ইসলামি ইন্স্যুরেন্স : আজকের প্রেক্ষা

আমাদের উচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ
মুসলিম দেশগুলো, বিশেষ করে যারা ইসলামি ইন্স্যুরেন্স চালু করেছেন এবং সফল হয়েছেন, যেমন বাহরাইন, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া ও সুদান, এমনকি লুক্সেমবার্গ, বাহামা ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও তারা কীভাবে বীমার ইসলামিকরণ করেছেন, তা আদ্যোপান্ত গভীর মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করা এবং নিজেদের অর্জিত ইলম-কালামের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া

১. ‘তাকাফুল’ বা ‘ইন্স্যুরেন্স’ বা অনুরূপ কোনো সমিতি বা সমবায় বা সংস্থা বা কয়েকজনের যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে যদি ‘তোমরা পরস্পরকে সৎ ও কল্যাণ কাজে, তাকওয়ার কাজে সহযোগিতা কর।’ (সূরা মায়িদা : ২) -এর আলোকে মুসলমানদের বা সমাজ ও দেশের লোকজনের কল্যাণ বা আংশিক কল্যাণ করা যায়, তা কি না জায়েজ হবে? তাতে কি কোনো সওয়াব পাওয়া যাবে না?
২. পাশ্চাত্যের বা অমুসলিম দেশগুলোর যারাই ‘ইন্স্যুরেন্স’ নামের প্রচলিত সুদি বিনিয়োগ পদ্ধতি বা পারস্পরিক সহযোগিতার নামে জনগণকে, বিশেষ করে মুসলমানদের সুদের মারপ্যাঁচে জড়িয়ে ফেলেছে; সেই মুসলমানদের সজাগ-সতর্ক করার পাশাপাশি বিকল্প হালাল ও বৈধ পন্থা-পদ্ধতি কী হতে পারে, তা দেখিয়ে দেওয়া কি একজন আলেম বা মুফতি হিসেবে, দ্বীনের একজন দাঈ হিসেবে, মুসলমানদের একজন নেতা ও শাসক-রক্ষক হিসেবে সবার দায়িত্ব বর্তায় না? অবশ্যই যার যার শক্তি-সামর্থ্য মোতাবেক দায়িত্ব আছে। বিশেষত বিষয়টি যখন এমন হয় যে, তাতে সাধারণ জনগণ মুসলিম হোক আর অমুসলিম হোক; গড্ডালিকাপ্রবাহে চলতে অভ্যস্ত হয় এবং তাতে তাদের জাগতিক লাভ ও সমৃৃদ্ধির স্বপ্ন জড়িত হয়। ‘সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, আর তোমাদের প্রত্যেককেই নিজ নিজ দায়িত্ব বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে।’ (বোখারি ও মুসলিম)। এসব হাদিস কি এড়িয়ে যাওয়া যাবে?
৩. তা ছাড়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যখন ‘ইন্স্যুরেন্স’ ইত্যাদির মতো কোনো সুদি ব্যবস্থা বা সিস্টেম, কারও ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক চালু হয়ে যায়। আমার দেশ ও জনগণ আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে গিয়ে বা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গিয়ে তাতে না জড়িয়ে উপায় থাকে না, তখন দেশপ্রেমিক ও সমাজ সচেতন একজন নায়েবে-নবী হিসেবে তেমন ‘সুদি ইন্স্যুরেন্স’ এর একটা বিকল্প ‘সুদবিহীন ইন্স্যুরেন্স’ দাঁড় করিয়ে, দেশ ও দেশের জনগণকে সুদ থেকে পরিত্রাণের ব্যবস্থা করা নৈতিক দায়িত্ব নয় কি?
৪. ইন্স্যুরেন্স বা বীমা ব্যবস্থার ‘মূল সেøাগান’ ও প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দ বা কাছাকাছি অর্থের শব্দ দ্বারা যে ভাব-ব্যাখ্যা ও কল্যাণ বোঝানো হয়, সেই কল্যাণ সাধন বা কামনা তো ইসলামি আদর্শ, বোধ-বিশ্বাস ও ধর্মীয় চেতনাবিরোধী নয়। শুধু সমস্যা দাঁড়িয়েছে সুদি ব্যবস্থা, কর্মকৌশল ও সুদের সংশ্লিষ্টতার দরুন। আমরা সেই ব্যবস্থা ও কর্মকৌশল বাদ দিলাম! এবার দেখুন তো বীমা বা ইন্স্যুরেন্সের মূল দাবি ও চাহিদা সম্পূর্ণ ইসলামি আদর্শেরও দাবি ও চাহিদা কি না? (দেখুন : মাওলানা আবদুর রহীম, ইসলামে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও বীমা, পৃ. ৮৬-১২০, সংস্করণ-২০০৫ খ্রি. খায়রুন প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা; প্রাক্তন সিএসপি ও সচিব এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক মহাপরিচালক এজেডএম শামসুল আলম কর্তৃক রচিত ‘ইসলামী ইন্সুরেন্স (তাকাফুল)’, পৃ. ১৬-৬১, মাম্মী প্রকাশনী, প্যারীদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা, সংস্করণ-সেপ্টেম্বর-২০০১ খ্রি. এবং মালয়েশিয়া ইসলামি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অঙ্গসংস্থা ‘ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেইনিং’, কুয়ালালামপুর, সংস্করণ-১৯৯৬, কর্তৃক সংকলিত ‘তাকাফুল’ শীর্ষক পুস্তকখানি)।
আমার ধারণা মতে, অবহিত মহল সেসবকে পুরোনো কথা ও চর্বিত চর্বণ ভাবতে পারেন; তাই সংক্ষেপ করলাম।
৫. এছাড়া যারা শুধু পাশ্চাত্যের সুদি উদ্যোক্তাদের সেই প্রচলিত সুদি বীমা নিয়েই শুধু আলোচনা করে থাকেন এবং সেই আদলে প্রতিষ্ঠিত নিজ দেশের সুদি ইন্স্যুরেন্সের বাইরে আদৌ চিন্তা করেননি; তাদের তেমন প্রয়োজনও পড়েনি। এমনকি তারা বরং নিজ রাষ্ট্রীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের বহুমুখী নির্যাতনের মুখে, সার্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায়, নিজেদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে টিকে থাকার প্রয়োজনে, সেই সুদি ব্যবস্থাকেই নিজেদের স্বধর্মীয় সংখ্যলগু মুসলিমদের নিরাপত্তা বিবেচনায় ‘জায়েজ’ মর্মে ফতোয়া দিয়ে রেখেছেন (দ্র. জাদীদ ফিকহী মাবাহিস : খ-৪, পৃ-১৬৭-৩০৮, সম্পাদনা : মাওলানা মুজাহিদুল ইসলাম কাসেমী, ইদারাতুল কুরআন ওয়াল-উলুমুল ইসলামিয়া, ৪৩৭-ডি, গার্ডেন ইস্ট, করাচী-৫, পাকিস্তান; একইভাবে ভারত থেকে প্রকাশিত ১৯৬৫ খি. থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো বড় বড় ফতোয়া গ্রন্থ রয়েছে, তার সবগুলোতেই প্রায় একই ফতোয়া আলোচিত হয়েছে)।
যেহেতু স্থান-কাল ও পরিস্থিতি অনুযায়ী বিশেষ প্রয়োজনে ফতোয়া পরিবর্তন হতে পারে; সে হিসেবে বৃহত্তর ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের ক্ষেত্রে ওই ফতোয়া সঠিক আছে বা ছিল। তাতে আমাদের দ্বিমতের কিছু নেই। তাদের প্রথম দফার গবেষণা ছিল ‘মজলিসে তাহকিকাতে শরঈয়্যাহ লখনৌ’ এর অধীনে, যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে মোট ১০ জন আলেম ও মুফতি স্বাক্ষর করেছিলেন, যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৫-১৬ ডিসেম্বর, ১৯৬৫ খ্রি. সালে। বিষয় ছিল ভারতীয় মুসলিমদের প্রেক্ষাপটে প্রচলিত ইন্স্যুরেন্সের বৈধতা; ‘ইসলামি ইন্স্যুরেন্স’ বা ইন্স্যুরেন্সের ইসলামিকরণ সম্ভব কি না? তেমন কিছু নয়।
দ্বিতীয় দফার গবেষণা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৯-১২/৮/১৯৯২ খ্রি. মোট চার দিনে এবং তাতে প্রশ্নোত্তরের জবাব আকারে মোট ২২ জন, অভিমত আকারে মোট ২২ জন ও প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মোট ২৪ জন। সর্বমোট ৬৮ জনের লেখা ওই গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে। আর এটি ছিল ‘ইসলামিক ফিকহ একাডেমি, ইন্ডিয়া’ এর চতুর্থ সম্মেলন। এ সম্মেলনের পূর্বে সবার কাছে পাঠানো প্রশ্নাবলিতে এবং প্রথম দিনের স্বাগত ভাষণের উপসংহারে বলা ছিল, ‘উল্লেখ্য, আলোচনা ও গবেষণার বিষয় এটি নয় যে, ইন্স্যুরেন্স বা তাতে অংশগ্রহণ জায়েজ কি না; এই মুহূর্তে বিবেচ্য বিষয় শুধু এটি যে, ইন্স্যুরেন্সকে নাজায়েজ ধরে নিয়ে, ফিকহগত বিবেচনায় বাধ্য হয়ে তাতে জড়িত হওয়ার অনুমতি প্রদান করা যায় কি না?’ অর্থাৎ এতেও ইসলামি ইন্স্যুরেন্সের কোনো প্রসঙ্গ নেই। সুতরাং আমরা বাংলাদেশের আলেম ও মুফতিরা কোন বিবেচনায় তাদের ফতোয়ার কিতাবগুলোর কয়েক লাইন অধ্যয়ন করেই গণহারে ‘ইন্স্যুরেন্স’ বলতেই নাজায়েজ বলে ফেলি বা ফতোয়া দিয়ে বসি? আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম বা ইসলমি দেশ বিবেচনায় আমাদের ফতোয়া হবে ভিন্ন, আমাদের গবেষণা হবে ভিন্ন, আমাদের দায়দায়িত্ব ও কর্মপন্থা হবে ভিন্ন, যেমনটি বিজ্ঞ ওস্তাদ মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী প্রমুখও আলোচ্য বিষয় না হওয়া সত্ত্বেও, ওইসব সেমিনারে মৌখিক ও লিখিতভাবে উল্লেখ করেছেন। (দ্র. পৃ-২১২-৫৯৬)।
আমাদের উচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশগুলো, বিশেষ করে যারা ইসলামি ইন্স্যুরেন্স চালু করেছেন এবং সফল হয়েছেন, যেমন বাহরাইন, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া ও সুদান, এমনকি লুক্সেমবার্গ, বাহামা ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও (এজেডএম শামসুল আলম, ইসলামি ইন্স্যুরেন্স, পৃ-১২), তারা কীভাবে বীমার ইসলামিকরণ করেছেন, তা আদ্যোপান্ত গভীর মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করা এবং নিজেদের অর্জিত ইলম-কালামের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া।

লেখক : মুফতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর