খালেদ-শামীমের পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী কানেকশন

হাওর বার্তাঃ যুবলীগের সদ্য বহিষ্কৃৃত নেতা খালেদ মাহমুদ ভূইয়া ও যুবলীগ নেতা গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জিকে শামীম ওরফে টেন্ডার শামীমের সঙ্গে আন্ডারওয়ার্ল্ডের যোগাযোগ বহুদিনের। এক সময়ের ঢাকার অপরাধ জগতের আতঙ্ক দুবাই পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও পার্শ্ববর্তী দেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিকের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ও তাদের সাহায্য নিয়ে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির কথা স্বীকার করেছেন পুলিশি রিমান্ডে থাকা আলোচিত নেতা খালেদ ও শামীম। নিজেদের কর্তৃত্ব রক্ষায় পুলিশের সিনিয়র অফিসার ও রাজনৈতিক নেতাদের বড় মাপের অনৈতিক সুবিধা দিতেন বলে স্বীকার করেন দুই নেতা। এ ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদে ক্যাসিনো গুরু মূলত ইসমাইল হোসেন সম্রাট বলে জানিয়েছেন খালেদ। এছাড়া সংশ্লিষ্ট ৩০ জনের তালিকা গোয়েন্দাদের হাতে রয়েছে বলে জানা গেছে। পৃথকভাবে এই দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) শীর্ষ কর্মকর্তারা।

জিজ্ঞাসাবাদে তারা প্রকাশ করেছেন সহযোগী সন্ত্রাসীদের নাম। এ ছাড়া কিভাবে তারা বছরের পর বছর ধরে টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি করেছেন, সেই টাকার কমিশন পুলিশসহ প্রশাসন ও দলের সিনিয়র নেতাসহ কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দিতেন, কারা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন-রিমান্ডে এমন বিস্ফোরক তথ্য দিচ্ছেন খালেদ ও শামীম। কিছু তথ্য শুনে বিস্মিত হয়েছেন জেরাকারী সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তারা। তবে কমিশন ও টাকার ভাগ-বাটোয়ারা প্রাপ্ত ব্যক্তি ও পৃষ্ঠপোষকদের বিষয়ে গ্রেফতারকৃতদের দেয়া তথ্যের সত্যতা যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ডিবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।

অবৈধ ক্যাসিনো চালানো দায় যুবলীগ দক্ষিণের সাগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া ও অস্ত্রবাজি এবং টেন্ডারবাজির অভিযোগে যুবলীগ দক্ষিণের সমবায় বিষয়ক সম্পাদক দাবিদার জি কে শামীমকে সম্প্রতি গুলশান থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। পৃথক অভিযানে তাদের গ্রেফতারের পর গুলশান থানায় তাদের নামে একাধিক মামলা হয়। ওই মামলাগুলো ডিবিতে হস্তান্তর করার কারণে দুই আসামিকেই ডিবি কার্যালয়ে পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট ডিবি কর্মকর্তারা জানান, দল পাল্টিয়ে রাতারাতি যুবলীগ নেতা হয়ে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন খালেদ ও শামীম। খালেদ এলাকায় চাঁদাবাজি ও আধিপত্য ধরে রাখত এবং শামীম টেন্ডার জগতের মাফিয়া ডন হতে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করার কথা স্বীকার করেছেন। এক সময় দুজনই টাকার ভাগ নিয়মিত পৌঁছে যেত জিসানের কাছে। ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডে’ খালেদের অবস্থান প্রমাণে সিঙ্গাপুরের অভিজাত হোটেল মেরিনা বের সুইমিংপুলে জিসান ও খালেদের সাঁতার কাটার ছবির পোস্টারও দেখা গেছে। তবে কমিশন নিয়ে বিরোধের কারণে একপর্যায়ে খালেদের সঙ্গে দুবাই পলাতক জিসানের বিরোধ দেখা দেয়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবি কর্মকর্তারা জানান, খালেদের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত অন্তত ৩০ জনের নাম পেয়েছে ডিবি। এরই মধ্য তারা গা-ঢাকা দিয়েছেন। চাঁদাবাজি ও ক্যাসিনো কারবারে খালেদের সাঙ্গোপাঙ্গদের মধ্যে অন্তত ৩০ জন ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এদের মধ্যে রয়েছেন গোড়ান এলাকার কাউন্সিলর আনিসুর রহমান, যুবলীগ দক্ষিণের সদস্য খায়রুল, উজ্জ্বল রাজু, রইসসহ অনেকে। এই গ্রুপের সদস্যদের কাছে ততোধিক অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। এমনকি অত্যাধুনিক একে-২২ রাইফেলও আনা হয়েছিল, তার কিছু দিন আগে উদ্ধার করে ডিবি। উক্ত সহযোগীরা খালেদকে মতিঝিলের শাহজাহানপুর, কমলাপুর ও খিলগাঁও এলাকায় চাঁদাবাজির পাশাপাশি টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা করতেন। এদের গ্রেফতারে চেষ্টা চালাচ্ছে ডিবি।

জেরার মুখে খালেদ দাবি করেছেন, ঢাকার মহানগর পুলিশের মতিঝিল, রমনা, গুলশান ও উত্তরা বিভাগের কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা ও অনেকগুলো থানার ওসিদের নিয়মিত মাসোয়ারা দিতেন। ঘটনার সত্যতা যাচাই করে ওই সব পুলিশ কর্মকর্তাদের ব্যাপারেও খোঁজ নিচ্ছেন গোয়েন্দারা।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ মাহমুদ স্বীকার করেছেন ঢাকার ক্যাসিনো ব্যবসার জগতের মূল হোতা যুবলীগের শীর্ষ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। এই সম্রাটই তার গুরু। এর ওপরেও সিনিয়র কয়েক নেতা রয়েছেন। সূত্র জানায়, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছার ও যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর একেএম মোমিনুল হক সাঈদও ঢাকার ক্যাসিনো জগতের অন্যতম হোতা। এ জাতীয় কয়েকজন নেতা দেশ ত্যাগের চেষ্টা করছেন।

খালেদ পুলিশকে আরো জানিয়েছেন, রাজধানীর মতিঝিল, ফকিরাপুল এলাকায় কমপক্ষে ১৭টি ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। এর মধ্যে ১৬টি ক্লাব নিজের লোকজন দিয়ে আর ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবটি সরাসরি তিনি পরিচালনা করতেন। বাকিগুলো সম্রাটের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

অপরদিকে গ্রেফতারকৃত যুবলীগ নেতা জিকে শামীমও আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশনের কথা স্বীকার করেছেন বলে জানা গেছে। টাকা কুমির হওয়ার গলপ শুনিয়েছেন ডিবি ও র‌্যাব কর্মকর্তাদের। তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবি কর্মকর্তাদের কাছে শামীম স্বীকার করেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীনই সে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। বিএনপি ক্ষমতাচ্যুত হলে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আধিপত্য ধরে রাখতে ভোল পাল্টিয়ে যুবলীগ নেতা পরিচয় দিতে থাকেন। টেন্টারবাজির রাজত্ব ধরে রাখতে তিনি বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানেরও সাহায্য নিয়েছিলেন।

জিজ্ঞাসাবাদে শামীম দাবি করেছেন, কাজ পেতে তিনি গণপূর্ত অধিদফতরের সদ্য সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামকে সম্প্রতি ঘুষ হিসেবে দিয়েছেন এক হাজার ১০০ কোটি টাকা। গণপূর্তের ঢাকা জোনের আরেক সদ্য সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল হাইকেও ঘুষ দিয়েছেন ৪০০ কোটি টাকা। সূত্রমতে, জিজ্ঞাসাবাদে শামীম দাবি করেছেন যে দুই প্রকৌশলী ছাড়াও যুবলীগের অন্তত দু’জন শীর্ষ নেতাকে মোটা অঙ্কের মাসোহারা দিতেন তিনি। অবশ্য কাজ পেতে ওই নেতাদের নাম ভাঙাতে হতো তার। তাদের নাম ভাঙিয়ে সরকারি প্রকল্পের কোটি কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিতেন তিনি। এ ছাড়া আরো কয়েক বড় সরকারি কর্মকর্তাও শামীমের কমিশনভোগী ছিলেন। তাদের ব্যাপারেও তথ্য নিচ্ছেন গোয়েন্দারা।

সূত্র মতে, জিজ্ঞাসাবাদে দেয়া তথ্যে শামীম আরো দাবি করেছেন, ক্ষমতাসীন দলের একাধিক সিনিয়র নেতাকে ‘সন্তুষ্ট’ রাখতে নিয়মিতই মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হতো। এর বাইরেও তার অর্থভোগীর তালিকা অনেক দীর্ঘ। শামীমের বক্তব্য এমন, ঠিকাদারি ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তার আয় করা অর্থের বড় অংশই দিতে হতো নানা রথী-মহারথীকে। ঠিকাদারি কাজ ভাগাতে অনেক সময় পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে ব্যবহার করতেন শামীম।

জানতে চাইলে ডিবির যুগ্ম-কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে মতিঝিল, আরামবাগ, পুরানা পল্টন, বাসাবো, শাহজাহানপুর, বাসাবোসহ আশপাশের এলাকায় থাকা ক্লাবগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছিল খালেদ মাহমুদের হাতে। এসব ক্যাসিনো চালানোর বিষয়টি কারা কারা জানতেন ও কারা কারা এ জন্য অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন তা জানার চেষ্টা চলছে। খালেদের সহযোগীদের নাম পাওয়া গেছে। তবে তারা অনেকেই আত্মগোপনে গেছে।

শামীমের বিষয়ে যুগ্ম কমিশনার বলেন, বিপুল পরিমাণ টাকাসহ গ্রেফতার হওয়া শামীমকেও জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবি। তিনিও বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। তবে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। শামীম ও খালেদকে জিজ্ঞাসাবাদের কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নামও বেরিয়ে এসেছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর