হাওর বার্তা ডেস্কঃ সারা পৃথিবীর নজর এখন এশিয়ার দিকে। ইউরোপ-আমেরিকা এখন আর উন্নয়ন- কর্মসংস্থানের এক নম্বর জায়গা নয়। তাকলাগানো উন্নয়ন ঘটছে এশিয়ায়। মধ্য এশিয়ার তেল-গ্যাসসমৃদ্ধ দেশগুলো আর চীন, কোরিয়া, জাপান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম উদীয়মান অর্থনীতির দেশ।
এসব দেশের উন্নয়ন, বাড়তি অর্থ, উৎপাদিত সামগ্রী আর কারিগরি জ্ঞান অন্যান্য দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে। এশিয়া এখন উন্নয়নের সড়কে। বাংলাদেশ সে সড়কে অন্যদের সহযাত্রী। চীনের উত্থান এবং ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর কল্যাণে চীন এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ইউরোপের সংযোগ সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেছে। তারা এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার প্রজেক্টের যোগাযোগ, অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদিতে খরচ করছে।
নিজের দেশের শিল্পকারখানা পরিচালনায় তেল-গ্যাসের বিপুল চাহিদার কথা মনে রেখে চীন স্থির লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। অন্যদিকে ৭০-৮০ দশকের চীনের পররাষ্ট্রনীতিও এখন ভিন্নতর। চীন এখন অপর দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোনোরকম মন্তব্যও করে না। চীনের এখন শতভাগ শক্তি বিনিয়োগ হচ্ছে উন্নয়নের ক্ষেত্রে। এতে এশিয়া-ইউরোপের দেশগুলোও স্বস্তিতে আছে। চীনের আন্তঃদেশীয় এসব বিনিয়োগ চলুন সামান্য হলেও দেখে আসি-
চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক : বাংলাদেশের বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু এবং সেতুর সঙ্গে সংযোগ হতে যাওয়া রেল সড়ক নির্মাণ করছে চীন। এতে চীনের প্রযুক্তি, চীনের প্রকৌশল জ্ঞান ও চীনের দক্ষ শ্রমশক্তি নিয়োজিত রয়েছে। এতে লাভবান হচ্ছে বাংলাদেশের দক্ষ শ্রমিকগোষ্ঠী ও অর্থনীতি। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল নির্মিত হচ্ছে চীনের প্রযুক্তিতে। তাতেও চীনের প্রকৌশলীরা শ্রম বিনিয়োগ করছে। এ টানেল নির্মিত হলে চট্টগ্রাম শহরের পরিধিই শুধু বাড়বে না; ব্যবসা-বাণিজ্যেও ঘটবে ব্যাপক উন্নয়ন। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণেও চীন কাজ করছে। চট্টগ্রামে পায়রা বন্দর ছাড়াও তৃতীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র কক্সবাজারে স্থাপিত হতে যাচ্ছে।
এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশ বর্তমানের প্রয়োজন মিটিয়ে ভবিষ্যতের প্রয়োজন মেটাতেও সক্ষম হবে। তবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। কেননা, এত ছাই আর ধোঁয়ার প্রকোপ শূন্যে নামিয়ে আনা অসম্ভব। ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ চীনে ১৮ বিলিয়ন ডলার পণ্য রফতানি করতে সক্ষম হবে বলে ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস। চীনের করোনাভাইরাস অবশ্য চীনের অর্থনীতি স্থবির করে ফেলেছে কিছু সময়ের জন্য। বড় ২-৩টি শহর সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমরা আশাবাদী, দ্রুত এ রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হবে। এতে অবশ্য চীনের কর্মক্ষমতা বহুগুণ বৃদ্ধির চিত্রও ফুটে উঠছে। যেমন, ৬-৭ দিনে বৃহৎ হাসপাতাল নির্মাণ। চীনের অন্যান্য প্রদেশে শিল্প উৎপাদন ধরে রাখা, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে শত শত কোটি ডলার খরচ করা ইত্যাদি।
চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক : চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। কারাকোরাম হাইওয়ে আরও প্রশস্ত এবং চলাচল উপযোগী করা হয়েছে। পাকিস্তানের রেল, সড়ক, পোর্ট, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণে চীন ৪৬ বিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছে। ১৩ নভেম্বর ২০১৬ সালে চীনের গোয়াদার (Gwadar) সমুদ্রবন্দর হয়ে আফ্রিকা এবং পশ্চিম এশিয়ায় রফতানি শুরু হয়; বিগত ৪ বছরে যার পরিসর বৃদ্ধি পেয়েছে। চীন সড়কপথ নির্মাণে করাচি থেকে গোয়াদার পর্যন্ত হাইওয়ে নির্মাণ করছে। করাচি থেকে লাহোর পর্যন্ত ১১০০ কিমি. দীর্ঘ দ্বিতীয় হাইওয়ে নির্মিত হচ্ছে। করাচি-পেশোয়ার রেললাইনকে ১৬০ কিমি. গতিবেগে ট্রেন চলাচলের উপযুক্ত করা হচ্ছে।
এসব প্রজেক্টে ৪০ হাজার পাকিস্তানি ও ৮০ হাজার চীনার কর্মসংস্থান সম্ভব হচ্ছে। চীন, পাকিস্তানে ফাস্টট্র্যাক ২০ বিলিয়ন ডলার প্রজেক্টেও কাজ করছে, যা Early harvest বা দ্রুত ফলদায়ক প্রজেক্ট বলে চিহ্নিত হচ্ছে। পাকিস্তানের প্রায় দেউলিয়া অর্থনীতিতে এগুলো সুফল আনবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। এ ছাড়া সামরিক ক্ষেত্রে চীন-পাকিস্তান যৌথভাবে JS-17 Fighter বিমান নির্মাণ করছে; যা মিগ-২৯ আর আমেরিকান এফ-১৬ বিমানের সমতুল্য অথচ দামে কম। এশিয়া এবং মুসলিম দেশগুলো এ বিমান ক্রয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছে; যা বিবদমান দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সামর্থ্যরে সমন্বয় ঘটাবে বলে বিশ্বাস।
ভারত-ইরান-আফগানিস্তান সম্পর্ক : ভারতের সমর বিশেষজ্ঞরা ভারতকে হুশিয়ার করে বলেছে, পাকিস্তান ভারতকে ঘিরে ফেলতে চায়। এ জন্য ভারতের দরকার স্থল ও জলপথে দ্রুত এবং নিরাপদ চলাচল। ভারতের মুম্বাই থেকে পণ্য পরিবহন করে যদি মধ্য এশিয়ার দেশগুলো ও আফগানিস্তানে না নিতে পারে, তাহলে ভারতের উচ্চাশা পূরণ কীভাবে সম্ভব? এ জন্য ইরান-পাকিস্তান-ভারত তেল পাইপলাইন ছাড়াও ভারত চাচ্ছে ইরানের চাহাবার পোর্টে বিনিয়োগ। এ জন্য ইরান-ভারত একযোগে কাজ করছে, যাতে চাহাবার পোর্ট থেকে ইরান, আফগানিস্তান ও মধ্যএশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য যোগাযোগ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়। ভারত প্রাথমিকভাবে ৫০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে চাহাবার পোর্ট উন্নয়ন ও যোগাযোগ খাতে। এতে ভারত মধ্যএশিয়া এবং ইরান-আফগানিস্তানের সঙ্গে সহজ উপায়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবে। এটি পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে ভারতের ব্যবসা পরিচালনার একটি কার্যকর কৌশল। এরই মধ্যে ভারত-ইরান-আফগানিস্তান ট্রানজিট এবং টুরিস্ট চুক্তি সম্পাদন করেছে।
এতে চাহাবার পোর্ট হয়ে ভারত-ইরান-আফগানিস্তানে ব্যবসা-বাণিজ্য, পণ্য পরিবহন ছাড়াও ভ্রমণকারীদের জন্য নিজ নিজ দেশ খুলে দিয়েছে। ইরান-ভারত বিশ্বাস করে, মানুষে মানুষে যোগাযোগ বৃদ্ধি পেলে ব্যবসার নতুন সহযোগিতার ক্ষেত্র যেমন প্রসারিত হবে, তেমনি পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থাও বৃদ্ধি পাবে। সবচেয়ে বড় পাওয়া আফগানিস্তানের। কেননা, স্থলভূমি পরিবেষ্টিত আফগানিস্তান সমুদ্রপথের সংযোগ খুঁজছিল বহুদিন। বলা যায়, পাকিস্তান এতে সুযোগ হাতছাড়া করেছে। আর ইরান-ভারত-আফগানিস্তানের বাজার সম্প্রসারণে ভূমিকা সুদৃঢ় করেছে। ভারত-ইরান-আফগানিস্তানের সরকারপ্রধানরা ১২টি চুক্তিতে অ্যালুমিনিয়াম থেকে ইউরেনিয়াম পর্যন্ত বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের চুক্তি সম্পাদন করেছে। মোটামুটি অবরুদ্ধ ইরান ভারতের সঙ্গে এসব চুক্তিতে অ্যালুমিনিয়াম, স্টিল, পেট্রোকেমিক্যাল, বায়োটেকনোলজি, নেনোটেকনোলজি, আইটি সেক্টরে ব্যাপক সহযোগিতার প্রত্যাশা করছে।
বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার ব্যাপক উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে; যদি পারস্পরিক বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে একযোগে কাজ করে। প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখলে যেমন অপ্রয়োজনীয় সামরিক ব্যয় কমানো সম্ভব, তেমনি অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও ব্যাপক বিস্তৃতি আনা সহজ হয়। মিয়ানমারের চাল, পেঁয়াজ, কাঠ, মাছ ইত্যাদি সময়ভেদে বাংলাদেশের দরকার। যখনই বাংলাদেশের প্রয়োজন পড়বে, তখন দ্রুত সহজে ও কম মূল্যে ভারত-মিয়ানমার থেকে এসব পণ্য আনাই উত্তম।
এ জন্য দরকার পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা। সে আস্থা অর্জনে মিয়ানমার-ভারতের সঙ্গে এ দেশের মানুষের সম্পর্ক দৃঢ় নয়। এটি কঠিন সত্য। মেকি বন্ধুত্ব বেশিদিন টেকে না। এ জন্য দরকার সবাইকে একটু ছাড় দিয়ে সমান স্তরে উঠে এসে আলোচনা করা। না হলে নিজেরই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। এসব দেশের মানুষ উন্নয়নের সুফল ভোগ করতে পারবে না।
ভারতের উগ্র হিন্দু জাতীয়তা, ভারতের বর্তমানের নাগরিকত্ব আইন, মোদি সরকারের কিছু কিছু বিষয় বাংলাদেশের মানুষকে পীড়িত করে এটা স্বাভাবিক। রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতা ও এ দেশে তাদের বিতাড়ন করে মিয়ানমার বাংলাদেশের বুকে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। ভালো দিক হল, বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান এবং আমাদের সোয়া কোটি মানুষের জায়গা দেয়া ভুলেনি। বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ। এটি মানুষ বিশ্বাস করে। তবে তার জন্য বন্ধুত্ব সৃষ্টি করা দরকার। খাঁটি বন্ধুত্ব। যে বন্ধুত্ব শুধু দুটি সরকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না; দুই দেশের মানুষের মধ্যেও বিরাজ করবে।
তেমনি মিয়ানমারেরও দরকার হতে পারে বাংলাদেশের। সে জন্য দুটি ক্ষেত্রেই ব্যাপক আলোচনা দরকার। দরকার রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে সসম্মানে ফিরিয়ে নেয়া ও নাগরিকত্ব প্রদান। রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি শুধু বাংলাদেশের আর্থিক ও পরিবেশগত ক্ষতিই করছে না; বরং এতে বড় ক্ষতি হচ্ছে মিয়ানমার-ভারতের। এরা প্রতিনিয়ত সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে প্রাকৃতিক নিয়মে। হয়তো এদের ক্ষুদ্র একটি অংশকে ব্যবহার করবে স্বার্থান্বেষী মহল। তাদের মধ্যে গড়ে উঠবে প্রতিরোধ গ্র“প। এটি সামলানো কি বাংলাদেশের একার দায়িত্ব? এদের শিক্ষা, চলাচল ও বাসস্থানের সুযোগ সৃষ্টির বিষয়টি নিঃসন্দেহে মানবিক। প্রশ্ন হল, কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে এদের কতদিন আটকিয়ে রাখা সম্ভব? ভাসানচরেও বা কতদিন?
আমরা বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা ও কতগুলো দেশকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, তারা বিশ্বের জন্য সমস্যা হবে, যদি না তাদের নিজদেশে ফেরত নেয়া না হয়। সবচেয়ে বড় কথা, এদের মধ্যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা উচ্চশিক্ষিত হওয়ার মানবিক সুযোগ কি চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে? একটি মানবিক দেশ নিজদেশের মানুষের জন্য সব সুযোগ সৃষ্টি করে; যাতে মানুষ সামান্য হলেও খুশি থাকে এবং এ স্বস্তি ও পরিবেশ অন্যদেরও অনুরণিত করে, ছড়িয়ে পড়ে। এর ব্যত্যয় ঘটলে বড় শক্তির কোনো দেশ সেখানে নাক গলায়। এর অন্যতম উদাহরণ ইরাক ও লিবিয়া। ব্যাপক ও চোখে পড়ার মতো উন্নয়ন ঘটিয়েও লিবিয়া-ইরাক শেষ হয়ে গেছে। দেশ দুটিকে ১০০ বছর পেছনে টেনে নেয়া হয়েছে। উদাহরণ থেকে নিশ্চয়ই শিখব আমরা!
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম (অব.) : তুরস্কে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক সামরিক অ্যাটাশে
jahangir010754@gmail.com