কোরবানির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আল্লাহ তায়ালা বলেন ইবরাহিম! তুমি কোরবানি কর। সকালে উঠে তিনি হৃষ্টচিত্তে ১০০ উট কোরবানি করলেন; কিন্তু পরবর্তী রাতেও তিনি একই নির্দেশ প্রাপ্ত হলেন, আবার তিনি পরের দিন সকালে ১০০ উট কোরবানি করলেন। তৃতীয় রাতে আবার স্বপ্ন দেখলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ইবরাহিম! তুমি কোরবানি কর। তিনি আরজ করলেন, মা’বুদ! আমি কি কোরবানি করব? এরশাদ হলো তোমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় জিনিসটি আমার রাস্তায় উৎসর্গ কর।

মুফতি ইবরাহীম আনোয়ারী ইতিহাস ও জীবনীমূলক গ্রন্থাবলি থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে এমন কোনো জাতি ছিল না যারা তাদের মতাদর্শ অনুসারে কোরবানি করেনি। বর্তমানে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে হজরত আদম (আ.) এর সন্তান হাবিল ও কাবিলের মাঝে তাদের বোন আকলিমার বিবাহ নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে হজরত আদম (আ.) তাদের এখলাসের সঙ্গে কোরবানি করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, তোমাদের মধ্যে যার কোরবানি কবুল হবে তার সঙ্গেই এ মেয়েকে বিবাহ দেওয়া হবে। তখনকার যুগে কোরবানি কবুল হওয়ার আলামত ছিল, যে কোরবানিটি কবুল হতো তাকে আসমান থেকে আগুনের মতো একটি অদৃশ্য বস্তু এসে নিয়ে যেত। অতঃপর হাবিল ও কাবিল আদম (আ.) এর নির্দেশে কোরবানি করল।

হাবিল পশু পালনের কাজ করত সে তার পশুগুলো থেকে বেছে নিয়ে সবচেয়ে সুন্দর একটি ভেড়া আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি করল, আর কাবিল অন্যায়ভাবে বিবাহ করতে চায় ও শরিয়তবিরোধী কাজ করতে চায়। সে কৃষি কাজ করত। সে তার কৃষি পণ্য থেকে কোরবানি দিল এবং সেগুলোকে একটি পাহাড়ের চূড়ায় রেখে আসা হলো। অতঃপর হঠাৎ করে আসমান থেকে একটি অগ্নি প্রবাহ এসে হাবিলের জন্তুকে জ্বালিয়ে দিল, অর্থাৎ তার কোরবানি আল্লাহ কবুল করে নিল। কাবিলের কোরবানি আল্লাহ কবুল করলেন না। সেই ঘটনাকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে কারিমে এরশাদ করেন ‘আপনি তাদের পাঠ করে শুনিয়ে দিন আদমের পুত্রদ্বয়ের ঘটনাকে যথার্থরূপে, যখন তারা উভয়ে নৈকট্য লাভের জন্য কোরবানি দিয়েছিল।’ (সূরা মায়েদা : ২৮)।

অতঃপর তাদের একজনের কোরবানি কবুল হলো এবং অপরের কোরবানি কবুল করা হয়নি। হজরত আদম (আ.) নিজ মেয়েকে বিবাহ দেওয়ার জন্য যে মাপকাঠি নির্ধারণ করেছেন সে মাপকাঠি অনুযায়ী হাবিল তাকে বিয়ে করার জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত হলো, আর কাবিল বিয়ে করতে ব্যর্থ হলো। এতে কাবিলের মাথায় জিদ আরও বৃদ্ধি হয়ে গেল। সে বলল হে হাবিল আমি তোমার কারণে সুন্দরী (আকলিমা) কে বিয়ে করতে ব্যর্থ হলাম এজন্য আমি তোমাকে হত্যা করব। হাবিল ছিল নিরীহ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি শরীরের শক্তি বা দাপট দেখে কোরবানি কবুল করি না। তিনি নিজেই এ ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন ‘আল্লাহ মুত্তাকিনদের কোরবানি ছাড়া কবুল করেন না।’

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে আরও এরশাদ করেন ‘অতঃপর অন্তর তাহাকে স্বীয় ভ্রাতা হত্যার জন্য সম্মত করল এবং কাবিল তাকে হত্যা করল। ভ্রাতা হত্যার কারণে কাবিল ইহকাল ও পরকাল তথা উভয় জাহানে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।’ (কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৪৬)।

পিতা ইব্রাহিম (আ.) এর বয়স যখন ৮৬ বছর তখন বিবি হাজেরার গর্ভে পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করল। তার নাম রাখা হয় ইসমাইল। এই পুত্রকে নিয়ে কিছুদিন পর কঠিন পরীক্ষায় উপনীত হলেন পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)। কোরআনের ভাষায় ‘অতঃপর পুত্রের যখন পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার মতো বয়স হলো তখন তিনি স্বপ্নে দেখলেন এবং ছেলেকে বললেন, হে বৎস আমি স্বপ্ন দেখেছি যে আমি তোমাকে জবেহ করছি। কোনো কোনো রেওয়ায়েত থেকে জানা যায় যে, এই স্বপ্ন হজরত ইবরাহিম (আ.) কে উপর্যুপরি তিন দিন দেখানো হয়, তবে এ কথা সত্য যে, পয়গম্বরের স্বপ্নও ওহি।’

আল্লাহ তায়ালা বলেন ইবরাহিম! তুমি কোরবানি কর। সকালে উঠে তিনি হৃষ্টচিত্তে ১০০ উট কোরবানি করলেন; কিন্তু পরবর্তী রাতেও তিনি একই নির্দেশ প্রাপ্ত হলেন, আবার তিনি পরের দিন সকালে ১০০ উট কোরবানি করলেন। তৃতীয় রাতে আবার স্বপ্ন দেখলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ইবরাহিম! তুমি কোরবানি কর। তিনি আরজ করলেন, মা’বুদ! আমি কি কোরবানি করব? এরশাদ হলো তোমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় জিনিসটি আমার রাস্তায় উৎসর্গ কর। অন্য রেওয়ায়েতে নামসহ বলা হয়েছে, এটি জিলহজ মাসের ১০ তারিখ রাতের কথা। আগামী দিনই হচ্ছে কোরবানির দিন।

সুতরাং তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, আজ আদরের ছেলে ইসমাইলকে কোরবানি দিতে হবে। অতঃপর তিনি কোরবানির সংকল্প হাজেরা (আ.) কে অবহিত করলেন এবং বললেন, তাকে নতুন কাপড়-চোপড় পরিয়ে দাও। বিবি হাজেরা (আ.) তার কলিজার টুকরা পুত্রকে গোসল করিয়ে উত্তম পরিচ্ছেদে আচ্ছাদিত করলেন এবং প্রাণভরে চিরজীবনের মতো বুকে জড়িয়ে আদর-সোহাগ করে বললেন, যাও আমার পুত্র! আল্লাহর জন্য নিজেকে উৎসর্গ কর। সে দিনটি ছিল কোরবানির দিন। যে সময় কিরণ হেজাজের উপত্যকাগুলোতে প্রতিফলিত হয়ে চিকচিক করছে। এমতাবস্থায় ইবরাহিম (আ.) বললেন, ইসমাইল! ছুরি ও রশি নিয়ে জঙ্গলে আস। রান্নাবান্নার জন্য কাঠ কেটে নিয়ে আসি, ইসমাইল (আ.) আব্বার আদেশ পেয়ে দৌড়ে লম্বা রশি ও তীক্ষ ছুরি নিয়ে জঙ্গল অভিমুখে চললেন।

প্রথমেই ইবরাহিম (আ.) ইসমাইলকে স্বপ্নের কথা অবগত করে তার থেকে জবেহের পরামর্শ চাইলেন। বললেন, অতএব তুমি ভেবে দেখ তোমার অভিমত কি? কিন্তু সে পুত্র ছিলেন খলিলুল্লারই পুত্র। ইসমাইল বলে উঠলেন, আল্লাহ আপনাকে যে হুকুম করেছেন, তা পালন করুন। এ মহান কাজে মতামতের কি প্রয়োজন? আব্বাজান! আমার থেকে বড় সৌভাগ্যবান কে আছে যে, আপন পিতার জবেহের মাধ্যমে আমি মহান আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হতে পারব। আর বিলম্ব নয়, এখনই বিসমিল্লাহ বলে আমার গলায় ছুরি চালিয়ে দেন, যাতে ইবলিস আমাদের এই খালেস নিয়তকে নষ্ট করার সুযোগ না পায়। তবে আব্বাজান! ইহজগৎ থেকে চিরবিদায় নেওয়ার পূর্ব মুহূর্তে আপনি আমার এই প্রার্থনাগুলো মনজুর করুন।

১. আপনি ছুরি খুব ধারালো করে নিন। আর আমার হাত-পা শক্ত করে বেঁধে ফেলুন। যেন আমার অনিচ্ছাকৃত লাফালাফিতে আমার রক্তের ছিটা আপনার কাপড়কে নাপাক না করে।

২. আমাকে মাটির দিকে মুখ করিয়ে শুইয়ে দিন, যেন জবেহ করার সময় আমার চেহারা আপনি না দেখেন, যা জবেহ থেকে বাধা দেবে।

৩. আমার রক্ত মিশ্রিত জামা-কাপড় নিয়ে আম্মাজানকে দেবেন। তাহলে আমার আম্মা পুত্রের বিচ্ছেদের যন্ত্রণা লাঘব করতে পারবেন। এক রেওয়ায়েতে আছে, ইসমাইল (আ.) জবেহ করার খবর তার আম্মাকে না দিতে বলেছিলেন। হজরত ইবরাহিম (আ.) স্বীয় সন্তানের মুখে একথা শুনে আনন্দে অধীর হয়ে ওঠেন এবং আদরের সন্তানকে ওই পাথরের কাছে নিয়ে গেলেন, যেখানে হজের মৌসুমে কোরবানির পশুগুলো মিনা নামক স্থানে নিয়ে জবেহ করা হয়। অতঃপর হজরত ইসমাইল (আ.) বললেন, ‘ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।’

হজরত ইবরাাহিম (আ.) ছুরিতে পাথরের শান দিতে লাগলেন। এদিকে ঊর্ধ্ব জগতের ফেরেশতাকুলের মাঝে পড়ে গেল হাহাকার। এমন একটি দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে, যার দ্বিতীয় কোনো উপমা নেই, ছুরি ধার দেওয়া হয়ে গেছে। ইবরাহিম (আ.) কোরবানির জন্তুর মতো নিজের পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন। অদৃশ্য জগতে পড়ে গেল ক্রন্দনের রোল; কিন্তু কারও জানার ক্ষমতা নেই, মহান আল্লাহ কোন উদ্দেশ্যে আপন খলিলের মাধ্যমে এরূপ হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটাচ্ছেন। আল্লাহই তো ভালো জানেন। তিনি বিসমিল্লাহ বলে তীক্ষ ছুরি বের করে নিলেন এবং পুত্রের গলায় ছুরি চালিয়ে দিলেন, আর ওই দিকে আল্লাহর হুকুমে জিবরাইল (আ.) নিজের অজান্তেই চিৎকার করে আল্লাহু আকবর বলে উঠলেন, এ ঘটনাকে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে কারিমের সূরা সাফফাতে উল্লেখ করেছেন ‘যখন তারা আত্মসমর্পণ করলেন এবং পুত্রকে উপুড় করে শোয়ালেন তখন আমি ডাকলাম হে ইবরাহিম! নিশ্চয়ই আপনি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছেন, আমি বিশিষ্ট বান্দাদের এরূপ পুরস্কার প্রদান করে থাকি। প্রকৃতপক্ষে এটা এক বড় পরীক্ষা।’

এ মর্মান্তিক দৃশ্যে ঊর্ধ্ব জগতের ফেরেশতা জগৎ, সুবিশাল মহাশূন্য, ধরণীর নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, পশুপাখি, তরুলতা সবকিছুর মধ্যে প্রকম্পন আরম্ভ হয়েছিল। সৃষ্টি জগৎ রুদ্ধশ্বাসে প্রত্যক্ষ করেছিল আত্মোৎসর্গের এ বিরল ঘটনাটি। ফেরেশতারা প্রার্থনা করেছিল হে প্রভু কেন তুমি এ হুকুম প্রদান করেছ? মহাপ্রতাপশালী আল্লাহ উত্তরে বলেন, আমার কিছু সংখ্যক ফেরেশতা উক্তি করেছিল, হে প্রভু আপনি ইবরাহিম (আ.) কে কেন খলিলরূপে আখ্যায়িত করলেন? আমি বলেছিলাম! তিনি আমার প্রকৃত খলিল এবং আমার জন্য তার বন্ধুত্ব কতটুকু তা পরীক্ষা করে নিলাম। দৃঢ়চিত্তে ইবরাহিম (আ.) সন্তানের গলায় ছুরি চালালেন, এদিকে আল্লাহ তায়ালার রহমতের জোশ এসে গেল। তিনি ছুরিকে লক্ষ্য করে হুকুম করলেন, খবরদার ইসমাইলের একটি পশমও যেন না কাটে।

আল্লাহর হুকুমে ছুরির কাজে পর্দা পড়ে গেল। এতে ইবরাহিম (আ.) রাগান্বিত হয়ে ছুুরি দূরে নিক্ষেপ করলেন। ছুরি একটি পাথরে পড়ে পাথর দুই টুকরা হয়ে গেল। সুবহানাল্লাহ! অতঃপর মহান আল্লাহ জিবরাইল (আ.) কে হুকুম দিলেন, হে জিবরাইল! তুমি বেহেশত থেকে একটি দুম্বা নিয়ে যাও এবং আমার খলিলকে সালাম দিয়ে ইসমাইলের পরিবর্তে এটাকে কোরবানি করতে বল। আমি তার কোরবানি কবুল করেছি। ইসমাইলের গলা কাটা আমার উদ্দেশ্য নয়; বরং তোমাকে পরীক্ষা করা আমার উদ্দেশ্য ছিল। আল্লাহপাক বলেন আমি ইবরাহিমকে যে ফিদিয়া দিয়েছি তা এক শ্রেষ্ঠ কোরবানি। মুফাসসিররা লিখেছেন এটা সেই দুম্বা যা আদম (আ.) এর ছেলে হাবিলের কোরবানির দুম্বা ছিল এবং এটা জান্নাতে সংরক্ষিত ছিল। (তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন)।

লেখক : খতিব, জামিয়া বায়তুল করিম জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর