ঢাকা ০৩:৫৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সোনাপুরে কৃষিবিপ্লব

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:৫২:৩৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৯ মার্চ ২০২০
  • ১৯৭ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ গোয়াইনঘাটের আলীরগাঁও ইউপির সোনাপুর গ্রামে যেতেই চোখে পড়ে- কৃষকদের উৎসবের আমেজ। পরামর্শ প্রদানে উপজেলার নবাগত কৃষি অফিসার আসছেন- এমন খবরে জড়ো হন ১৫-২০ জন কৃষক। কৃষকরা একে একে ঘুরে দেখান তাদের ফসলের মাঠের সোনালী দৃশ্য। নাগা মরিচ, তরমুজ, সূর্যমুখী, সরিষা, সিম, ফরাস (ঝাড়সিম), লাউ, কুমড়ো, মিষ্টি কুমড়া, করোলা, লাল শাক, ডাটা শাকসহ চোখে পড়ে কৃষিবিপ্লবের নানা প্রতিচ্ছবি। এখানকার উৎপাদিত নাগা মরিচ সরাসরি পাইকারের হাত হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। উৎপাদিত পণ্য বিক্রির মাধ্যমে প্রতিনিয়তই স্বাবলম্বী হচ্ছেন খেটে খাওয়া কৃষকরা। সোনার ফসলে ভরে উঠেছে সোনাপুর হাওর। সোনালী হাসিতে তৃপ্ত কৃষকের চোখে দেখা যায় আনন্দ অশ্রু।

সোনাপুর গ্রামটি গোয়াইনঘাটের ৫নং আলীর ইউনিয়নের খাস মৌজাধীন এবং বারহাল বাজারের দুই কিলোমিটার উত্তর দিকে অবস্থিত। সরাসরি পাকা সড়ক নেই। বারহাল বাজারের পূর্ব উত্তরের অজুহাত গ্রাম হয়ে শুষ্ক মৌসুমে ক্ষেতের আইল কেটে নির্মিত অস্থায়ী সড়কে চলে ছোট ছোট যানবাহন, মোটরসাইকেল। বর্ষায় নৌকাই একমাত্র ভরসা। এই গ্রামে ও আশপাশে ৩ শতাধিক কৃষকের বসবাস। শুষ্ক মৌসুমে সবাই রবি শস্য ফলান।
কথা হয় এই গ্রামের সফল কৃষক ফখরুল, সিরাজ, আলাউদ্দিন, আরজদ আলী, আলা উদ্দিন, এনাম উদ্দিন, বোরহান উদ্দিনের সঙ্গে। তারা জানালেন, এখানকার মাটি খুবই উর্বর। যে কোন ধরনের ফসলের বাম্পার ফলন হয়ে থাকে। গ্রামের সফল কৃষক ফখরুল ইসলাম (৩৫)। সফল এ কৃষক এবার সোনাপুর গ্রামের ক্ষেতে ১০ বিঘা জমিতে নাগা মরিচ লাগিয়েছেন। পাশাপাশি সিম, ঝাড় সিম, শসা, লাউ, লাল শাকসহ আর শাকসবজি লাগিয়েছেন। তার ক্ষেতের ফসল রোপণ, পরিচর্যাসহ এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৪ লাখ টাকা। ফলনও হয়েছে বাম্পার। সফল কৃষক জানালেন তার উৎপাদিত ফসলের মধ্যে শুধু মাত্র নাগা মরিচ বিক্রি করে তিনি পেয়েছেন ১৫ লাখ টাকা। তার এ আয় থেকে বাড়িতে নতুন বিল্ডিংয়ের কাজ শুরু করেছেন বলে জানান। সোনাপুরের কৃষক সিরাজ উদ্দিন। তিনি এবার ৮ বিঘা জমিতে নাগা মরিচ, ১ বিঘায় সূর্যমুখী ফুল, ১০ বিঘায় ভুট্টা চাষ করেছেন। তার নাগা মরিচসহ এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৪ লাখ টাকা। শুধুমাত্র নাগা মরিচ বিক্রি হয়েছে ১৪ লাখ টাকা। সূর্যমুখী থেকে ২০ থেকে ২৫ হাজার এবং ভুট্টা থেকে আরও ২ লাখ টাকা আয় হতে পারে বলে জানান এই কৃষক। সোনাপুর গ্রামের সবচেয়ে কম বয়সী কৃষক ফখরুল ইসলাম (৩৫)। তিনি ১০ বছর থেকে কৃষিতে জড়িয়ে আছেন। এবার তিনি তার ক্ষেতে ১০ বিঘায় নাগা মরিচ ও ২ বিঘায় সিম চাষ করেছেন। তার এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং উৎপাদিত নাগা মরিচ থেকে বিক্রি আয় হয়েছে ১৬ লাখ টাকারও উপরে। সফল এ কৃষক জানালেন তার আয় থেকে এবার তিনি বাড়িতে পাকা বিল্ডিং তুলছেন। আরজদ আলী নামক আরেকজন কৃষক জানান, তিনি ৪ বিঘায় নাগা মরিচ, ৩ বিঘায় ফসার (ঝাড় সিম) ও ১ বিঘায় ভুট্টা চাষ করেছেন। ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা এবং উৎপাদিত  ফসল থেকে বিক্রি এসেছে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আরও আয় হতে পারে ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকা। আলাউদ্দিন নামের একজন কৃষক ৮ বিঘায় নাগা মরিচ, ২ বিঘায় তরমুজ চাষ করেছেন। নাগা মরিচে তার ব্যয় হয়েছে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, এ পর্যন্ত বিক্রি হতে আয় হয়েছে ৪ লাখ টাকা, আরও ১০ লাখ টাকা তার আয় হতে পারে। ২ বিঘা তরমুজ চাষে তার ব্যয় হয়েছে ৫০ হাজার টাকা আয় হতে পারে দেড় থেকে ২ লাখ টাকা বলে জানান তিনি। এখানকার কৃষকরা জানান, ফসল ফলানোর মানসিকতাসহ জমিতে কাজ করার সদিচ্ছা রয়েছে সোনাপুরের কৃষকদের। তারা জানান, তাদের উৎপাদিত নাগা মরিচসহ বিভিন্ন ফসল মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। কিন্তু সরাসরি সড়ক যোগাযোগ সমস্যা সোনাপুর গ্রামের কৃষকের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোনাপুরের সাথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত না হওয়ায় উৎপাদিত পণ্য সরাসরি পাইকারের হাতে তুলে দিতে পারেন না তারা। কাঁধে করে কিংবা টুকরিতে করে মাথায় নিয়ে ২ কিলোমিটার দূরবর্তী বারহাল বাজারে নিতে হয়। সেখান থেকে পাইকাররা তাদের উৎপাদিত পণ্য খরিদ করে থাকেন। এই সমস্যার সমাধান হলে বেকারত্ব দূরীকরণ, পতিত জমি কৃষিতে অন্তর্ভুক্তিসহ আরো সফলতা আসবে।
উপজেলা কৃষি অফিসার মো. সুলতান আলী জানান, গোয়াইনঘাটের প্রায় সব এলাকাতেই মাটি উর্বর এবং যে কোন ফসল ফলানোর উপযোগী। সোনাপুর গ্রামের মাটিও উর্বর এবং এখানকার কৃষকরা অত্যন্ত পরিশ্রমী। এই গ্রামের রবি শস্যের যে বিপ্লব চোখে পড়ছে তা তাদেরই কষ্টার্জিত ঘামের ফসল। এখানকার কৃষকদের সার, কীটনাশক প্রয়োগে সচেতনতা তৈরিসহ তাদের যে কোন কল্যাণে আমরা উপজেলা কৃষি বিভাগ সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত আছি। তাদের সমস্যাগুলো শনাক্ত করে কৃষিতে আরও সফল হওয়ার পথ বাতলে দেয়া হচ্ছে। গোয়াইনঘাটের উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. নাজমুস সাকিব জানান, গোয়াইনঘাটের কৃষি ব্যবস্থাপনাকে এগিয়ে নিতে সরকার আন্তরিক। সরকার সব সময় কৃষকদের পাশে আছে এবং তাদের কল্যাণের জন্য যা দরকার তা গুরুত্ব সহকারে করবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

সোনাপুরে কৃষিবিপ্লব

আপডেট টাইম : ০৯:৫২:৩৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৯ মার্চ ২০২০

হাওর বার্তা ডেস্কঃ গোয়াইনঘাটের আলীরগাঁও ইউপির সোনাপুর গ্রামে যেতেই চোখে পড়ে- কৃষকদের উৎসবের আমেজ। পরামর্শ প্রদানে উপজেলার নবাগত কৃষি অফিসার আসছেন- এমন খবরে জড়ো হন ১৫-২০ জন কৃষক। কৃষকরা একে একে ঘুরে দেখান তাদের ফসলের মাঠের সোনালী দৃশ্য। নাগা মরিচ, তরমুজ, সূর্যমুখী, সরিষা, সিম, ফরাস (ঝাড়সিম), লাউ, কুমড়ো, মিষ্টি কুমড়া, করোলা, লাল শাক, ডাটা শাকসহ চোখে পড়ে কৃষিবিপ্লবের নানা প্রতিচ্ছবি। এখানকার উৎপাদিত নাগা মরিচ সরাসরি পাইকারের হাত হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। উৎপাদিত পণ্য বিক্রির মাধ্যমে প্রতিনিয়তই স্বাবলম্বী হচ্ছেন খেটে খাওয়া কৃষকরা। সোনার ফসলে ভরে উঠেছে সোনাপুর হাওর। সোনালী হাসিতে তৃপ্ত কৃষকের চোখে দেখা যায় আনন্দ অশ্রু।

সোনাপুর গ্রামটি গোয়াইনঘাটের ৫নং আলীর ইউনিয়নের খাস মৌজাধীন এবং বারহাল বাজারের দুই কিলোমিটার উত্তর দিকে অবস্থিত। সরাসরি পাকা সড়ক নেই। বারহাল বাজারের পূর্ব উত্তরের অজুহাত গ্রাম হয়ে শুষ্ক মৌসুমে ক্ষেতের আইল কেটে নির্মিত অস্থায়ী সড়কে চলে ছোট ছোট যানবাহন, মোটরসাইকেল। বর্ষায় নৌকাই একমাত্র ভরসা। এই গ্রামে ও আশপাশে ৩ শতাধিক কৃষকের বসবাস। শুষ্ক মৌসুমে সবাই রবি শস্য ফলান।
কথা হয় এই গ্রামের সফল কৃষক ফখরুল, সিরাজ, আলাউদ্দিন, আরজদ আলী, আলা উদ্দিন, এনাম উদ্দিন, বোরহান উদ্দিনের সঙ্গে। তারা জানালেন, এখানকার মাটি খুবই উর্বর। যে কোন ধরনের ফসলের বাম্পার ফলন হয়ে থাকে। গ্রামের সফল কৃষক ফখরুল ইসলাম (৩৫)। সফল এ কৃষক এবার সোনাপুর গ্রামের ক্ষেতে ১০ বিঘা জমিতে নাগা মরিচ লাগিয়েছেন। পাশাপাশি সিম, ঝাড় সিম, শসা, লাউ, লাল শাকসহ আর শাকসবজি লাগিয়েছেন। তার ক্ষেতের ফসল রোপণ, পরিচর্যাসহ এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৪ লাখ টাকা। ফলনও হয়েছে বাম্পার। সফল কৃষক জানালেন তার উৎপাদিত ফসলের মধ্যে শুধু মাত্র নাগা মরিচ বিক্রি করে তিনি পেয়েছেন ১৫ লাখ টাকা। তার এ আয় থেকে বাড়িতে নতুন বিল্ডিংয়ের কাজ শুরু করেছেন বলে জানান। সোনাপুরের কৃষক সিরাজ উদ্দিন। তিনি এবার ৮ বিঘা জমিতে নাগা মরিচ, ১ বিঘায় সূর্যমুখী ফুল, ১০ বিঘায় ভুট্টা চাষ করেছেন। তার নাগা মরিচসহ এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৪ লাখ টাকা। শুধুমাত্র নাগা মরিচ বিক্রি হয়েছে ১৪ লাখ টাকা। সূর্যমুখী থেকে ২০ থেকে ২৫ হাজার এবং ভুট্টা থেকে আরও ২ লাখ টাকা আয় হতে পারে বলে জানান এই কৃষক। সোনাপুর গ্রামের সবচেয়ে কম বয়সী কৃষক ফখরুল ইসলাম (৩৫)। তিনি ১০ বছর থেকে কৃষিতে জড়িয়ে আছেন। এবার তিনি তার ক্ষেতে ১০ বিঘায় নাগা মরিচ ও ২ বিঘায় সিম চাষ করেছেন। তার এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং উৎপাদিত নাগা মরিচ থেকে বিক্রি আয় হয়েছে ১৬ লাখ টাকারও উপরে। সফল এ কৃষক জানালেন তার আয় থেকে এবার তিনি বাড়িতে পাকা বিল্ডিং তুলছেন। আরজদ আলী নামক আরেকজন কৃষক জানান, তিনি ৪ বিঘায় নাগা মরিচ, ৩ বিঘায় ফসার (ঝাড় সিম) ও ১ বিঘায় ভুট্টা চাষ করেছেন। ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা এবং উৎপাদিত  ফসল থেকে বিক্রি এসেছে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আরও আয় হতে পারে ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকা। আলাউদ্দিন নামের একজন কৃষক ৮ বিঘায় নাগা মরিচ, ২ বিঘায় তরমুজ চাষ করেছেন। নাগা মরিচে তার ব্যয় হয়েছে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, এ পর্যন্ত বিক্রি হতে আয় হয়েছে ৪ লাখ টাকা, আরও ১০ লাখ টাকা তার আয় হতে পারে। ২ বিঘা তরমুজ চাষে তার ব্যয় হয়েছে ৫০ হাজার টাকা আয় হতে পারে দেড় থেকে ২ লাখ টাকা বলে জানান তিনি। এখানকার কৃষকরা জানান, ফসল ফলানোর মানসিকতাসহ জমিতে কাজ করার সদিচ্ছা রয়েছে সোনাপুরের কৃষকদের। তারা জানান, তাদের উৎপাদিত নাগা মরিচসহ বিভিন্ন ফসল মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। কিন্তু সরাসরি সড়ক যোগাযোগ সমস্যা সোনাপুর গ্রামের কৃষকের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোনাপুরের সাথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত না হওয়ায় উৎপাদিত পণ্য সরাসরি পাইকারের হাতে তুলে দিতে পারেন না তারা। কাঁধে করে কিংবা টুকরিতে করে মাথায় নিয়ে ২ কিলোমিটার দূরবর্তী বারহাল বাজারে নিতে হয়। সেখান থেকে পাইকাররা তাদের উৎপাদিত পণ্য খরিদ করে থাকেন। এই সমস্যার সমাধান হলে বেকারত্ব দূরীকরণ, পতিত জমি কৃষিতে অন্তর্ভুক্তিসহ আরো সফলতা আসবে।
উপজেলা কৃষি অফিসার মো. সুলতান আলী জানান, গোয়াইনঘাটের প্রায় সব এলাকাতেই মাটি উর্বর এবং যে কোন ফসল ফলানোর উপযোগী। সোনাপুর গ্রামের মাটিও উর্বর এবং এখানকার কৃষকরা অত্যন্ত পরিশ্রমী। এই গ্রামের রবি শস্যের যে বিপ্লব চোখে পড়ছে তা তাদেরই কষ্টার্জিত ঘামের ফসল। এখানকার কৃষকদের সার, কীটনাশক প্রয়োগে সচেতনতা তৈরিসহ তাদের যে কোন কল্যাণে আমরা উপজেলা কৃষি বিভাগ সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত আছি। তাদের সমস্যাগুলো শনাক্ত করে কৃষিতে আরও সফল হওয়ার পথ বাতলে দেয়া হচ্ছে। গোয়াইনঘাটের উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. নাজমুস সাকিব জানান, গোয়াইনঘাটের কৃষি ব্যবস্থাপনাকে এগিয়ে নিতে সরকার আন্তরিক। সরকার সব সময় কৃষকদের পাশে আছে এবং তাদের কল্যাণের জন্য যা দরকার তা গুরুত্ব সহকারে করবে।