ঢাকা ১০:০৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫, ২৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দৃষ্টিহীনতা থামাতে পারেনি যার লেখালেখি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৫:২৮:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৯ ফেব্রুয়ারী ২০২০
  • ২৬২ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ চোখ আমাদের দেহের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। চোখ ছাড়া শুধু দুনিয়াই নয়, জীবনও অন্ধকার। এমন অনেক অচল অন্ধ মানুষ আছেন যারা অন্যের উপর নির্ভর করেই বেঁচে আছেন। কিন্তু আজ আপানাদের জন্য রয়েছে সাহসী এক নারীর গল্প। যিনি অন্ধ হয়েও লিখে চলেছেন নির্দ্বিধায়।

পৃথিবীর মানুষকে চমকে দেয় যার চিন্তা চেতনা তিনি হচ্ছেন কোহিনুর আকতার জুঁই। যিনি একজন লিখিকা। কবিতা লিখে বলে অনেকেই তাকে কবি বলেও ডাকেন। সাত বছর বয়সে গুটি বসন্তের কারণে দৃষ্টি হারান জুঁই। কিন্তু দৃষ্টিহীন হলেও থেমে থাকেনি তার হাত। না দেখেই তিনি লিখতে পারেন।

কোহিনুর আকতার জুঁই

কোহিনুর আকতার জুঁই

অনেকেই অবাক হয়ে তাকে বলেন, এটা আপনি লিখছেন? এটা আপনার লেখা? উত্তরে তিনি বলেন, হ্যাঁ আমি লিখছি। আবারো প্রশ্ন আসে, কীভাবে লিখছেন? তিনি বলেন, ‘আমি মনে মনে সাজাইছি, তারপর একজনরে বলছি। সে লিখে দিছে, পরে বই ছাপাইছি।‘

তার সাজানো চার লাইনের একটি প্যারা। তিনি এক লাইন করে বলেন আর অন্যজন তা লিখেন। তার লেখা একটি কবিতার নাম উপহার। কবিতার চারটি লাইন হলো-

‘আজি এ শুভদিনে কি দিবো তোমায় উপহার
তোমাকে দেবার মতো নেই তো কিছুই আমার।
তুমি থাকো শ্বেতপাথরে গড়া অট্টালিকা পর
আমার বসতি পুঞ্জবীথিকা ছায় ক্ষুদ্র মাটির ঘরে।‘

জুঁই বলেন অন্যজন লিখেন

জুঁই বলেন অন্যজন লিখেন

তিনি প্রকৃতি নিয়েও কবিতা লিখেন। অনেকেই তাকে প্রশ্ন করেন, ‘প্রাকৃতিক দৃশ্য তো আপনি দেখেন না, কীভাবে লেখেন?’

উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা আমি মনের কল্পনা থেকে লিখি। আমি সাত বছর পর্যন্ত দেখছি। তখন তো বুঝিনি, তখন শুধু দেখছি। আর এখন সেটাকে উপলব্ধি করি।‘

কিছু সৃষ্টি করার মধ্যে অন্যরকম একটা আনন্দ পান তিনি। আর সেই আনন্দ থেকেই লেখেন। লেখালেখির পাশাপাশি অন্ধদের জন্য হাসপাতাল নির্মাণ করেছেন জুঁই। তবে নির্মাণাধীন হাসপাতালের জিনিসপত্র চুরি হওয়ায় সেটি থমকে গেছে। হাসপাতালটির দিয়েছিলেন, কোহিনুর চক্ষু হাসপাতাল অন্ধ মহিলা সংস্থা। তার উদ্যোগেই এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর এর পরিচালক ছিলেন তিনি নিজেই।

জুঁই এর তৈরি পরিত্যাক্ত হাসপাতাল

জুঁই এর তৈরি পরিত্যাক্ত হাসপাতাল

তিনি বলেন, ‘আমি যখন প্রথম বইটা লিখছি ওটার মধ্যে লেখা ছিল যে, এই বিক্রিত টাকা আমি আমার চক্ষু হাসপাতালের জন্য ব্যয় করবো এবং তাই করছি।‘

সেই বই বিক্রির টাকা জমিয়ে তিনি অফিসের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনেছেন। আবার অনেক সময় কমতি পড়লে সেই জমানো টাকা থেকে ডাক্তারদের বেতন দিতেন। হাজার কষ্ট করেও তিনি হাসপাতালটি টিকিয়ে রাখতে পারেন নি। হাসপাতালের সব কিছু চুরি হয়ে যায়। আসবাবপত্র সব খুলে নিয়ে যায়। যার কারণে সুন্দর হাসপাতালটি এখন অসুন্দর হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, ‘আমি থেমে থাকবো না। আবার নতুন করে সব গোছাবো। এটা করতে যত দিন লাগে, যত সময় লাগে, যত শ্রম লাগে আমি দিবো।‘

পরিত্যাক্ত হাসপাতালের আসবাবপত্র

পরিত্যাক্ত হাসপাতালের আসবাবপত্র

দুনিয়ায় বিভিন্ন মানুষের বসতি। এখানে কেউ ভালো কেউ মন্দ, কেউ বিশ্বাসী কেউ অবিশ্বাসী। সব মেনেই চলতে হয়, এইটাই বাস্তবতা। তবে কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সবাই ছুটে গেলেও তিই যেতে পারেন না। তার ব্যথা সেখানেই। যখন কেউ তাকে সুন্দর বলে, কিন্তু তিনি তার সৌন্দর্য দেখতে পারেন না। তা তাকে কষ্ট দেয়। সবার মতো স্বাধীন না থাকতে পারাটা তার কাছে যন্ত্রণার। তিনি পরাধীনতা পছন্দ করেন না।

তবে সবাই তাকে বলে, না দেখতে পারাটাই তার জন্য সৌভাগ্যের। কারণ এই জগতে অনেক কিছু ঘটে, যা তারা দেখেন কিন্তু জুঁই দেখেন না। তাতে তার চোখের পাপ হয় না।

কোহিনুর আকতার জুঁই

কোহিনুর আকতার জুঁই

তিনি বলেন, ‘যখন এই কথা বলে তখন আমি মনে করি আমার চোখ না থাকাটাই কি ভালো!’

সবারই কিছু না কিছু দুর্বলতা থাকে। তবে তা কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াটাই সাহসিকতা। জুঁই তেমনি একটি উদাহরণ আমাদের সবার জন্য। যার সাহসিকতা ও জনকল্যাণমূলক মনোভাব সমাজের সবার জন্যই জরুরি।

সূত্র:বিবিসি

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

দৃষ্টিহীনতা থামাতে পারেনি যার লেখালেখি

আপডেট টাইম : ০৫:২৮:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৯ ফেব্রুয়ারী ২০২০

হাওর বার্তা ডেস্কঃ চোখ আমাদের দেহের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। চোখ ছাড়া শুধু দুনিয়াই নয়, জীবনও অন্ধকার। এমন অনেক অচল অন্ধ মানুষ আছেন যারা অন্যের উপর নির্ভর করেই বেঁচে আছেন। কিন্তু আজ আপানাদের জন্য রয়েছে সাহসী এক নারীর গল্প। যিনি অন্ধ হয়েও লিখে চলেছেন নির্দ্বিধায়।

পৃথিবীর মানুষকে চমকে দেয় যার চিন্তা চেতনা তিনি হচ্ছেন কোহিনুর আকতার জুঁই। যিনি একজন লিখিকা। কবিতা লিখে বলে অনেকেই তাকে কবি বলেও ডাকেন। সাত বছর বয়সে গুটি বসন্তের কারণে দৃষ্টি হারান জুঁই। কিন্তু দৃষ্টিহীন হলেও থেমে থাকেনি তার হাত। না দেখেই তিনি লিখতে পারেন।

কোহিনুর আকতার জুঁই

কোহিনুর আকতার জুঁই

অনেকেই অবাক হয়ে তাকে বলেন, এটা আপনি লিখছেন? এটা আপনার লেখা? উত্তরে তিনি বলেন, হ্যাঁ আমি লিখছি। আবারো প্রশ্ন আসে, কীভাবে লিখছেন? তিনি বলেন, ‘আমি মনে মনে সাজাইছি, তারপর একজনরে বলছি। সে লিখে দিছে, পরে বই ছাপাইছি।‘

তার সাজানো চার লাইনের একটি প্যারা। তিনি এক লাইন করে বলেন আর অন্যজন তা লিখেন। তার লেখা একটি কবিতার নাম উপহার। কবিতার চারটি লাইন হলো-

‘আজি এ শুভদিনে কি দিবো তোমায় উপহার
তোমাকে দেবার মতো নেই তো কিছুই আমার।
তুমি থাকো শ্বেতপাথরে গড়া অট্টালিকা পর
আমার বসতি পুঞ্জবীথিকা ছায় ক্ষুদ্র মাটির ঘরে।‘

জুঁই বলেন অন্যজন লিখেন

জুঁই বলেন অন্যজন লিখেন

তিনি প্রকৃতি নিয়েও কবিতা লিখেন। অনেকেই তাকে প্রশ্ন করেন, ‘প্রাকৃতিক দৃশ্য তো আপনি দেখেন না, কীভাবে লেখেন?’

উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা আমি মনের কল্পনা থেকে লিখি। আমি সাত বছর পর্যন্ত দেখছি। তখন তো বুঝিনি, তখন শুধু দেখছি। আর এখন সেটাকে উপলব্ধি করি।‘

কিছু সৃষ্টি করার মধ্যে অন্যরকম একটা আনন্দ পান তিনি। আর সেই আনন্দ থেকেই লেখেন। লেখালেখির পাশাপাশি অন্ধদের জন্য হাসপাতাল নির্মাণ করেছেন জুঁই। তবে নির্মাণাধীন হাসপাতালের জিনিসপত্র চুরি হওয়ায় সেটি থমকে গেছে। হাসপাতালটির দিয়েছিলেন, কোহিনুর চক্ষু হাসপাতাল অন্ধ মহিলা সংস্থা। তার উদ্যোগেই এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর এর পরিচালক ছিলেন তিনি নিজেই।

জুঁই এর তৈরি পরিত্যাক্ত হাসপাতাল

জুঁই এর তৈরি পরিত্যাক্ত হাসপাতাল

তিনি বলেন, ‘আমি যখন প্রথম বইটা লিখছি ওটার মধ্যে লেখা ছিল যে, এই বিক্রিত টাকা আমি আমার চক্ষু হাসপাতালের জন্য ব্যয় করবো এবং তাই করছি।‘

সেই বই বিক্রির টাকা জমিয়ে তিনি অফিসের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনেছেন। আবার অনেক সময় কমতি পড়লে সেই জমানো টাকা থেকে ডাক্তারদের বেতন দিতেন। হাজার কষ্ট করেও তিনি হাসপাতালটি টিকিয়ে রাখতে পারেন নি। হাসপাতালের সব কিছু চুরি হয়ে যায়। আসবাবপত্র সব খুলে নিয়ে যায়। যার কারণে সুন্দর হাসপাতালটি এখন অসুন্দর হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, ‘আমি থেমে থাকবো না। আবার নতুন করে সব গোছাবো। এটা করতে যত দিন লাগে, যত সময় লাগে, যত শ্রম লাগে আমি দিবো।‘

পরিত্যাক্ত হাসপাতালের আসবাবপত্র

পরিত্যাক্ত হাসপাতালের আসবাবপত্র

দুনিয়ায় বিভিন্ন মানুষের বসতি। এখানে কেউ ভালো কেউ মন্দ, কেউ বিশ্বাসী কেউ অবিশ্বাসী। সব মেনেই চলতে হয়, এইটাই বাস্তবতা। তবে কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সবাই ছুটে গেলেও তিই যেতে পারেন না। তার ব্যথা সেখানেই। যখন কেউ তাকে সুন্দর বলে, কিন্তু তিনি তার সৌন্দর্য দেখতে পারেন না। তা তাকে কষ্ট দেয়। সবার মতো স্বাধীন না থাকতে পারাটা তার কাছে যন্ত্রণার। তিনি পরাধীনতা পছন্দ করেন না।

তবে সবাই তাকে বলে, না দেখতে পারাটাই তার জন্য সৌভাগ্যের। কারণ এই জগতে অনেক কিছু ঘটে, যা তারা দেখেন কিন্তু জুঁই দেখেন না। তাতে তার চোখের পাপ হয় না।

কোহিনুর আকতার জুঁই

কোহিনুর আকতার জুঁই

তিনি বলেন, ‘যখন এই কথা বলে তখন আমি মনে করি আমার চোখ না থাকাটাই কি ভালো!’

সবারই কিছু না কিছু দুর্বলতা থাকে। তবে তা কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াটাই সাহসিকতা। জুঁই তেমনি একটি উদাহরণ আমাদের সবার জন্য। যার সাহসিকতা ও জনকল্যাণমূলক মনোভাব সমাজের সবার জন্যই জরুরি।

সূত্র:বিবিসি