আব্দুল হামিদের পথ ধরেই শিরীন শারমিন, কেমন সামলাচ্ছেন সংসদ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সংসদে নিজের দক্ষতার পাশাপাশি রসবোধের ক্ষেত্রেও আব্দুল হামিদ ছিলেন অনন্য। সফলতার সঙ্গেই দুইবার পালন করেছেন স্পিকারের দায়িত্ব। সংসদ সদস্যদের কাছে এ ‘ভাটির শার্দুল’ সেই সময় রসিক একজন রাজনীতিক হিসেবেও তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন।

নিজের স্বভাবসুলভ কথায় সংসদ সদস্যদের আনন্দ দিয়ে মুহুর্তে মন জয় করে নেওয়ার জাদুকরী ক্ষমতা ছিল তাঁর। আবার প্রয়োজনে শক্ত হাতে পরিস্থিতি সামালও দিতে কঠিন হয়ে উঠতে পারতেন কিংবদন্তি এ রাজনীতিক। কিন্তু জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর নবম সংসদের এ স্পিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ফলে ওই সরকারের মেয়াদের ৮ মাস বাকি থাকতে ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল সংসদের নতুন ‘অভিভাবক’ বেছে নিতে হয়।

সেই সময় রীতিমতো ইতিহাস গড়ে অভিভাবকের এ চেয়ারটিতে বসেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ‘ফ্রেশ ব্লাড’ হিসেবে পরিচিত ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।

মাত্র ৪৬ বছর বয়সে স্পিকার, প্রথম নারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ এ পদে দায়িত্ব পালন এবং সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য থেকেও সংসদ পরিচালনায় শীর্ষ পদে আসীন হওয়ার নজির রেখেছেন খ্যাতিমান এ আইনজীবীই।

ইতোমধ্যেই টানা তিনবার স্পিকারের দায়িত্ব পালন করে নিজেকে অন্য রকম এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচরের এ কন্যা।

সংসদীয় গণতন্ত্রে সব ধরনের আলোচনার ক্ষেত্র ও কেন্দ্রবিন্দু জাতীয় সংসদ হওয়ায় তৃণমূলের পোড় খাওয়া রাজনীতিক থেকে দুইবারের স্পিকার আব্দুল হামিদের স্থলাভিষিক্ত হওয়া স্পিকার শিরীন শারমিন কেমন সামলাচ্ছেন সংসদ? একবাক্যে প্রায় সবাই বলছেন, একজন স্পিকার হিসেবে সংসদ পরিচালনায় তাঁর দৃঢ়তা সবার দৃষ্টি কেড়েছে।

প্রশংসিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে তাঁর দেওয়া রুলিং ও সিদ্ধান্ত। ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে সেখানে দেওয়া বক্তব্য ঘিরেও। বিশেষ করে সংসদ ও বিচার বিভাগের টানাপোড়েনের মধ্যে ড. শিরীন শারমিনের দেওয়া ঐতিহাসিক সেই বক্তব্য সংসদীয় ইতিহাসে আজো মাইলফলক হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে।

প্রতিনিয়তই সংসদ পরিচালনায় নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখা স্পিকার শিরীন শারমিনের অন্যতম বড় পরিচয় তাঁর বাবা রফিক উল্লাহ চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন।

স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সচিবও ছিলেন। তার মা অধ্যাপক নাইয়ার সুলতানা বাংলাদেশ কর্ম কমিশনের সদস্য ছিলেন। তার নানা সিকান্দার আলী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারপতি। আওয়ামী লীগ পরিবার থেকেই উঠে আসা ড. শিরীনের ছাত্রজীবনেও অসাধারণ কৃতিত্ব রয়েছে।

এই নারী যুক্তরাজ্যের এসেক্স ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেন।

‘বাবা ছিলেন বঙ্গবন্ধু’র আর মেয়ে শেখ হাসিনার পরীক্ষিত’ স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী’র বেলায় এ বাক্যটির যেন স্বার্থকতা পাওয়া যায়। ওয়ান ইলেভেনে মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আইনজীবীদের মধ্যে অগ্রভাগে ছিলেন তিনি।

দ্বিতীয় মেয়াদে স্পিকার নির্বাচিত হয়ে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছিলেন, ‘দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোচনার জন্য জাতীয় সংসদ যাতে কার্যকর ক্ষেত্র হতে পারে। সে জন্য কাজ করে যাব।

সংসদে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা হবে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের মতৈক্য হবে।’ এক্ষেত্রেও কথার সঙ্গে কাজের মিল রেখেই পথ চলেছেন তিনি।

বিষয়টি স্পষ্ট করে সরকারী দলের একাধিক সংসদ সদস্য সাংবাদিককে বলেন, স্পিকার হিসেবে পুরোমাত্রায় সফল ড.শিরীন শারমিন চৌধুরী। তাঁর সময়েই সংসদে বঙ্গবন্ধুর খুনি ও যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্তের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা, গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারীদের শাস্তির আওতায় আনাসহ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়।

সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য সাংবাদিককে বলেন, ‘বর্হিবিশ্বে সংসদীয় নেতৃত্বদানেও সাফল্য দেখিয়েছেন স্পিকার। কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এসোসিয়েশন-সিপিএ’র চেয়ারপার্সন পদে তিনিই প্রথমবার নির্বাচিত।

তাঁর হাত ধরেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এতো বড়ো সংগঠনের শীর্ষ পদে বাংলাদেশীদের যাত্রা শুরু হয়েছে। ওই সময়টাতেই কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এসোসিয়েশন’র ৫৩তম সম্মেলন বাংলাদেশে এবং ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সম্মেলনও সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

মাধ্যমিকে ঢাকা বোর্ডে মানবিক বিভাগে সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম স্থান, একই বোর্ড ও বিভাগ থেকে সম্মিলিত মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থান নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক, ১৯৮৯ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি (অনার্স) এবং ১৯৯০ সালে ওই স্থান অটুট রেখেই এলএলএম ডিগ্রি নেওয়ার কৃতিত্ব রয়েছে শিরীন শারমিন চৌধুরী’র।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে একবার নারীর সৌন্দর্য বর্ণনা নিয়ে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি বিতর্কিত মন্তব্য করলে নিখাত যুক্তি দিয়ে তাকে সমুচিত জবাব দেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।

সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘মাননীয় সদস্য ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘বিউটি লাইস ইন দ্যা আইস অব দ্যা বিহোল্ডার।’

অর্থাৎ যে কোনও কিছুর সৌন্দর্য যিনি দেখছেন তার দৃষ্টির ওপর নির্ভর করে। একজন নারী তিনি তার মনের দিক থেকে সুন্দর। একজন নারী একজন মা। তার মনের কোমলতা, তার ব্যক্তিত্বের কোমলতা তার সৌন্দর্য।

কী ধরনের সাজসজ্জায় তিনি আছেন সেটার মধ্যে তার সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটে না, ঘটে তার ব্যক্তিত্বে, তার মায়ের কোমলতায়, তার সৌন্দর্যে।’ ওই সময় সরকার দলীয় অন্য সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়ে স্পিকারকে সমর্থন জানান।

সংসদ পরিচালনায় স্পিকার ড.শিরীন শারমিন চৌধুরীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতা ও সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ সাংবাদিককে বলেন, ‘মেধাবী, ভদ্র, বিনয়ী ও সজ্জন স্পিকার দক্ষ হাতেই সংসদ সামলাচ্ছেন।

তিনি সংসদকে যেমন আলোকিত করেছেন তেমনি বিশ্ব পরিমন্ডলেও উপস্থাপন করেছেন। সংসদকে আরো বেশি কার্যকর ও গতিশীল করতে তিনি অতুলনীয়।’

কিশোরগঞ্জ-৪ (মিঠামইন-ইটনা-অষ্টগ্রাম) আসন থেকে টানা তিনবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক সাংবাদিককে বলেন, ‘দক্ষতার সঙ্গে সংসদ পরিচালনায় সিদ্ধহস্ত স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধুর পরীক্ষিত সৈনিক ছিলেন।

তিনিও বঙ্গবন্ধু কন্যার বিশ্বস্ত। অতীতের মতোই একাদশ জাতীয় সংসদকেও অধিক কার্যকর ও আরো এগিয়ে নিতে স্পিকার সক্ষম হবেন বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’

স্পিকার পদে দায়িত্ব পালনের আগে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি রংপুর-৬ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

জনস্বার্থ, মানবাধিকার ও সংবিধান বিষয়ক বিভিন্ন মামলা পরিচালনা করা এ স্পিকার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী।

কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে ২০০০ সালে যুক্তরাজ্যের এসেক্স ইউনিভার্সিটি থেকে ‘রাইট টু লাইফ’ অর্থাৎ, মানুষের জীবনের অধিকার, মানবাধিকার ও সাংবিধানিক আইন বিষয়ে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর