হাওর বার্তা ডেস্কঃ মানুষ দুই ধরনের খাবার খেয়ে থাকে। তার একটি হলো আমিষ তথা পশুপ্রাণী ও পাখির গোশ্ত। আর নিরামিষ তথা উদ্ভিদ ও শাকসবজি। আমিষের প্রয়োজন পূরণে গোশ্তই বেশি পছন্দ করে মানুষ। আর গোশ্ত খেতে সুস্বাদু-মজাদার হওয়ায় খাদ্য তালিকার মধ্যে গোশ্তের প্রতি মানুষের আগ্রহও বেশি।
গোশ্তের চাহিদা পূরণে মানুষ পশু-প্রাণীর গোশ্তের সঙ্গে পাখির গোশ্তও পছন্দ করে থাকে। কিন্তু সব পশু-প্রাণী বা পাখির গোশ্ত খাওয়া ইসলামে বৈধ নয়।
যেসব পশুর গোশ্ত খাওয়া বৈধ নয়, তাহলো-
>> পশুপ্রাণী ও পাখির গোশ্ত খাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু নিদর্শন ও বিধানের দিকে তাকালেই হালাল-হারাম নির্ণয় করা সহজ হয়ে যায়। তাই যেসব প্রাণীতে হারামের কোনো চিহ্ন পাওয়া যাবে তা খাওয়া বৈধ নয়। আর তাহ হতে পারে হিংস্র দাঁতওয়ালা পশুপ্রাণী। যা খাওয়া হারাম। যেমন-
‘বাঘ-সিংহ, নেকড়ে বাঘ, চিতা বাঘ, হাতি, কুকুর, শিয়াল, শূকর, বিড়াল, কুমির, কচ্ছপ, সজারু ও বানর ইত্যাদি।’
>> আবার এমন কিছু পাখি আছে যেগুলো হিংস্র হওয়ার কারণে সেগুলো খাওয়াও হারাম। যেমন-
‘ঈগল, বাজ, শ্যেন, পেঁচা ইত্যাদি।’
>> গোশ্ত খাওয়ার ব্যাপারে ইসলামে যেসব পশু-পাখি খাওয়াকে হারাম করেছেন। সেসব পশুপ্রাণী ও পাখি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ঘোষণাও দিয়েছেন বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আর তাহলো-
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁতবিশিষ্ট প্রত্যেক হিংস্র পশুপ্রাণী এবং নখ দিয়ে শিকারকারী প্রত্যেক হিংস্র পাখি খেতে নিষেধ করেছেন।’ (মুসলিম)
>> আবার এমন কিছু পশুপ্রাণী আছে যেগুলোর গোশ্ত খেতে নিষেধ করেছেন। সেগুলো খাওয়া হারাম। যেমন : গৃহপালিত গাধা। হাদিসে এসেছে-
হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খায়বারের যুদ্ধের দিন (গৃহপালিত) গাধার গোশ্ত খেতে নিষেধ করেছেন এবং ঘোড়ার গোশ্ত খেতে অনুমতি দিয়েছেন।’ (বুখারি, মুসলিম)
অন্য হাদিসে এসেছে-
হজরত ইবনু আবি আওফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘খায়বারের যুদ্ধের দিন আমরা ভীষণ ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলাম, আর তখন আমাদের পাতিলগুলোতে (গাধার গোশত) টগবগ করে ফুটছিল।
তিনি (রাবী) বলেন, কোন কোন পাতিলের গোশত পাকানো হয়ে গিয়েছিল। এমন সময়ে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লমের ঘোষণাকারী এসে ঘোষণা দিলেন- ‘তোমরা (গৃহপালিত) গাধার গোশত থেকে একটুও খাবে না এবং তা ঢেলে দেবে।’ (তখন) ইবনু আবি আওফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘ঘোষণা শুনে আমরা পরস্পর বলাবলি করলাম যে, যেহেতু গাধাগুলো থেকে খুমুস (এক-পঞ্চমাংশ) বের করা হয়নি এ কারণেই তিনি সেগুলো খেতে নিষেধ করেছেন।
(আবার) কেউ কেউ বললেন, তিনি চিরদিনের জন্যই গাধার গোশত খেতে নিষেধ করেছেন। কেননা গাধা অপবিত্র জিনিস খেয়ে থাকে।’ (বুখারি)
>> কুরআনেও কিছু পশুপ্রাণীর গোশ্ত হারাম করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো শুকর। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘তোমাদের জন্য মৃতপ্রাণী, রক্ত ও শূকরের গোশ্ত হারাম করা হয়েছে।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ৩)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন-
‘(হে রাসুল!) আপনি বলে দিন, যা কিছু বিধান ওহির মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছেছে, আহারকারী যা আহার করে তাতে তার জন্য আমি কোনো হারাম খাবার পাই না; কিন্তু মৃত অথবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শুকরের মাংস—এটা অপবিত্র অথবা অবৈধ। (সুরা আনআম : আয়াত ১৪৫)
>> নোংরা ও অপবিত্র কোনো কিছু খাওয়াও হারাম। তাই যে সব পশু ও পাখির মধ্যে নোংরা ও অপবিত্রতা পাওয়া যাবে তা খাওয়া যাবে না। অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘তাদের জন্য তিনি (রাসুল) পবিত্র বস্তু হালাল করেন আর অপবিত্র বস্তু হারাম করেন।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ১৫৭)
>> এ ঘোষণায় যা অন্তর্ভূক্ত, তাহলো-
‘মৃত পশুপ্রাণী, পাখি, পোকা-মাকড়, কীট-পতঙ্গ, প্রবাহিত রক্ত এবং সেসব খাবারে কোনো ধরণের উপকাতিা নেই- বিষ, মদ, খড়কুটা, মাদকদ্রব্য, তামাক ও অন্যান্য নেশজাতীয় দ্রব্য ইত্যাদি।’
>> রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেসব প্রাণী হত্যা করতে নিষেধ করেছেন কিংবা কোনো প্রাণীকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। আবার হাদিসে যেসব পশুপাখীর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে সেগুলো খাওয়া বৈধ নয়। আর তাহলো-
‘ইঁদুর, সাপ, টিকটিকি, বিচ্ছু, কাক, চিল, হুদহুদ, দোয়েল, ব্যঙ, পিঁপড়া ও মৌমাছি ইত্যাদি।’
মনে রাখা জরুরি
>> যেসব পশুপ্রাণী ও পাখির গোশ্ত খাওয়াকে ইসলাম বৈধ ঘোষণা করেছে, সেসহ হালাল পশুপ্রাণী ও পাখি যদি আল্লাহর নামে জবাই করা না হয় তবে তা খাওয়াও হারাম। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘আর তোমরা তা থেকে আহার করো না যার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়নি এবং নিশ্চয় তা সীমা লঙ্ঘন।’ (সুরা আনআম : আয়াত ১২১)
>> যেসব পশুপ্রাণী ও পাখির শরীরের প্রবাহিত রক্ত নেই। সেগুলো খাওয়াও হারাম। যেমন- তেলাপোকা।
>> দুই ধরণের মৃত প্রাণী ও রক্ত (মাছ ও পঙ্গপাল এবং কলিজা ও প্লীহা) ছাড়া সব মৃত পশুপ্রাণী ও পাখির গোশ্ত এবং প্রবাহিত রক্ত খাওয়া হারাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
‘আমাদের জন্য দুই ধরণের মৃত প্রাণী ও দুই ধরণের রক্ত হালাল করা হয়েছে। মৃত প্রাণী হলো- মাছ ও পঙ্গপাল। আর রক্ত হলো- কলিজা ও প্লীহা।’ (মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ)
>> হালাল প্রাণীর জবাই শুদ্ধ না হলে সে প্রাণীর গোশ্ত খাওয়াও হারাম। আবার জীবিত পশুকে জবাই করা ছাড়া তার গোশ্ত খাওয়াও মৃত প্রাণীর গোশ্ত খাওয়ার মতো হারাম।
>> >> পশু-পাখির মধ্যে যেগুলোর অধিকাংশ খাদ্য নাপাক, যেগুলোর ওপর আরোহন করা, সেগুলোর গোশ্ত ও ডিম খাওয়া এবং দুধ পান করাও হারাম।
উল্লেখ্য যে, কখনো কখনো হারাম পশুপ্রাণী ও পাখির গোশ্তা খাওয়া যাবে-
>> যদি কঠিন খাদ্য সংকট দেখা দেয় এবং কারো কাছে হালাল খাবার মজুদ না থাকে। আর খাবার না খেলে মারা যাবে তবে অনন্তর হারাম গোশ্তের প্রাণী থাকলে তার গোশ্ত খাওয়া যাবে।
তবে এক্ষেত্রে শর্ত হলো-
খাদ্য সংকটের এ অবস্থায় এমন পরিমাণ হারাম খাবার গ্রহণ করা যাবে, যতটুকু খেলে সে জীবিত থাকতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘সুতরাং যে বাধ্য হবে, অবাধ্য বা সীমালঙ্গনকারী না হয়ে, তাহলে তার কোনো পাপ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৭৩)
আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য যেসব পশু-প্রাণী ও পাখির গোশ্তে কল্যাণ ও উপকার রেখেছেন, তাই বান্দার জন্য হালাল করেছেন। তাই পবিত্র, স্বাস্থ্যসম্মত ও উপকারি সবধরনের খাবার গ্রহণে ইসলাম উৎসাহ দিয়েছে। যেসব খাবার অপবিত্র ও অবৈধ তা ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে।
আল্লাহ তআলা মুসলিম উম্মাহকে দুনিয়ার সব হারাম ঘোষিত পশুপ্রাণী ও পাখির গোশ্ত খাওয়া থেকে হেফাজত করুন। হালাল খাওয়ার তাওফিক দান করুন। কুরআন-সুন্নাহর ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।