১৯৭৫ সালের নভেম্বরের উত্তাল কয়েকটি দিন

বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটটি তৈরি হয়েছিল বেশ আগে। অভ্যুত্থানের কারণ নিয়ে বেশ কিছু ব্যাখ্যা থাকলেও সেনাবাহিনীর তৎকালীন অনেক কর্মকর্তা মনে করেন, ১৫ই অগাস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর থেকেই সেনাবাহিনীতে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছিল, তার একটি ফলশ্রুতি হচ্ছে নভেম্বরের সেই ঘটনাপ্রবাহ।
সেসময় বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান থাকলেও বঙ্গভবন থেকে সেনাবাহিনীর অনেক বিষয় নিয়ন্ত্রণ করছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার সাথে জড়িত কয়েকজন মেজর। অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার শাখাওয়াত হোসেন তখন ছিলেন ঢাকায় ৪৬ ব্রিগেডের মেজর পদমর্যাদার স্টাফ অফিসার। তিনি বলছেন, সেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সাথে যোগ হয়েছিল পারস্পরিক দ্বন্দ্ব। ১৫ই অগাস্টের পর তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহকে সরিয়ে দেয়ার পর মূলত: যে দ্বন্দ্বটি ছিল খালেদ মোশাররফ এবং জিয়াউর রহমানের মাঝে। অক্টোরের শেষ নাগাদই তারা অনেকটা খোলামেলাভাবেই শুনতে পারছিলেন কিছু একটা হতে যাচ্ছে।
কে এম শফিউল্লাহ বলেন, ১৫ই অগাস্টের পর তিনি অনেকটা গৃহবন্দী হিসেবেই সেনাপ্রধানের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর মধ্যে যে একটি উত্তেজনা রয়েছে সেটি তিনি টের পাচ্ছিলেন। নভেম্বরের ৩ তারিখের প্রথম কয়েকটি প্রহরে বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দেয়ার মতো দুটি ঘটনা ঘটে, একটি অভ্যুত্থান এবং ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে একটি হত্যাকাণ্ড।
মধ্যরাত পার হবার পরই খালেদ মোশাররফের নেতৃ্ত্বে একটি অভ্যুত্থানে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দী করা হয়।
অন্যদিকে সেই রাতেই কেন্দ্রীয় কারাগারে চলে একটি হত্যাকাণ্ড। কয়েকজন সেনাসদস্যের হাতে খুন হন ১৯৭১ সালের প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, তৎকালীন সরকারের অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান। শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ঐ জেলহত্যার ঘটনাটি তাৎক্ষনিকভাবে জানাজানি হয়নি। ঘটনাটি অভ্যুত্থানকারী সেনা অফিসারদের কাছে পৌঁছে ৪ঠা নভেম্বর সকালে।
৩রা নভেম্বরেই দিনভর খালেদ মোশাররফসহ অভ্যুথ্থানকারী সেনা কর্মকর্তাদের সাথে দফায় দফায় বৈঠকের পর বঙ্গভবনে অবস্থানরত শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার সাথে জড়িত মেজররা সপরিবারে দেশত্যাগ করেন। এদিকে ৩রা নভেম্বরের পরের কয়েকটি দিন কার্যকর দেখা যায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের গণবাহিনীকে। কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন এই গণবাহিনী পরবর্তী অভ্যুত্থানে একটি মূল ভূমিকা পালন করে।
কর্ণেল তাহেরের ভাই এবং গণবাহিনীর তৎকালীন ঢাকা মহানগর প্রধান অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলছেন, জিয়াউর রহমানের কাছ থেকেই অভ্যুত্থানের খবরটি জানতে পারেন কর্ণেল তাহের। নভেম্বরের ৩ তারিখেই কর্ণেল তাহের নারায়নগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন।
এরই মধ্যে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ৬ নভেম্বর নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম।
নভেম্বরের ৫ এবং ৬ তারিখে গণবাহিনী আরো সক্রিয় এবং সংগঠিত হয়ে উঠতে শুরু করে। কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা চলতে থাকে। শাখাওয়াত হোসেন বলছেন, গণবাহিনী যে একটি কিছু করতে যাচ্ছে সেটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে ৬ তারিখ বিকেলে, যখন ক্যান্টনম্যান্টের ভেতরে গণবাহিনীর নামে একটি লিফলেট ছড়ানো শুরু হয়। তিনি বলেন, লিফলেটে খালেদ মোশারফসহ অভ্যুত্থানকারীদের ভারতের চর হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং গণবাহিনীর দাবী তুলে ধরা হয়। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, গণবাহিনীর বিদ্রোহের মূল পরিকল্পনাটি হয় ৬ তারিখ সন্ধ্যায়।
৭ই নভেম্বর দিবাগত রাতেই শুরু হয়ে যায় পাল্টা অভ্যুত্থান। যার পুরোভাগে ছিল সেনাবাহিনীর জওয়ানরা। সেই রাতেই মুক্ত করা হয় জিয়াউর রহমানকে।
শাখাওয়াত হোসেন বলছিলেন, পরদিন সকালেই তিনি সেনানিবাসে কর্ণেল তাহেরকে দেখতে পান। তাদের মধ্যে কিছু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ও হয়। কর্ণেল তাহের জিয়াউর রহমানকে শহীদ মিনারে যেতে এবং রেডিওতে জাসদের দাবী মেনে নিয়ে একটি ভাষণ দিতে বললেও তিনি সেটিতে রাজী হননি। আগেই তার ভাষণ রেকর্ড করে তিনি রেডিও স্টেশনে পাঠিয়ে দেন ।
ব্রিগেডিয়ার শাখাওয়াত হোসেন বলছেন, ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সময় জওয়ানদের সাথে অনেককে অস্ত্রসহ বেসামরিক পোষাকেও অংশ নিতে দেখা গিয়েছিল। তবে ঐ অভ্যুত্থানে গণবাহিনী তাদের বেসামরিক সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি বলছেন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। তিনি বলছেন, জাসদ যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল সেটি ব্যর্থ হবার এটিও একটি কারণ।
আনোয়ার হোসেন বলছেন, জিয়াউর রহমানের রেডিও ভাষণের পর অভ্যুত্থানে গণবাহিনীর ভূমিকা চাপা পড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ধারণা জন্মে যে, এটি পুরোপুরিই জিয়াউর রহমানের অভ্যুত্থান।
সেই অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন জিয়াউর রহমান। ৭ নভেম্বর সকালেই কর্ণেল কে এন হুদার সাথে ঢাকায় রংপুর থেকে আসা ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টে হত্যা করা হয় খালেদ মোশাররফ, কর্ণেল কে এন হুদা এবং ল্যাফটেনেন্ট কর্ণেল এ টি এম হায়দারকে।
এর কিছুদিন পর ২৪শে নভেম্বর কর্ণেল তাহেরকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৯৭৬ সালের ২১শে জুলাই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে সামরিক আদালতে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে কর্ণেল তাহেরের সেই বিচারকে অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করে।
১৯৮১ সাল পর্যন্ত সেনাপ্রধান, উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জিয়াউর রহমান। ১৯৮১ সালের মে মাসে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে তাকে হত্যা করা হয়। ।বিবিসি বাংলা।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর