হাওর বার্তা ডেস্কঃ পাকুন্দিয়া উপজেলার হোসেন্দী ইউনিয়নের ছোট্ট গ্রাম মঙ্গলবাড়িয়া। এ গ্রামের এমন কোন কৃষকের বাড়ি নেই যেখানে অত্যন্ত ৪/৫টি লিচু গাছ নেই। লিচুর চাষ করে এখানকার চাষীদের আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে, মুক্তি পেয়েছে দারিদ্রতা থেকে। উন্নত জাতের লিচুর জন্য বিখ্যাত কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে চলতি মৌসুমে লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। মৌসুমের শুরুতেই প্রতিকূল আবহাওয়া এবং নিবিড় পরিচর্যার কারণে লিচুর ফলন হয়েছে আশাতীত। তার উপর প্রতিশত লিচুর দাম উঠছে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা। চাষীদের মতে প্রতিটি গাছে ১০ থেকে ১২ হাজার লিচু উৎপন্ন হয়ে থাকে এবং একেক মৌসুমে মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে প্রায় তিন কোটি টাকার মত লিচু বিক্রি হয়ে থাকে।
স্থানীয় অধিবাসী জানান, মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে দুইশত বছর ধরে লিচু চাষ হয়ে আসছে। টক্ টকে লাল রং, বড় আকৃতি ও ছোট বীচি সেই সাথে মিষ্টি স্বাদ- এই হচ্ছে মঙ্গলবাড়িয়া লিচুর বৈশিষ্ট্য। এ সমস্ত গুণের কারণেই এখানকার লিচু ইতিমধ্যে দেশে সুনাম কুড়িয়েছে। লিচুর ভরা মৌসুমকে সামনে রেখে ধীরে ধীরে পাকতে শুরু করেছে মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু। বাড়ি-ঘরের আঙিনা এবং রাস্তার দু’পাশে অবস্থিত গাছগুলো ছেয়ে গেছে লাল বর্ণের লিচুতে। চারিদিকে রাঙ্গা লালের সমারোহ মুগ্ধ করছে যে কোন মানুষকে। ইতিমধ্যেই গাছগুলো বিক্রি হয়ে গেছে দুর দুরান্ত থেকে আগত পাইকারদের কাছে। এখন চলছে লিচু আহরণের কাজ। পাইকারদের হাত ঘুরে এখানকার লিচু রসনা তৃপ্তি ঘটাবে ভোজন রসিকদের।
সারা দেশের এখানকার লিচুর চাহিদার কথা উল্লেখ করে মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু ক্রয়ের জন্য আগত একজন ব্যবসায়ী তৌহিদ মিয়া বলেন, আমি একজন লিচু ব্যবসায়ী। এ বছর মুকুল থাকাবস্থায় ১১৬টি লিচু গাছ কিনেছি। ভালো ফলন হওয়াতে লিচু বিক্রি করে প্রায় চার থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা লাভ হবে। এখান থেকে লিচু কিনে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ সারাদেশে বিক্রি করি। এখানকার লিচুর সারা দেশেই খুব চাহিদা।
মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর উন্নত গুণাগুণ বর্ণনা করে স্থানীয় গ্রামবাসী মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে দুইশত বছর ধরে লিচুর চাষ হয়ে আসছে। আমাদের গ্রামের প্রত্যেক ঘরে ঘরে লিচুর বাগান আছে। এখানকার লিচু আকৃতিতেও বড় এবং খেতেও মজা। সারা বাংলাদেশে এই লিচু সরবরাহ হয়।
লিচু বিক্রি করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বি হওয়ার কথা উল্লেখ করে মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের বিশিষ্ট লিচু চাষী মোখলেছুর রহমান দাদা ভাই বলেন, আমার বাগানে ৩০/৩২টি লিচু গাছ আছে। এই লিচু বিক্রি করে অনেক টাকা লাভ করি। এই পয়সায় সংসারের খরচ চালিয়েও অনেক উদ্ধৃত্ত থাকে। এই টাকায় আমার আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। আমার গ্রামের অনেকেই লিচু বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বি হয়েছেন। তিনি আরো বলেন, প্রতি বছর আমেরিকা, জার্মান, অষ্ট্রেলিয়া ও সৌদি আরব থেকে প্রবাসী বাংলাদেশীরা তাদের আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে মঙ্গলবাড়িয়া থেকে লিচু বিদেশে নিয়ে থাকে।
পাকুন্দিয়ার হোসেন্দী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান হামদু বলেন, মঙ্গলবাড়িয়ায় লিচু চাষের ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কোন উদ্যোগ নেই। যদি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সঠিকভাবে চাষীদের পরামর্শ ও তদারকি করতেন এবং লিচু চাষীদের ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করে দিতেন তাহলে এ লিচুর ফলন আরো ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধি পেত।
লিচুর উৎপত্তি: পাকুন্দিয়া মঙ্গলবাড়ীয়া লিচুর উৎপত্তিস্থল বিষয়ে সঠিক তথ্য জানা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে ভারতীয় কোন এলাকা থেকে প্রজাতিটি এখানে এসেছে। স্থানীয় লোকজন বলেছেন দীর্ঘদিন পূর্বে মঙ্গলবাড়ীয়া গ্রামে হাসিম মুন্সী নামে এক ব্যক্তি পাহাড়ী এলাকা থেকে একটি লিচুর চারা এনে বাড়ীর আঙ্গীনায় রোপন করেন। সেখান থেকে বাছির উদ্দিন নামে অন্য আরেক গ্রামবাসী কলম করে তার বাড়ির আঙ্গীনায় রোপন করেন। এভাবেই মঙ্গলবাড়ীয়া লিচুর প্রসার ঘটে।
সব গ্রামই মঙ্গলবাড়ীয়া: মজার ব্যাপারে হচ্ছে মঙ্গলবাড়ীয়া ছাড়াও পাকুন্দিয়া প্রায় সবকটি ইউনিয়নে রয়েছে হাজার হাজার লিচু গাছ। হোসেন্দী ইউনিয়নেই সবচেয়ে বেশি। পাকুন্দিয়া উপজেলা যেখানেই লিচু হউক না কেন এর নাম অবশ্যই মঙ্গলবাড়ীয়া লিচু।
প্রয়োজনীয় সরকারী ও বেসরকারী সহায়তা প্রদান করা হলে একদিকে যেমন এখানকার উৎপাদিত লিচুর আবাদ আরও সম্প্রসারণ করা সম্ভব সেই সাথে বিপণনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলে পাল্টে যেতে পারে স্থানীয় অর্থনীতির চিত্র।