চাপের কারণে পদত্যাগ করিনি

দলের ভিতর দীর্ঘদিন ধরে কোনঠাসা আর মান-অভিমানে পুরো রাজনীতিকেই গুডবাই জানালেন বিএনপির প্রভাবশালী নেতা শমশের মবিন চৌধুরী। দলের ভাইস চেয়ারম্যান পদধারী এ নেতা গত বুধবার রাতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বরাবর পদত্যাগ পত্র দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবনের ইতি ঘটান। তার এই পদত্যাগ পত্রে শারীরিক অসুস্থতা উল্লেখ করলেও নেপথ্যের কারণ হিসেবে মান অভিমানকেই ইঙ্গিত করেছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
তবে এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার গণমাধ্যকে শমশের মবিন চৌধুরী বলেন, সম্পূর্ণ অসুস্থতার কারণে আমি রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটা আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। রাজনীতি করতে হলে যে ধরণের শ্রম ও সময় দেয়া প্রয়োজন তা শারীরিক কারণে সম্ভব হচ্ছে না। চিঠি দেয়ার প্রসঙ্গে বলেন, বুধবার বাসায় গিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের কাছে চেয়ারপার্সন বরাবরে চিঠি দিয়েছি। তাতেও আমি অসুস্থতার কথা উল্লেখ করেছি।
শমশের মবিন চৌধুরী বলেন, কোনো চাপের কারণে আমি পদত্যাগ করিনি। স্বেচ্ছায় অসুস্থতার কারণে রাজনীতি থেকে অবসরে যাচ্ছি। অন্য কোনো দলে যোগ দেয়ার সম্ভাবনাও নাকচ করে দেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, চিকিৎসার জন্য বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলেও আমার কাছে এমআরপি পাসপোর্ট নেই। যেটা ছিল সেটা গত জুলাই মাসে নবায়নের জন্য জমা দিলেও এখন পর্যন্ত তা হাতে পাইনি। কিন্তু কেন হচ্ছে না তা জানি না। এখন দেশের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা হলেও তা সম্ভব না।
পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করলে কি হবে— জানতে চাইলে শমশের মবিন বলেন, এটা তো সরকারি চাকুরি নয়। রাজনীতিক হচ্ছে করলে স্বেচ্ছায় রাজনীতি করতে পারে আবার স্বেচ্ছায় অবসরেও যেতে পারে। এটা কে কখন গ্রহণ করবে, না করবে এটা বিষয় না। আমি মনে করি পদত্যাগপত্র এই মুহূর্ত থেকে কার্যকর।
বিএনপি চেয়ারপার্সন আরো কিছুদিন রাজনীতিতে থাকার পরামর্শ দিলে কি করবেন— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত।
তবে তার এই বক্তব্যের মাঝেও ফুটে উঠেছে দলের নেতৃত্বে প্রতি তার এক ধরনের অভিমান। বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি কোনো ক্ষোভ রয়েছে কি না এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে বলেন, আমি অনেক দিন ধরে রাজনীতিতে নেই। কাজেই বিএনপির ভেতরে কি হচ্ছে সে বিষয়ে আমি অবহিত নই। ফলে এ ব্যাপারে আমার কোনো বক্তব্য নেই।
এদিকে বিএনপির একটি সূত্র জানায়, বিগত আন্দোলনে তিনি কারাগার থেকে বের হওয়ার পর একটু একটু করে তার মধ্যে বিশেষ করে দলের চেয়ারপার্সনের ওপর ক্ষোভ তৈরি হতে থাকে। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর দলের চেয়ারপার্সন তাঁর কোনো খোঁজ খবরও নেননি। এ ব্যাপারে তার মধ্যে কষ্ট লুকিয়ে ছিল। এই পদত্যাগ তারই বহিঃপ্রকাশ।
এছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। এই সাক্ষাতের সময় দলের চেয়ারপার্সনের ডাকের অপেক্ষায় নিজেকে প্রস্তুত রেখেছিলেন শমশের মবিন। মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চেয়ারপার্সনের কার্যালয় থেকে তার ডাক আসেনি। এ নিয়ে তিনি দলের ঘনিষ্টদের সঙ্গে হতাশার কথা শেয়ারও করেছিলেন।
দলের কাছ থেকে এই অবহেলায় তিনি ক্রমেই হতাশ হয়ে পড়ছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলেন।
শমশের মবিন চৌধুরীর ঘনিষ্ট একটি সূত্র জানায়, তাঁর প্রতি দলের অবহেলাকে তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার প্রতি তার অভিমান ছিল সবচেয়ে বেশি। অভিমানটা এক পর্যায়ে ক্ষোভে পরিণত হয়। সেই ক্ষোভ থেকেই এই পদত্যাগ।
এই পদত্যাগে দলের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে কি না— এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে শমশের মবিন বলেন, বিএনপি একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দল। এখানে অনেক যোগ্য নেতাকর্মী রয়েছেন। তাই দল দলের গতিতেই চলবে।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতে হঠাৎ করে কেন পদত্যাগ— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গণমাধ্যমে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষণ দেখি তাতে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন আছে যে কতটুকু গণতান্ত্রিক অবস্থায় বাংলাদেশ রয়েছে। রাজনীতিতে সার্বিকভাবে অনেক ধরণের ভুল ভ্রান্তি হচ্ছে। এটা দেশের জন্য কাম্য নয়। কারণ দেশের মানুষ সুষ্ঠু রাজনীতি চায়। নির্যাতনও নিপীড়নের রাজনীতি চায় না। মনে রাখতে হবে ১৯৭১ সালে গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের কারণেই কিন্তু চরম ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। সেই চিন্তাকে ধরে রাখতে পারলেই দেশের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আসবে। আমি আশা করবো রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত তারা সকলে সুষ্ঠু ও গঠনমূলক রাজনীতির চর্চা করবেন। তিনি এসময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সকল রাজনৈতিক দলকে এক প্লাটফর্মে এসে দেশের জন্য কাজ করার আহ্বান জানান।
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ২০০১-২০০৫ সাল পর্যন্ত শমশের মবিন চৌধুরী ছিলেন পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্বে। ২০০৮ সালে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে বিএনপিতে যোগ দেন তিনি। সে সময় তিনি চেয়ারপার্সনের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পান। ২০০৯ সালে বিএনপির কাউন্সিল হলে শমশের মবিনকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়। চলতি বছরের শুরুতে বিরোধীজোটের ডাকা টানা অবরোধ-হরতালের মধ্যে নাশকতার মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর তিনি আদালত থেকে জামিন পান।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর