হাওর বার্তা ডেস্কঃ মোটকথা ১৪ খন্ডের সুসমৃদ্ধ এই তাফসির গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে পুরো দ্বীন ইসলামের বিস্তারিত কোষ। হাদিস, ফিকহ, ইলমে আকাইদ ও কালামসহ দর্শন ও বিজ্ঞানের আলোকে রচিত তাফসিরটির এ অনুবাদ হয়েছে পৃথিবীর ৪৫টি ভাষায়। আমাদের বাংলা ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে এর কয়েকটি খন্ড। এ তাফসির পাঠ করে ইসলামের ছায়াতলে এসেছেন এমন নওমুসলিম পশ্চিমা দুনিয়ায় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। সময় যত অগ্রসর হচ্ছে সাইদ নুরসির রিসালায়ে নুরের অনিবার্যতা ততই স্পষ্ট হচ্ছে।
আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শনের আলোকে কোরআন বোঝার অনন্য তাফসির রাসায়েলে নুর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর তুরস্কে ইসলামি জাগরণের মহান পথিকৃৎ বদিউজ্জামান সাইদ নুরসি (রহ.) দীর্ঘ ত্রিশ বছরের সাধনায় অমর এ তাফসির গ্রন্থটি রচনা করেন। তবে এটি অন্যান্য তাফসির গ্রন্থগুলোর মতো ধারাবাহিক আয়াতক্রম অনুসারে লেখা হয়নি। বরং তার সময়ের নানা বস্তুবাদী চিন্তা ও আদর্শ যখন মুসলিম জীবনাচারকে আঘাত করছিল, ইসলামকে ঝেঁটিয়ে সেক্যুলার কামালবাদীরা পশ্চিমা সভ্যতাকে স্বাগত জানাচ্ছিল তখন তিনি সময়ে সময়ে বিজ্ঞান ও দর্শন দিয়ে ইসলামের সর্বজনীনতা ও অপরিহার্যতা তুলে ধরে ব্যতিক্রমধর্মী এ তাফসিরটি রচনা করেন। এটি রচনার পেছনে রয়েছে অবিস্মরণীয় ত্যাগের ইতিহাস। তুরস্কের সেক্যুলার সরকার সর্বক্ষেত্রে ইসলাম ও কোরআনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করব কোরআন নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার মতো কিছু নয়। এটা হলো এক শাশ্বত জীবন ব্যবস্থা। এক অফুরান আলোর উৎস।’
এসব বিবেচনায় রিসালায়ে নুর ছিল বিংশ শতাব্দীর আলোকে মহাগ্রন্থ আল কোরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। সাঈদ নুরসি বিজ্ঞানের সঙ্গে দ্বীনে ইসলামের দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করেছেন। তিনি বুঝিয়েছেন ধর্ম বিজ্ঞানের বিরোধী নয়। তিনি দ্বীন শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতিও জোর দিয়েছেন।
পরম আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, পুরো রিসালায়ে নুর তিনি লিখেছেন নানা শহর-নগরে হিজরত অবস্থায়, জেলে বন্দি অবস্থায়। দীর্ঘ পঁয়ত্রিশটি বছর তিনি সেক্যুলার সরকারের রোষানলে পড়ে জেলবন্দি ও নজরবন্দি হয়ে কাটিয়েছেন। তাফসিরটির রচনা সম্পন্ন হলে তার ছাত্ররা নিজ হাতে এর অসংখ্য কপি তৈরি করে। এমনকি তাফসিরটি আরবি ছাড়াও স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ করা হয়। তারপর ‘নুরস পোস্টাল সিস্টেম’ এর মাধ্যমে পুরো তুরস্কে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তুরস্কজুড়ে রিসালা-ই-নুরের ব্যাপক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে।
রিসালা-ই-নুর গ্রন্থের যুক্তিগুলো জনে জনে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এরই মধ্যে সাইদ নুরসি শুধু একজন আলেম হিসেবেই নন, সংস্কারক হিসেবেও পরিচিত হয়ে ওঠেন। সরকারের নানা চাপের ফলে তার জনপ্রিয়তা আরও বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ১৯৩৫ সালের এপ্রিল মাসে আবারও অসংখ্য ছাত্রসহ তাকে গ্রেফতার করা হয়। একই সঙ্গে রিসালা-ই-নুরকে নিষিদ্ধ করা হয়। এর যত কপি পাওয়া গেছে সবগুলো জব্দ করা হয়। এসবের ফলে সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। সুযোগ পেলেই এর বহিঃপ্রকাশ ঘটত। বদিউজ্জামান নুরসিকে যেখানেই নেওয়া হতো, সেখানেই জনতার ভিড় জমে যেত।
গ্রেফতারকৃত সবার বিরুদ্ধে ফৌজদারি দ-বিধির ১৬৩ ধারা অর্থাৎ সেক্যুলারিজমের মূলনীতি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়। তারপর তাদের কারাগারে বন্দি করা হয়। কারাগারে থাকা অবস্থায়ই তাদের মধ্যে কয়েকজন শরীরিক নির্যাতনে মারাও যান। এত কিছুর পরও সাইদ নুরসির অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।
১৯৪৪ সালের ২২ এপ্রিল রিসালা-ই-নুর খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি গঠন করে তুরস্কের সেক্যুলার সরকার। এ কমিটি আঙ্কারা ফৌজদারি আদালতে সর্বসম্মত রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টে বলা হয়, রিসালা-ই-নুরের বিষয়বস্তুর ৯০ শতাংশই হলো ঈমানের সত্যতা, এর বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা সম্পর্কিত গবেষণামূলক ব্যাখ্যা। এ গ্রন্থটিতে গবেষণা ও ধর্মীয় মূলনীতি থেকে কোনো ধরনের বিচ্যুতি নেই। ধর্মকে স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার এবং কোনো সমিতি বা দল গঠনের অথবা জনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করার মতো আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো আলামত এ গ্রন্থে পাওয়া যায়নি।
সে হিসেবে ১৯৪৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে সব বন্দিকে মুক্তি প্রদান করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় রিসালা-ই-নুরের প্রচার ও প্রসার। তুর্কি জনগণের কাছে গ্রন্থটি নতুন করে আবেদন সৃষ্টি করে। দেশব্যাপী সাধারণ মানুষ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অনেকের ইতিবাচক মনোভাব তৈরিতে রিসালা-ই-নুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
রিসালায়ে নুর কিতাবটি সর্বমোট ১৪ খরেবিভক্ত। সোজলার (শব্দাবলি), মাকতুবাত (চিঠিপত্র), লামাআত (আলোর ঝলক), কালিমাত (কথামালা), শুয়াআত (আলোকরেখা), ইশারেত আল ইজাজ (অলৌকিক নিদর্শন), মোহাকেমাত (চিন্তা বিশ্লেষণ), তারিহচিয়ে হায়াত (জীবন ইতিহাস), আসায়ে মুসা (মুসার লাঠি), মসনবিয়ে নুরি (নুরি মসনবি), খুতবায়ে শামিয়ে (শামির খুতবা), মেভে রিসালেসি (বিশ্বাসের প্রাপ্তি), গেনচলিক রাহবারি (তারুণ্যের পথনির্দেশ) ও ইত্তেহাদ-এ ইসলাম (ইসলামি ঐক্যবোধ)। প্রথম খ- সোজলার লেখা হয়েছে কোরআনের মৌলিক তেত্রিশটি আলোচ্য বিষয় নিয়ে।
মহান আল্লাহর ওপর ঈমানের সুফল, নবী-রাসুলদের ওপর ঈমান, আখেরাতে বিশ্বাস, ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান, তকদিরের প্রতি ঈমান, কোরআনিক দর্শনে পৃথিবীর সৃষ্টিতত্ত্ব, মৃত্যুর পর পুনরুত্থান, মানুষের আত্মার অমরত্ব, পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের তাৎপর্য এ খরে মৌলিক উপাদেয়। রিসালায়ে নুরের এ অংশে আল্লামা সাইদ নুরসি আল্লাহর অস্তিত্ব ও পৃথিবীর সৃষ্টিরহস্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন কোরআনিক দর্শনকে কেন্দ্র করে। সহজ সুন্দর ঘটনার আশ্রয়ে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন কোরআনিক দর্শনের সর্বজনীন উপযোগিতা। প্রতিটি বিষয়কে দলিল-প্রমাণের আলোকে তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞান কোরআনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে যে ভাষায়, তার চেয়ে শক্ত সমৃদ্ধ ভাষায় সেসবের খ-ন তিনি দিয়েছেন।
তিনি দেখিয়েছেন কোরআন কীভাবে অনাগতকাল পর্যন্ত মানবজাতির জীবন সমস্যার সমাধানে অনিবার্য গাইডলাইন। রাসায়েলের দ্বিতীয় খ- ‘মাকতুবাত’ রচনা করেন তার ছাত্রদের নানা প্রশ্নের আলোকে। যেগুলো তারা চিঠি মারফত তার কাছে জানতে চেয়েছিল। এ খ-ে তিনি বিচার দিবস, শিশুদের প্রতি মা-বাবার দায়িত্ব, জান্নাত-জাহান্নাম, নবীজির বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণীর দ্ব্যর্থহীনতা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ‘আসায়ে মুসা’য় তিনি আলোচনা করেছেন প্রচলিত দর্শনের মোকাবেলায় কোরআনি দর্শনের ঐতিহাসিক সত্যতা ও প্রামাণ্যতা নিয়ে। এ অংশের নামকরণ করেছেন ‘আসায়ে মুসা’ তথা মুসার লাঠি হিসেবে। আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শনকে ফেরআউনের জাদুকরদের পর্যায়ে দাঁড় করিয়ে কোরআনকে উপস্থাপন করেছেন মুসার লাঠি হিসেবে। ‘লামাআতে’ আলোচনা করেছেন নবী আইয়ুব (আ.), ইউনুস (আ.)সহ বিভিন্ন নবী-রাসুল ও সম্প্রদায়ের ঘটনা, ঘটনার ওপর কোরআনের শিক্ষা নিয়ে।
মোটকথা ১৪ খরেসুসমৃদ্ধ এই তাফসির গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে পুরো দ্বীন ইসলামের বিস্তারিত কোষ। হাদিস, ফিকহ, ইলমে আকাইদ ও কালামসহ দর্শন ও বিজ্ঞানের আলোকে রচিত তাফসিরটির এ অনুবাদ হয়েছে পৃথিবীর ৪৫টি ভাষায়। আমাদের বাংলা ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে এর কয়েকটি খ-। এ তাফসির পাঠ করে ইসলামের ছায়াতলে এসেছেন এমন নওমুসলিম পশ্চিমা দুনিয়ায় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। সময় যত অগ্রসর হচ্ছে সাইদ নুরসির রিসালায়ে নুরের অনিবার্যতা ততই স্পষ্ট হচ্ছে।