনের সম্পর্ক থাকতে পারে এমন ধারণা তাদের সামনে আসে জানুয়ারি মাসে। সে মাসে লাটোয়া বাড়িতে একটি পার্টির আয়োজন করেছিলেন। অ্যাশলে সেই পার্টির কিছু ছবি ফেইসবুকে দেন। সেই ছবিগুলোর কয়েকটায় ছিলেন লাটোয়ার বাবা কেনেথ উইম্বারলি। অনলাইনে সে ছবিগুলো দেখে অ্যাশলের মায়ের একজন বান্ধবী জানান, তিনি কেনেথকে চেনেন। অবশ্য তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি কেনেথ লাটোয়ার বাবা। তিনি শুধু এমনিই বলেছিলেন কেনেথকে তিনি চেনেন। তরুণ বয়সে কেনেথের সঙ্গে অ্যাশলের মায়ের বন্ধুত্ব ছিল। তারা একইসঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছেন, ঘুরে বেড়িয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাশলে বিষয়টি লাটোয়াকে জানান। লাটোয়া কেনেথকে জানালে তিনি নিজেও প্রথমে বুঝতে পারেননি তারা কোন মহিলার কথা বলছেন। পরে লাটোয়া অ্যাশলের কাছে সেই মহিলার একটি ছবি চান। ছবিটি দেখেই কেনেথ সেই মহিলাকে চিনতে পারেন। এরপর অ্যাশলের মা মিশেলের ছবি দেখালে তাকেও তিনি চিনতে পারেন। লাটোয়া কেনেথের কাছে মিশেল বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তাকে সব সত্যি বলেন। তিনি জানান, তাদের দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কও ছিল। কেনেথ আগে থেকেই জানতেন, অ্যাশলে তার বাবা সম্পর্কে জানেন না। তখন তার মনে প্রশ্ন আসে, তিনি নিজেই অ্যাশলের বাবা নন তো? এমন প্রশ্ন নিয়ে ভাবেন অ্যাশলে এবং লাটোয়া দুজনেই। তারা তিনজন মিলে সিদ্ধান্ত নেন ধারণার সত্যতা প্রমাণ করতে হলে ডিএনএ টেস্ট করা জরুরি। লাটোয়া কেনেথকে বলেন ১০০ ডলার দিতে। টেস্টের বাকি খরচ তিনি আর অ্যাশলে মিলে জোগাড় করবেন। এই ১০০ ডলার খরচকে জীবনের শ্রেষ্ঠ খরচ বলে মানেন কেনেথ। ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ টেস্টের ফলাফল সামনে এলে জানা যায়, কেনেথই অ্যাশলের বাবা।

অ্যাশলের ভাষ্যমতে, ‘ঘটনাটি যেদিন আমি জানলাম সেদিন ছিল শুক্রবার। আমি অফিসে কাজ করছিলাম। যখন কেনেথ আমাকে জানালেন, তিনি আমার বাবা। তখন আমি আনন্দে কথা বলতে পারছিলাম না। কোনোকিছু ভাবতে পারছিলাম না। আমি আসলে বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে এই আনন্দের প্রকাশ করা যায়!’ কেনেথ বলেন, ‘আমি আনন্দিত যে সে আমার মেয়ে। সবাই অনেক খুশি যে সে আমাদের পরিবারেরই একটি অংশ।’

কেনেথ ও অ্যাশলে

কেনেথ আর অ্যাশলের মা মাইকেলের যখন সম্পর্ক ছিল, সে সময় মাইকেল কখনো তাকে বলেননি তিনি মা হতে চলেছেন। হয়তো তাদের মাঝে সম্পর্ক টেকেনি বলেই। তারা দুজন আলাদা হয়ে যাওয়ার পর তাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগও ছিল না। এরপর মাইকেল নতুনভাবে জীবন শুরু করেছেন, একটি পারিবারিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছেন, অ্যাশলের জন্মের পর তাকে লালন-পালন করেছেন। কিন্তু কেনেথ যে অ্যাশলের আসল বাবা সে বিষয়ে কখনোই কিছু বলেননি।

অ্যাশলের সঙ্গে লাটোয়ার সম্পর্ক এত গভীর ছিল যে তারা একসঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরতে বা খেতে যেতেন। তার গাড়ির কোনো সমস্যা হলে তিনি সব সময় কেনেথের দারস্থ হতেন। একবার কেনেথ তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, গাড়ি সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে তোমার বাবা সাহায্য করেন না? অ্যাশলে শুধু বলেছিলেন, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো নয়। পরে তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করেননি কেনেথ। দিনে দিনে তার সঙ্গেও অ্যাশলের সম্পর্ক ভালো হয়েছে।

উত্তর না পাওয়া অনেক প্রশ্ন

অ্যাশলের যখন ১৫ বছর বয়স তখন তিনি জানতে পারেন, যে মানুষটি এতদিন তার লালন-পালন করেছেন তিনি আসলে তার বাবা নন। তার মা মারা যান ১১ বছর আগে। তিনিও কখনো তাকে বলেননি অন্য কেউ তার বাবা হতে পারেন। অ্যাশলের পরিবারের কেউ এর আগে কখনো লাটোয়ার পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হননি। কাজেই তাদের মধ্যেও জানার সম্ভাবনা ছিল না যে, কেনেথ অ্যাশলের বাবা হতে পারেন। তবে কেনেথ সব সময় অ্যাশলের জীবনে বাবার ভূমিকাতেই ছিলেন। কেনেথের বাড়িতে পারিবারিক যত অনুষ্ঠান হতো সবখানেই অ্যাশলের ছিল সরব উপস্থিতি। অন্য কেউ আসুক বা না আসুক, এমন কখনো হয়নি যে অ্যাশলে পারিবারিক অনুষ্ঠান বাদ দিয়েছেন। শুরু থেকেই উইম্বারলি পরিবারের সঙ্গে অ্যাশলের সম্পর্ক অনেক গভীর ছিল। কেনেথ যদি কখনো লাটোয়াকে বাইরে নিয়ে যেতেন, সেখানে অ্যাশলেও যেতেন। যদি কেউ কেনেথকে জিজ্ঞেস করতেন, এই মেয়েরা কে। তিনি সব সময় বলতেন, তারা আমার মেয়ে। আবার কখনো অ্যাশলের গাড়ির কোনো সমস্যা হলে তিনি তার বাড়ির কাউকে না বলে সব সময় কেনেথের কাছে চলে যেতেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দুই পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের সঙ্গে কারও কখনো দেখা হয়নি।

বোন আর বাবাকে খুঁজে পাওয়ার বিষয়টি বেশ আনন্দের হলেও, আবেগঘন। অ্যাশলে যখন থেকে জানতে পেরেছেন তার বর্তমান বাবা আসলে তার বাবা নন, তখন থেকেই বাবা সম্পর্কে জানার প্রবল আকুতি তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। মায়ের প্রতি তার ছিল অসংখ্য প্রশ্ন। অথচ সেই প্রশ্নের কোনো জবাব ছিল না। এমনকি জবাব জানার কোনো উপায়ও ছিল না। মাইকেল মারা গেছেন অনেক বছর আগে, পরিবারের কেউ তার বাবার ব্যাপারে কিছু জানে না। অ্যাশলে যখন থেকে সত্যি জেনেছেন এরপরও তার বাবা কখনোই তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেননি। এমনকি আপন সন্তান না হওয়ার কারণে কোনো বঞ্চনার শিকার হওয়া বা এমন কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখিও হতে হয়নি অ্যাশলেকে। তিনি শুধু সেই ব্যক্তিকে বাবা বলে আর মানতে পারছিলেন না। অথচ আপন বাবা কেনেথ বাবার মতো সব সময় তার সঙ্গে থাকলেও তিনি যে তার বাবা হতে পারেন শুধু এই বিষয়েও তার কোনো ধারণা ছিল না।

কী ভাবছেন তিনজন

কোথাও বেড়াতে গেলে কেনেথ, অ্যাশলে আর লাটোয়া সব সময় একসঙ্গে থাকতেন। একে অন্যকে পরিবারের সদস্য বলেও পরিচিত করিয়ে দিতেন। সত্যি না জেনেও তারা আপন হয়েছিলেন পরস্পরের। বোনকে ফিরে পাওয়ার এ ঘটনায় লাটোয়া দারুণ আনন্দিত। তবে তার মাঝে কিছু অপরাধবোধ কাজ করে। তাদের দুজনের বাবা একজনই, অথচ তিনি অ্যাশলের চেয়ে কেনেথকে বেশি সময় ধরে বাবা ডাকার সুযোগ পেয়েছেন, তার ভালোবাসা বেশি পেয়েছেন। অন্যদিকে ছোটবেলা থেকেই অ্যাশলেকে অনেক কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। অপরাধবোধ থাকলেও একটি আনন্দিত হওয়ার মতো বিষয়ও আছে। এখন কেনেথ যতটা সম্ভব অ্যাশলের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছেন।

কেনেথ বলেন, একজন বাবা হিসেবে আমি সব সময় আমার সন্তানদের সঙ্গেই ছিলাম। আমি তাদের বড় করে তুলেছি। অথচ অ্যাশলে তার বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তার জন্য আমার সত্যিই অনেক খারাপ লাগে। তবে যে সময় চলে গেছে তাকে তো আর আমরা কেউ ফিরিয়ে আনতে পারব না। অ্যাশলে আমাকে সব সময় ‘বিগ কেনি’ বলে ডাকত। হুট করে সেই ডাক থেকে ‘বাবা’ বলে ডাকতে তার নিজেরও কিছু সময় লাগবে। তবে বাবা বলে ডেকে খুব মিষ্টি করে সে আমার দিকে তাকায়। এই ভালো লাগা থেকে এতদিন আমি নিজেও বঞ্চিত ছিলাম।

অ্যাশলে এখন দুই সন্তানের মা। এতদিন পর সত্যি জেনে কিছুটা অবিশ্বাস্য সময় কাটছে তার। তবু তিনি চান, কেনেথ যেন তার নাতিদের সঙ্গে দারুণ কিছু সময় কাটান। নতুন সম্পর্কে কেনেথও যেন তাদের অংশীদার হন। লাটোয়ার তিন সন্তানের সঙ্গে অ্যাশলের দুই সন্তানের সম্পর্কও দারুণ। তাদের মাঝেও গভীর বন্ধুত্ব ছিল। তারাও নতুন করে জেনেছে, তারা ভাই-বোন। স্বাভাবিকভাবে, মায়ের মতে তারা সবাই আনন্দিত।

কেনেথও চান অ্যাশলের সঙ্গে দারুণ একটি সম্পর্ক গড়ে তুলতে। এতদিন মেয়ের মতো ভালোবাসলেও এখন সত্যিকারেই মেয়েকে ভালোবাসা দিতে চান তিনি। তিনিও তার নাতিদের সঙ্গে সময় কাটাতে চান। কেনেথের ভাষ্যমতে, ‘আমি সব সময় আমার আশপাশে ছোট্ট শিশুদের ছুটোছুটি করতে দেখেছি। অথচ কখনো বুঝতেই পারিনি তারা আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ।’

কী করবেন অ্যাশলে ও লাটোয়া

ছোটবেলা থেকেই নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন মিলের কারণে সবাই তাদের বোন বলতেন। আজ যখন সত্যিই বোনের পরিচয় বের হওয়ার পর সব সম্পর্ক যেন এক মুহূর্তে বদলে গেছে। প্রায় দুই দশকের মতো সময় ধরে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকলেও তারা কখনো তাদের সত্যি সম্পর্কটা সম্পর্কে জানতে পারেননি। অবশ্যই তারা দুজনেই এখন দারুণ আনন্দিত। বন্ধুত্ব ধরে রেখে নতুন বন্ধনেও তারা শক্তভাবে আবদ্ধ হতে চান। ১৭ বছর ধরে তাদের বন্ধুত্ব গভীর থেকে আরও গভীর হয়েছে এটি সত্যি। নতুন সম্পর্ককে আরও সুন্দর করে তোলার জন্য তারা দুজন মিলে ঘুরতে যাচ্ছেন মিয়ামিতে। সেখানে পরিবারের অন্য কোনো সদস্যকে নেবেন না তারা। সময়ের এই পরিবর্তন নিয়ে অ্যাশলে বলেন, ‘বিষয়টি একটি ধাঁধার মতো। সামনে অনেকগুলো প্রশ্ন এলো। কীভাবে কীভাবে যেন সব জটিল প্রশ্নের সমাধান হয়ে গেল।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

দুই বন্ধু ১৭ বছর পর দুই বোন

আপডেট টাইম : ০৯:২১:১২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১১ মার্চ ২০২০

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ফিলাডেলফিয়ার অ্যাশলে ও লাটোয়ার মধ্যে খুব সুন্দর একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। চেহারা এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মিলের কারণে অনেকেই তাদের বোন বলে ভুল করত। কিন্তু ১৭ বছর পর জানা গেল তারা সত্যিই আপন বোন। বন্ধুত্ব থেকে কীভাবে বোনের পরিচয় বের হয়ে এলো সে গল্প লিখেছেন

আরফাতুন নাবিলা অ্যাশলে এবং লাটোয়ার পরিচয় 

ফিলাডেলফিয়ার সালজবার্গার মিডল স্কুলে পড়তেন অ্যাশলে থমাস এবং লাটোয়া উইম্বারলি। তবে তারা একই ক্লাসে পড়তো। তাদের মধ্যে পরিচয়ও ছিল না। ২০০৪ সালে দুজনেরই কমন এক বন্ধুর জন্মদিনে তাদের পরিচয় হয়। পরিচয় শেষে তৈরি হয় বন্ধুত্ব। এরপর কেটে গেছে ১৭ বছর। বন্ধুত্বের সম্পর্কে ভুল বোঝাবোঝি বা ফাটল ধরা তো দূরে থাক, দিনে দিনে তাদের সম্পর্ক হয়েছে আরও গভীর। মাঝে মাঝে যদি দেখা নাও হতো, ১৭ বছরের প্রতিটি দিনেই তারা ফোনে কথা বলেছেন। বলতে গেলে একজন অন্যের সঙ্গে একদম আঠার মতো লেগে থাকতেন। তাদের এই বন্ধুত্বকে লাটোয়ার বাবা কেনেথও কখনো খারাপ চোখে দেখেননি। বরং তিনি অ্যাশলেকে নিজের মেয়ের মতোই দেখতেন। অ্যাশলের বর্তমান বয়স ৩১ এবং লাটোয়ার ২৯।

নানা বিষয়ে দুজনের অদ্ভুত মিল

ছোটবেলা থেকে দুজনের মাঝে এত গভীর সম্পর্ক দেখে অনেকেই অ্যাশলে এবং লাটোয়াকে বোন বলে ভুল করতেন। অবশ্য এর বেশ কিছু কারণ ছিল। তাদের দুজনের চেহারায় অনেক মিল ছিল, দুজনের দাঁতের মাঝে ফাঁক এমনকি গালের হাড়ের গঠনও ছিল একই রকম। তারা দুজনেই দাঁতের ফাঁকটুকু ভরাটের জন্য ব্রেস পরতেন। গান থেকে শুরু করে পোশাক এবং চুলের ফ্যাশন, সবকিছুতেই তাদের সমান আগ্রহ ছিল। তারা জুতোও পরতেন একই মাপের। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তাদের দুজনের প্রেম এবং বিয়েও হয়েছে আপন দুই ভাইয়ের সঙ্গে। যদিও সে সময় নিজেদের সত্যি পরিচয় সম্পর্কে জানা ছিল না তাদের। প্রায় একই সময়ে তারা মা হন। এমনকি চাকরি না করে দুই বোনই হয়েছেন উদ্যোক্তা। করছেন ব্যবসা। লাটোয়া একটি শিশুদের ট্রান্সপোর্টেশন কোম্পানি এবং গ্লোবাল রাইডস ট্রান্সপোর্টেশন কোম্পানি চালান। অ্যাশলে চালু করেছেন একটি হেয়ার স্টুডিও। তাদের এই বন্ধন ছিল অবিচ্ছেদ্য। বন্ধুত্বের সম্পর্কটুকু হয়তো এভাবেই কেটে যেত। যতদিন না তারা জানতে পারতেন তাদের সম্পর্ক আসলে বন্ধুত্বের নয়, আপন বোনের।

সত্য জানা গেল যেভাবে

বন্ধুত্ব ছাড়াও নিজেদের মধ্যে বোনের সম্পর্ক থাকতে পারে এমন ধারণা তাদের সামনে আসে জানুয়ারি মাসে। সে মাসে লাটোয়া বাড়িতে একটি পার্টির আয়োজন করেছিলেন। অ্যাশলে সেই পার্টির কিছু ছবি ফেইসবুকে দেন। সেই ছবিগুলোর কয়েকটায় ছিলেন লাটোয়ার বাবা কেনেথ উইম্বারলি। অনলাইনে সে ছবিগুলো দেখে অ্যাশলের মায়ের একজন বান্ধবী জানান, তিনি কেনেথকে চেনেন। অবশ্য তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি কেনেথ লাটোয়ার বাবা। তিনি শুধু এমনিই বলেছিলেন কেনেথকে তিনি চেনেন। তরুণ বয়সে কেনেথের সঙ্গে অ্যাশলের মায়ের বন্ধুত্ব ছিল। তারা একইসঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছেন, ঘুরে বেড়িয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাশলে বিষয়টি লাটোয়াকে জানান। লাটোয়া কেনেথকে জানালে তিনি নিজেও প্রথমে বুঝতে পারেননি তারা কোন মহিলার কথা বলছেন। পরে লাটোয়া অ্যাশলের কাছে সেই মহিলার একটি ছবি চান। ছবিটি দেখেই কেনেথ সেই মহিলাকে চিনতে পারেন। এরপর অ্যাশলের মা মিশেলের ছবি দেখালে তাকেও তিনি চিনতে পারেন। লাটোয়া কেনেথের কাছে মিশেল বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তাকে সব সত্যি বলেন। তিনি জানান, তাদের দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কও ছিল। কেনেথ আগে থেকেই জানতেন, অ্যাশলে তার বাবা সম্পর্কে জানেন না। তখন তার মনে প্রশ্ন আসে, তিনি নিজেই অ্যাশলের বাবা নন তো? এমন প্রশ্ন নিয়ে ভাবেন অ্যাশলে এবং লাটোয়া দুজনেই। তারা তিনজন মিলে সিদ্ধান্ত নেন ধারণার সত্যতা প্রমাণ করতে হলে ডিএনএ টেস্ট করা জরুরি। লাটোয়া কেনেথকে বলেন ১০০ ডলার দিতে। টেস্টের বাকি খরচ তিনি আর অ্যাশলে মিলে জোগাড় করবেন। এই ১০০ ডলার খরচকে জীবনের শ্রেষ্ঠ খরচ বলে মানেন কেনেথ। ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ টেস্টের ফলাফল সামনে এলে জানা যায়, কেনেথই অ্যাশলের বাবা।

অ্যাশলের ভাষ্যমতে, ‘ঘটনাটি যেদিন আমি জানলাম সেদিন ছিল শুক্রবার। আমি অফিসে কাজ করছিলাম। যখন কেনেথ আমাকে জানালেন, তিনি আমার বাবা। তখন আমি আনন্দে কথা বলতে পারছিলাম না। কোনোকিছু ভাবতে পারছিলাম না। আমি আসলে বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে এই আনন্দের প্রকাশ করা যায়!’ কেনেথ বলেন, ‘আমি আনন্দিত যে সে আমার মেয়ে। সবাই অনেক খুশি যে সে আমাদের পরিবারেরই একটি অংশ।’

কেনেথ ও অ্যাশলে

কেনেথ আর অ্যাশলের মা মাইকেলের যখন সম্পর্ক ছিল, সে সময় মাইকেল কখনো তাকে বলেননি তিনি মা হতে চলেছেন। হয়তো তাদের মাঝে সম্পর্ক টেকেনি বলেই। তারা দুজন আলাদা হয়ে যাওয়ার পর তাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগও ছিল না। এরপর মাইকেল নতুনভাবে জীবন শুরু করেছেন, একটি পারিবারিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছেন, অ্যাশলের জন্মের পর তাকে লালন-পালন করেছেন। কিন্তু কেনেথ যে অ্যাশলের আসল বাবা সে বিষয়ে কখনোই কিছু বলেননি।

অ্যাশলের সঙ্গে লাটোয়ার সম্পর্ক এত গভীর ছিল যে তারা একসঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরতে বা খেতে যেতেন। তার গাড়ির কোনো সমস্যা হলে তিনি সব সময় কেনেথের দারস্থ হতেন। একবার কেনেথ তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, গাড়ি সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে তোমার বাবা সাহায্য করেন না? অ্যাশলে শুধু বলেছিলেন, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো নয়। পরে তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করেননি কেনেথ। দিনে দিনে তার সঙ্গেও অ্যাশলের সম্পর্ক ভালো হয়েছে।

উত্তর না পাওয়া অনেক প্রশ্ন

অ্যাশলের যখন ১৫ বছর বয়স তখন তিনি জানতে পারেন, যে মানুষটি এতদিন তার লালন-পালন করেছেন তিনি আসলে তার বাবা নন। তার মা মারা যান ১১ বছর আগে। তিনিও কখনো তাকে বলেননি অন্য কেউ তার বাবা হতে পারেন। অ্যাশলের পরিবারের কেউ এর আগে কখনো লাটোয়ার পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হননি। কাজেই তাদের মধ্যেও জানার সম্ভাবনা ছিল না যে, কেনেথ অ্যাশলের বাবা হতে পারেন। তবে কেনেথ সব সময় অ্যাশলের জীবনে বাবার ভূমিকাতেই ছিলেন। কেনেথের বাড়িতে পারিবারিক যত অনুষ্ঠান হতো সবখানেই অ্যাশলের ছিল সরব উপস্থিতি। অন্য কেউ আসুক বা না আসুক, এমন কখনো হয়নি যে অ্যাশলে পারিবারিক অনুষ্ঠান বাদ দিয়েছেন। শুরু থেকেই উইম্বারলি পরিবারের সঙ্গে অ্যাশলের সম্পর্ক অনেক গভীর ছিল। কেনেথ যদি কখনো লাটোয়াকে বাইরে নিয়ে যেতেন, সেখানে অ্যাশলেও যেতেন। যদি কেউ কেনেথকে জিজ্ঞেস করতেন, এই মেয়েরা কে। তিনি সব সময় বলতেন, তারা আমার মেয়ে। আবার কখনো অ্যাশলের গাড়ির কোনো সমস্যা হলে তিনি তার বাড়ির কাউকে না বলে সব সময় কেনেথের কাছে চলে যেতেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দুই পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের সঙ্গে কারও কখনো দেখা হয়নি।

বোন আর বাবাকে খুঁজে পাওয়ার বিষয়টি বেশ আনন্দের হলেও, আবেগঘন। অ্যাশলে যখন থেকে জানতে পেরেছেন তার বর্তমান বাবা আসলে তার বাবা নন, তখন থেকেই বাবা সম্পর্কে জানার প্রবল আকুতি তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। মায়ের প্রতি তার ছিল অসংখ্য প্রশ্ন। অথচ সেই প্রশ্নের কোনো জবাব ছিল না। এমনকি জবাব জানার কোনো উপায়ও ছিল না। মাইকেল মারা গেছেন অনেক বছর আগে, পরিবারের কেউ তার বাবার ব্যাপারে কিছু জানে না। অ্যাশলে যখন থেকে সত্যি জেনেছেন এরপরও তার বাবা কখনোই তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেননি। এমনকি আপন সন্তান না হওয়ার কারণে কোনো বঞ্চনার শিকার হওয়া বা এমন কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখিও হতে হয়নি অ্যাশলেকে। তিনি শুধু সেই ব্যক্তিকে বাবা বলে আর মানতে পারছিলেন না। অথচ আপন বাবা কেনেথ বাবার মতো সব সময় তার সঙ্গে থাকলেও তিনি যে তার বাবা হতে পারেন শুধু এই বিষয়েও তার কোনো ধারণা ছিল না।

কী ভাবছেন তিনজন

কোথাও বেড়াতে গেলে কেনেথ, অ্যাশলে আর লাটোয়া সব সময় একসঙ্গে থাকতেন। একে অন্যকে পরিবারের সদস্য বলেও পরিচিত করিয়ে দিতেন। সত্যি না জেনেও তারা আপন হয়েছিলেন পরস্পরের। বোনকে ফিরে পাওয়ার এ ঘটনায় লাটোয়া দারুণ আনন্দিত। তবে তার মাঝে কিছু অপরাধবোধ কাজ করে। তাদের দুজনের বাবা একজনই, অথচ তিনি অ্যাশলের চেয়ে কেনেথকে বেশি সময় ধরে বাবা ডাকার সুযোগ পেয়েছেন, তার ভালোবাসা বেশি পেয়েছেন। অন্যদিকে ছোটবেলা থেকেই অ্যাশলেকে অনেক কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। অপরাধবোধ থাকলেও একটি আনন্দিত হওয়ার মতো বিষয়ও আছে। এখন কেনেথ যতটা সম্ভব অ্যাশলের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছেন।

কেনেথ বলেন, একজন বাবা হিসেবে আমি সব সময় আমার সন্তানদের সঙ্গেই ছিলাম। আমি তাদের বড় করে তুলেছি। অথচ অ্যাশলে তার বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তার জন্য আমার সত্যিই অনেক খারাপ লাগে। তবে যে সময় চলে গেছে তাকে তো আর আমরা কেউ ফিরিয়ে আনতে পারব না। অ্যাশলে আমাকে সব সময় ‘বিগ কেনি’ বলে ডাকত। হুট করে সেই ডাক থেকে ‘বাবা’ বলে ডাকতে তার নিজেরও কিছু সময় লাগবে। তবে বাবা বলে ডেকে খুব মিষ্টি করে সে আমার দিকে তাকায়। এই ভালো লাগা থেকে এতদিন আমি নিজেও বঞ্চিত ছিলাম।

অ্যাশলে এখন দুই সন্তানের মা। এতদিন পর সত্যি জেনে কিছুটা অবিশ্বাস্য সময় কাটছে তার। তবু তিনি চান, কেনেথ যেন তার নাতিদের সঙ্গে দারুণ কিছু সময় কাটান। নতুন সম্পর্কে কেনেথও যেন তাদের অংশীদার হন। লাটোয়ার তিন সন্তানের সঙ্গে অ্যাশলের দুই সন্তানের সম্পর্কও দারুণ। তাদের মাঝেও গভীর বন্ধুত্ব ছিল। তারাও নতুন করে জেনেছে, তারা ভাই-বোন। স্বাভাবিকভাবে, মায়ের মতে তারা সবাই আনন্দিত।

কেনেথও চান অ্যাশলের সঙ্গে দারুণ একটি সম্পর্ক গড়ে তুলতে। এতদিন মেয়ের মতো ভালোবাসলেও এখন সত্যিকারেই মেয়েকে ভালোবাসা দিতে চান তিনি। তিনিও তার নাতিদের সঙ্গে সময় কাটাতে চান। কেনেথের ভাষ্যমতে, ‘আমি সব সময় আমার আশপাশে ছোট্ট শিশুদের ছুটোছুটি করতে দেখেছি। অথচ কখনো বুঝতেই পারিনি তারা আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ।’

কী করবেন অ্যাশলে ও লাটোয়া

ছোটবেলা থেকেই নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন মিলের কারণে সবাই তাদের বোন বলতেন। আজ যখন সত্যিই বোনের পরিচয় বের হওয়ার পর সব সম্পর্ক যেন এক মুহূর্তে বদলে গেছে। প্রায় দুই দশকের মতো সময় ধরে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকলেও তারা কখনো তাদের সত্যি সম্পর্কটা সম্পর্কে জানতে পারেননি। অবশ্যই তারা দুজনেই এখন দারুণ আনন্দিত। বন্ধুত্ব ধরে রেখে নতুন বন্ধনেও তারা শক্তভাবে আবদ্ধ হতে চান। ১৭ বছর ধরে তাদের বন্ধুত্ব গভীর থেকে আরও গভীর হয়েছে এটি সত্যি। নতুন সম্পর্ককে আরও সুন্দর করে তোলার জন্য তারা দুজন মিলে ঘুরতে যাচ্ছেন মিয়ামিতে। সেখানে পরিবারের অন্য কোনো সদস্যকে নেবেন না তারা। সময়ের এই পরিবর্তন নিয়ে অ্যাশলে বলেন, ‘বিষয়টি একটি ধাঁধার মতো। সামনে অনেকগুলো প্রশ্ন এলো। কীভাবে কীভাবে যেন সব জটিল প্রশ্নের সমাধান হয়ে গেল।