হাওর বার্তা ডেস্কঃ খাদ্য ও খাদকের এ জগতে কৃষক শুধুই উৎপাদক নয়, নিজেও একধরনের খাদ্য। কৃষকের শ্রম খেয়ে জমিদার মোটা হয়েছে, রাজারা মহারাজ হয়েছে। অথচ যে লোকটি সবার খাদ্য জোগায়, সে-ই থাকে খাদ্যশৃঙ্খলের সবার নিচে। কৃষককে সবাই খায়, শোষণ করে, কিন্তু কৃষক কাউকে শোষণ করতে পারে না। কারণ, তার তলায় ঠকানোর মতো কোনো শ্রেণি নেই।
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়া গ্রামীণ অর্থনীতি
উন্নয়নের মহাসড়ক দিয়ে যেতে যেতে আমরা দেখি, রোদ-বৃষ্টিতে জমিতে উবু হয়ে কাজ করে যাচ্ছে একটি-দুটি বা কয়েকজন লোক। তাদের ইবাদত ও প্রার্থনাও ওই মাটিঘেঁষা। এই মাটির পোকারাও কখনো মাথা তোলে: আকালে, বন্যায়, মড়কে বা বিদ্রোহের সময়। গলায় ফাঁস নিলেও তাদের মাথাটা আকাশপানেই তোলা থাকে। বাদবাকি সময় তাকে শুষে খায় জমির মালিক, সারের ডিলার, সেচকলের মালিক, কীটনাশক কোম্পানি, ব্যাংকের কিস্তি, বিদ্যুতের বিল। তবে আখেরি মারটা চালকল মালিকের। ফড়িয়ার কাছে কম দামে ধান বেচতে বাধ্য করে তারা। এবারও যখন সরকার ধান কিনছে না তেমন, ধানের দাম আরও নামাতে বেশির ভাগ ধানকলও বন্ধ রাখা হয়েছে, তখন পত্রিকায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়া মানুষের যেসব ছবি ছাপা হয়, তা কেবল কৃষকের নয়, তার ক্যাপশনের নাম গ্রামীণ অর্থনীতি। শহরকেন্দ্রিক অর্থনীতি গ্রাম থেকে শুধু নেয়, ফেরত দেয় কম।
গ্রামে টাকা পাঠায় কেবল গ্রামেরই ছেলেমেয়েরা, যারা নাকি শহরে মজদুরি খাটে। ভোগে জন্ডিসে, অপুষ্টিতে এবং নিয়মিতভাবে গণমৃত্যুর শিকার হয় নতুন নতুন রানা বা তাজরীনে। কৃষকের যা অভাব, তা হলো পুঁজি। এটারও জোগানদার আরব অঞ্চলে যৌবন নিঃশেষিত করে চাকরি করা যুবক-যুবতীরা। কৃষিকাজে কাঁচা টাকার খোঁজে বেরিয়ে তারা মরে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ার জঙ্গল কিংবা ইতালির সমুদ্রে। কৃষকের মতো কৃষকের সন্তানেরও যৌবনের সেরা সময়টা খরচ হয় হাড়ভাঙা খাটনিতে, শরীর ভেঙে যায়, আয়ু কমে যায়। নিশিদিন সুখহীন প্রাণীর জীবন থেকে বেরোতে চায় বলেই এদের সন্তানেরা চাকরিতে বৈষম্যের বিরুদ্ধে জানপ্রাণ দিয়ে লড়ে। কারণ, তারা জানে, গ্রামে তাদের জন্য কিছু নেই। পড়ালেখাটাও তারা জানপ্রাণ দিয়েই করে, যাতে বাপ-চাচার মতো, মা-খালার মতো খাদ্যশৃঙ্খলের একেবারে তলায় পড়ে থাকতে না হয়।
বহুমুখী হুমকির সামনে একাকী কৃষক
মার খায়নি কৃষক? বর্গি-হার্মাদদের হাতে, ব্রাহ্মণ্যপ্রথার হাতে, আশরাফতন্ত্রের হাতে, ইংরেজ ও তার দেশীয় জমিদারদের হাতে, পাকিস্তানিদের হাতে আর এখন লুটেরা বণিকতন্ত্র তাদের শুষে যাচ্ছে। কৃষকের সংসারে পাতা সবচেয়ে বড় জাল আধুনিক পুঁজিবাদের। এই পুঁজিবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতি বড় ব্যবসায়ী, ব্যাংক, সার-কীটনাশক-বীজ কোম্পানির জিম্মি হলো কৃষি। এর উন্নয়ন যদি ২০ জনের চাকরি দেয়, তো বেকার ও দরিদ্র করে ৮০ জনকে। বাংলাদেশের একজন সাধারণ কৃষককে প্রতিযোগিতা করতে হয় ভারত-চীনসহ বিশ্বের মেগাফার্মের সঙ্গে। রাষ্ট্র আর দেশীয় কৃষিকে সুরক্ষা দেবে না, ভর্তুকি কমাবে, যাও-বা দেবে তা খেয়ে নেবে দুর্বৃত্তরা। ১৯৪০-এর আগে প্রযুক্তিনির্ভর পুঁজিবাদী কৃষির সঙ্গে সাবেকি কৃষকের ফলনের অনুপাত ছিল ১০: ১। এখন হয়েছে ২০০০: ১। মুক্তবাণিজ্যের নামে বহুজাতিক কোম্পানিরা অবাধে আমাদের কৃষকের বাজার খেয়ে ফেলতে পারে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নিয়মের বলি তৃতীয় দুনিয়ার ৩০০ কোটি কৃষকের ভবিষ্যৎ। এরা যেন মানব উচ্ছিষ্ট, এদের ছাড়াই পদ্মা সেতা, মেট্রোরেল, স্যাটেলাইট সব চলতে পারে।
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়েছে সর্বগ্রাসী লুটপাট। ২০১৭ সালে হাওরের ধান নষ্ট হওয়ার ঘটনাকে তারা টাকা পাচারের মওকা বানায়। সরকারকে দিয়ে চাল আমদানির ওপর শুল্ক কমিয়ে ১০ লাখ টন ঘাটতি দেখিয়ে আমদানি করা হয় ৬০ লাখ টন চাল। বিদেশি চালের ঢলে বাজারে চালের দাম কমার কথা, কিন্তু কমে ধানের দাম। অর্থাৎ দুর্যোগ মোকাবিলাকে বহুমুখী সুযোগ করে তুলে কৃষককে আরও দুর্যোগে ফেলা হয়। পাশাপাশি আমদানির নামে বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার হয়। ৫০০ ডলার টনের চালের দাম দেখানো হয় ৮০০ কিংবা ১০০০ ডলার। এখন আবার তখনকার আমদানি চালকে বাড়তি দেখিয়ে ওঠানো হচ্ছে চাল রপ্তানির হুজুগ। কারও কারও আশঙ্কা, রপ্তানি আয়ের নামে বিদেশ থেকে যে টাকা ঢুকবে, তা আসলে আগে পাচার হওয়ার টাকারই অংশ। এখানে প্রশাসন ও ব্যবসা যেন ডান হাতের সঙ্গে বাঁ হাতের কারবার।
কৃষককে শুষে ও তুচ্ছ করেই আমরা ‘ভদ্রলোক’
এমন সময় কৃষকেরা জমিতে আগুন দেয়, সড়কে ঢালে ভ্যানভর্তি সবজি। কেউ কেউ আত্মহত্যা করে। আকাশ আর মাটির মাঝখানে লম্বালম্বি ঝুলে থাকা কৃষকের প্রাণহীন দেহকে তখন মনে হয় এক বিস্ময়চিহ্ন! সত্যিই কৃষক এক বিস্ময়! খাদ্যশৃঙ্খলের তলার এই মানুষটি বিত্ত-মর্যাদা ও ক্ষমতার পিরামিডেরও একেবারে তলার লোক। সবচেয়ে সৎ জীবনযাপনের পরও ‘চাষা’ হয়েছে গালির সর্বনাম। কৃষকের চলনবলন থেকে যে যত দূরে, সে নাকি ততটাই ‘ভদ্রলোক’। উনিশ শতকে কৃষকের শত্রু ইংরেজ আর জমিদার ও বাবুদের এই ষড়যন্ত্রকেই আমরা বলছি আধুনিকতা। কৃষকের দুর্ভাগ্যের ইতিহাসে ভদ্রলোকেরা সর্বদা উকিল-দারোগা-ডাক্তার-নায়েব বা নেতা হিসেবে কৃষকের বিপক্ষেই ছিল। কৃষকবিদ্বেষ তাই এই ভদ্রলোক সংস্কৃতির মজ্জারস।
ফসল ফলানোর অপরাধে কৃষককে তাই মাফ চাইতে হয় সন্তানের কাছে, ‘বাবা/মা, তোমাদের খরচ আর চালাইতে পারিতেছি না, ঈদেও তেমন কিছুই দিতে পারিব না।’ কিংবা প্রবাসী পুত্রকে ভাইবারে জানাতে হবে, ‘ধানের দাম পাই নাই, তুমি বেশি টাকা পাঠাইও।’ কুড়িগ্রামের রাজাপুরের আনিসুর এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার খবর সম্বল করে ঢাকায় এসেছে। বাবা চালাচ্ছেন রিকশা, আর ছেলেটি মালিবাগে ইট বইছে। এ রকম সময়েই দলে দলে কৃষকদুহিতা পোশাকশিল্পের দরজায় এবং কেউ কেই পাকেচক্রে গিয়ে দাঁড়াবে যৌনপল্লির রাস্তায়। এই রূপান্তরের কার্যকারণ ও ইতিহাসের কিছুই না বুঝে এরা ভুগতে থাকবে, হাতে হাতে চালাচালি হবে। দুঃখী মুখ আর সারল্যের কারণে তারা গালি শুনবে ‘রোহিঙ্গা’। এ রকম সময়েই তাদের বাপ-চাচারা একে একে মাফ চাইবে ব্যাংকের ম্যানেজার আর সার-বীজ-কীটনাশক-পানি-বিদ্যুৎ আর চালকলের মহাজনের কাছে। যেন তারা বাকিতে জমি-বীজ-সার-কীটনাশক ইত্যাদি দেয়, যেন সুদটা মওকুফ করে। এ রকম সময়েই মন্ত্রীদের নিষ্ঠুর বাণী শুনে তারা সেই একই ক্ষমাপ্রার্থী করজোড় ভঙ্গিতে ওপরের মালিকের কাছে ফরিয়াদ জানাবে।
ধানের দাম পায়নি বলে জমিতে আগুন লাগিয়েও মুক্তি নেই কৃষকের। পুলিশ শোঁকে ষড়যন্ত্রের গন্ধ। ‘সরকারের পক্ষে ধানের দাম বাড়ানো সম্ভব বলে কৃষিমন্ত্রী সরাসরি চাল ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া সুযোগ করে দেন। খাদ্যমন্ত্রী আরেক কাঠি নির্দয়। প্রকৃত কৃষক খুঁজে পাওয়া সম্ভব না বলে নাকি তাদের সহায়তার সুযোগ নেই। এমন বক্তব্য কাকে উৎসাহিত করে? এসব দেখে কৃষকেরা যদি বিদ্রোহ করে, তবে তারা বলবে সন্ত্রাসী, আর আত্মহত্যা করলে বলবে ‘পাগল’।
‘ক্ষমা করিও আদিপিতা!’
সত্যিই, পাগল না হলে কেউ বছরের বছর লোকসানি দিয়েও কৃষিকাজ করে? এরকম দিনে খাওয়ার সময় কি কারো মনে হবে, প্রতি লোকমা ভাতে বঞ্চিত করছি কৃষককে? ভাত গিলবার আগে কি মনে মনে বলে নেব, ‘ক্ষমা করিও আদিপিতা!’ তোমার বিপদে তুমি ছাড়া আর সবারই কমবেশি লাভ।
পুঁজিবাদের আগের সব সমাজই ছিল কৃষিসমাজ। কৃষির মধ্য দিয়ে মাটি ও শ্রমের মিলনে যে সৃষ্টিকাজ চলে, তার নেশা এখনো এই প্রাগৈতিহাসিক শ্রেণিটিকে পাগল করে। কৃষি তাদের কাছে মুনাফা না, কৃষি তাদের জীবনধর্ম। বাজার অর্থনীতি আর লুটপাটতন্ত্র বুঝতে অক্ষম, কেন কৃষক লোকসান দিয়েও ফসল ফলায়? কৃষকেরাও বুঝতে পারে না কেন তারা বারবার ঠকে? কিন্তু বেনিয়ার না-বোঝা তাকে আরও লাভের দিকে চালিত করে আর কৃষকের না-বোঝা তাকে করে তোলে বণিকতন্ত্রের মোক্ষম শিকার।
আমি-আপনি দর্শক নই। যদি ভাত খেয়ে থাকি কৃষকের, তাহলে অবশ্যই জাতির প্রতিপালকের প্রতি আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। মুনাফা ও শ্রমের মাঝখানে রাষ্ট্র ও সরকারকে ফসলি স্বার্থের জিম্মাদার করাতে অনেক চাপ দরকার। ধানখেতে আগুন দেওয়ার ঘটনা থেকে যে মধ্যবিত্তীয় আবেগ জেগেছে, তার তার কণাভাগও যদি নীতিনির্ধারকেরা পালন করেন, তো কৃষক বেঁচে যায়। কিন্তু যেখানে বিপুল মুদ্রার হাতছানি, সেখানে বণিকেরা না শোনে ধর্মের কাহিনি।
ধানক্ষেতে ছাত্ররা: মুক্তিযুদ্ধের দিশা
তবে ছাত্ররা শুনেছে কৃষকের আর্তি। অনেকেই মাঠে মাঠে স্বেচ্ছাশ্রমে ধানকাটতে নেমে গেছে। সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা ডাকসুর ভিপি নুরুল হক কৃষকের স্বার্থে লংমার্চ করবার হুমকি দিয়েছেন। ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন বলেন, ‘আমি ছাত্র, আমি কৃষক পরিবারের সন্তান। এক মণ ধানের দাম ৪৫০-৫০০ টাকা। এই ধান থেকে চাল হয় ১ হাজার ২০০ টাকার। ৭০০ টাকা তারা খেয়ে ফেলছে। সিন্ডিকেট এই টাকা মেরে দিচ্ছে। কৃষকের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার দায় রাষ্ট্রের।’ কৃষকের সন্তানেরাই কিন্তু ৫২–৭১ করেছিল। আজকের এই ছাত্রতরুণেরা যেভাবে দাঁতে দাঁত চিপে লড়ে যাচ্ছে আর টিকে থাকছে, তা মনে করায় কৃষকের অদম্য জেদের কথা।
ছাত্রদের ধান কাটার দৃশ্যটার মধ্যে অন্য ইশারাও দেখা যায়। শেষ কবে ছাত্ররা আর কৃষকেরা জমিতে একসঙ্গে নেমেছিল? ঠিক ধরেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়। ছাত্র মুক্তিযোদ্ধার স্টেনগান আর কৃষকের লাঙল তখন একজোট হয়েছিল বলে দেশটা স্বাধীন হয়েছিল। কথাটা মনে রাখা দরকার।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক, প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।