হাওর বার্তা ডেস্কঃ বয়ে চলেছে নদীর স্রোত ধারা। এ আর নতুন কি! তবে তা যদি হয় লাল রঙা পানি তবে আপনি অবাক হবেন নিশ্চয়ই! পানির তো কোনো রং নেই তবে এই নদীটি দেখতে লাল রঙের কেন এই প্রশ্নটি সবার মনে! মনে হয় যেন রক্তের স্রোত বয়ে চলেছে!
মঙ্গলগ্রহও তো লাল। তবে বিজ্ঞানীদের মতে, সেখানে নেই কোনো সূর্যের আলো কিংবা অক্সিজেন। কখনো কি দেখেছেন বিশ্বের কোথাও লাল রঙা এমন নদীর অস্তিত্ব! শুধু একটি স্থানেই রয়েছে এমন অবিশ্বাস্য এক নদী। স্পেনের রিও টিন্টোতে গেলেই আপনি রক্ত লাল এই বহমান নদীটি দেখতে পারবেন।
৫৮ মাইল দীর্ঘ এই নদীর গভীরে নেই কোনো অক্সিজেন। অটোমোবাইল ব্যাটারি অ্যাসিডের মতোই সেখানকার পানির পিএইচ (২ দশমিক ৫) এর মাত্রা। এই পানিতে প্রচুর আয়রন রয়েছে। তবে অবাক করা বিষয় হলো, অত্যন্ত অম্ল পানি হওয়া স্বত্ত্বেও নদীতে জীব বসবাস করছে। ছত্রাক, অ্যামিবাস এবং শৈবালসহ শত শত প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ নদীর জীবনকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে।
রিও টিন্টোর ইতিহাস
আকরিক খনি হিসেবে এই স্থানটির খননকার্য শুরু হয় অন্তত পাঁচ হাজার বছর পূর্বে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালে তারটিসান এবং ইবেরিয়ানরা খনির কাজ শুরু হয়। পরবের্তীতে ফোনিশিয়ান, গ্রীক, রোমান, ভিজিগোথ এবং মোরসরাও এই খননকাজে নিযুক্ত হয়। তামা, রূপা, সোনা এবং পরে আয়রন, ম্যাঙ্গানিজসহ নানান খনিজ পদার্থ উত্তোলিত হয় এই খনি থেকে।
১৫৫৬ সালে পুনরায় আবিষ্কৃত হয় এই খনিটি। অতঃপর স্প্যানিশ সরকার ১৭২৪ সালে পুনরায় এসব খনিজ পদার্থ উত্তোলন কার্য শুরু হয়। এরপর ১৯ শতকের দিকে যুক্তরাজ্য থেকে আসা বিভিন্ন সংস্থাগুলো এই স্থানে উত্তোলন কার্য চালায়। ১৯৩০ সালে এই স্থান থেকে সবচেয়ে বেশি সোনা, রূপা, তামাসহ খনিজ পদার্থ উত্তোলন করা হয়।
অতঃপর ১৯৮৬ সালে খনি থেকে তামা উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। আর ১৯৯৬ সালে বন্ধ হয় সেখান থেকে রূপা ও সোনা উত্তোলন। ২০০১ সাল থেকে পুরোপুরিভাবে এই খনি থেকে উত্তোলন কার্য বন্ধ হয়ে যায়। ২০১০ সালের দিকে তামার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এই খনিটি পুনরায় চালু করার চেষ্টা করা হলেও তা আর সম্ভব হয়নি। কারণ সেখানকার পরিবেশ জটিলতা। ততদিনে স্থানটি নদীতে পরিণত হয়েছে।
এই নদীতে ডুব দিলেই কঙ্কাল
স্পেনের দক্ষিণ পশ্চিম দিয়ে বয়ে যাওয়া এ নদীটির উৎস আন্দালুসিয়া পর্বতে। এই নদীর বিশেষত্ব হলো এর লালচে রং। তবে কেউই এই নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে গোসল করার শখ পূরণ করতে পারবে না। কেননা এই নদীতে ডুব দিলেই মানুষ কঙ্কালে পরিণত হবে। এর কারণ পানিতে থাকা ফেরিক আয়রন। এই অ্যাসিডিক পানিতে বসবাসকারী এক্সট্রোফিল অ্যায়ারোবিক ব্যাকটেরিয়া বসবাস করে।
এই ব্যাকটেরিয়া পানির সঙ্গে মিশে অনেক শক্তশালী হয়ে ওঠে। এ কারণেই মানুষ কিংবা জীব জন্তু সেই পানিতে গা ভেজালেই অ্যাসিডের কারণে শরীর ঝলসে গিয়ে কঙ্কালে পরিণত হয়। রিও টিন্টোর পানির গন্ধ অনেকটা পচা ডিমের গন্ধের মতো। আপনি যদি এই পানি কিছুদিন সংরক্ষণ করেন তবে তা কালচে রুপ ধারণ করবে।
নদীর বর্তমান অবস্থা
রিও টিন্টোর জলজ জীবন ও এই নদীর পরিবেশ নিয়ে গবেষকরা নানাবিধ পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। এ বিষয়ে রিকার্ডো আমিলস পিবারনেট বলেন, এই নদীতে প্রচুর আয়রনের অস্ত্বিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। এই নদীর বিশেষত্ব হলো এতে প্রচুর সালফিউরিক অ্যাসিড ও আয়রন। এই কেমিকেলের কারণে নদীর তলদেশে অক্সিজেনের ঘাটতি রয়েছে।
রিও টিন্টোর পরিবেশ সম্পর্কে এই বিজ্ঞানী বলেন, এই নদীতে অম্ল পানি ও অক্সিজেনের অভাব থাকা স্বত্বেও এর জীব বৈচিত্র্য চোখে পড়ার মতো। এই নদীতে প্রচুর পরিমাণে মাইক্রোবস, ছত্রাক, ফাঙ্গাস, অ্যামোবাস এবং অ্যালগা বসবাস করছে। তারা নির্বিঘ্নে জীবন ধারণ করছে নদীতে।
যদিও এই নদীতে প্রচুর আয়রন ও অক্সিজেনের ঘাটতি রয়েছে। সেইসঙ্গে নদীর মাটির অত্যন্ত অ্যাসিডিক ঘরানার। ঠিক যেন মঙ্গলগ্রহের সঙ্গে মিল রয়েছে নদীটির। রিও টিন্টোর আশেপাশের বন জঙ্গল যদি সরিয়ে ফেলা হয় তবে উপর থেকে দেখলে নদীটি ঠিক মঙ্গলগ্রহের ন্যায় দেখাবে এমনটিই বলেন আমিলস।
বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, অন্ত পাঁচ হাজার বছর পূর্বে এই রিও টিন্টো খনন করা হয়। খনিজ পদার্থ উত্তোলনের কারণেই স্থানটি খনন করা হয়েছিল। সেখানকার মাটিতে আয়রন থাকায় তা লাল রং ধারণ করেছে। ‘দ্য সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোবায়োলজি’ নদীর পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করে।
একটি রিমোট কন্ট্রোলড সাবমেরিন নদীর ২০০ ফিট গভীর পর্যন্ত পাঠানো হয়। এছাড়াও নদীর তলদেশে থাকা জীব বৈচিত্র্য সম্পর্কে জানতে নাসা কর্তৃক মঙ্গলগ্রহে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশগুলো সংগ্রহ করেন তারা। নাসার বিজ্ঞানী কেরল স্টোকার বলেন, নদীতে প্রচুর রাসায়নিক থাকলেও সেখানে রয়েছে অসংখ্য জলজ জীব ও উদ্ভিদ।
স্টোকার বলেন, রিও টিন্টোতে বসবাসকৃত জীব রাসায়নিক উপায়ে শক্তি অর্জন করে। সূর্যের আলো থেকে নয়। আয়রন এবং সালফার মূলত এই জীবগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এ কারণেই তাদের অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে না।
মঙ্গলগ্রহ ও রিও টিন্টোর মিল
স্টোকার এবং আমিলসের ধারণা মঙ্গলগ্রহের সঙ্গে রিও টিন্টোর পরিবেশের অনেক মিল রয়েছে। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা নদীর তলদেশের মাটি সংগ্রহ করেন। প্রায় ৩৩০ ফুট নিচ থেকে তারা নদীর ভূ-গর্ভস্থ মাটি সংগ্রহ করেন। এক্ষেত্রে একটি রিমোট কন্ট্রোল ড্রিল মেশিন ব্যবহার করেন গবেষকরা।
তারা সেখানকার মাটি সংগ্রহ করেন। এরপর ল্যাবে ওই মাটি ও মঙ্গলগ্রহের মাটির নমুনা বিশ্লেষণ করেন বিজ্ঞানীরা। তারা অবাক হয়ে যান, দুই স্থানের মাটির মধ্যেই মিল রয়েছে। তারা আশাবাদী, মঙ্গল গ্রহেও প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে ঠিক যেভাবে রয়েছে এই নদীতে।