ঢাকা ০৩:৪৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

একাত্তরের বীরাঙ্গনা এখন মাটি কাটার শ্রমিক

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:১৮:২১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর ২০১৫
  • ৪৭৮ বার

সবকিছু হারিয়ে অনেক কষ্টে দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে বড় করে তুলেছি। এখনো এলাকার অনেকেই আমার ছেলে মেয়েদের ধর্ষিতার সন্তান বলে অপদস্থ করে। এলাকার কেউ যেন আমার ছেলে মেয়েদের ধর্ষিতার সন্তান না বলে। শেষ বয়সে এই টুকুই আমার কামনা।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের একাত্তরের বীরাঙ্গনা মনোয়ারা বেগম এক বুক জ্বালা নিয়ে এই কথা গুলো বললেন। উপজেলার সাতগাঁও রেলওয়ে স্টেশনের ভূমিতে একটি ছোট ঝুপড়ি ঘড়ে তিন সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তিনি।
একাত্তরে মনোয়ারা ছিলেন ষোল বছরের যুবতী। তালাতো ভাই মো. চেরাগ আলীর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে দেশে শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। এ অবস্থায় মনোয়ারার হবু বর চেরাগ আলী সিদ্ধান্ত নেন দেশ স্বাধীন না করে বিয়ে করবেন না। সে সিদ্ধান্তে সায় দেয় মনোয়ারা। যুদ্ধ শেষ হয়। দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু মনোয়ারার বিয়ের স্বাদ অপূর্ণ থেকে যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধে গিয়ে পাক সেনার গুলিতে শহীদ হন চেরাগ আলী। আর যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় পাক হানাদার বাহিনীর লালসার শিকার হন মনোয়ারা।
বীরাঙ্গনা মনোয়ারা জানান, যুদ্ধকালীন সময়ে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তার খালার বাড়ির পাশে ছোট ছড়াতে বসে গৃহস্থ সামগ্রী ধুয়ার কাজ করছিলেন। হঠাৎ চারদিকে লোকজনের ছুটাছুটি দেখে মনোয়ারা বাড়ির পথ ধরেন। কিন্তু বাড়িতে পৌছার আগেই স্থানীয় রাজাকার তোতা মিয়া, তেরা মিয়া ও ময়না মিয়াদের সহযোগিতায় পাক হায়েনারা ধরে ফেলে তাকে। সেখান থেকে টেনে হেঁচড়ে জোরপূর্বক পাক হায়েনারা মনোয়ারাকে তার খালার বাড়ির একটি কক্ষে নিয়ে পালাক্রমে পাশবিক অত্যাচার চালায়।
দেশ স্বাধীন হবার পর মামা ও খালা মিলে মনোয়ারাকে পার্শ্ববর্তী লাহারপুর গ্রামের মো. ছিদ্দেক আলীর সঙ্গে বিয়ে দেন। একে একে তার গর্ভে জন্ম নেয় তিন সন্তান। কিন্তু এক সময় মনোয়ারার পাক হায়েনাদের হাতে নির্যাতনের খবর শুনে স্বামী ছিদ্দেক আলী তিন সন্তানের জননী মনোয়ারাকে তালাক দেন। সর্বস্ব হারানো মনোয়ারা তার শিশু সন্তানরা হয়ে পড়ে আশ্রয়হীন। উপায়ন্তর না দেখে মনোয়ারা সন্তানদের দু’মুঠো অন্ন সংস্থানের জন্য গ্রামীণ সড়কে মাটি কাটার শ্রমিক হিসেবে যোগ দেন। সেই থেকে আজও তিনি জীবন জীবিকার তাগিদে মাটি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে চলেছেন। বৃদ্ধ বয়সেও ক্লান্তি ছুতে পারেনি তাকে। এক বেলা কাজে না গেলে সে বেলা খাওয়া বন্ধ। মনোয়ারা নিজের ইজ্জত ও তার হবু বরের রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীন দেশ পেয়েছে সে দেশের হাজারো বীরাঙ্গনার একজন মনোয়ারা কি পেয়েছে শেষ বয়সে এসে সেই প্রশ্ন তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

একাত্তরের বীরাঙ্গনা এখন মাটি কাটার শ্রমিক

আপডেট টাইম : ১২:১৮:২১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর ২০১৫

সবকিছু হারিয়ে অনেক কষ্টে দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে বড় করে তুলেছি। এখনো এলাকার অনেকেই আমার ছেলে মেয়েদের ধর্ষিতার সন্তান বলে অপদস্থ করে। এলাকার কেউ যেন আমার ছেলে মেয়েদের ধর্ষিতার সন্তান না বলে। শেষ বয়সে এই টুকুই আমার কামনা।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের একাত্তরের বীরাঙ্গনা মনোয়ারা বেগম এক বুক জ্বালা নিয়ে এই কথা গুলো বললেন। উপজেলার সাতগাঁও রেলওয়ে স্টেশনের ভূমিতে একটি ছোট ঝুপড়ি ঘড়ে তিন সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তিনি।
একাত্তরে মনোয়ারা ছিলেন ষোল বছরের যুবতী। তালাতো ভাই মো. চেরাগ আলীর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে দেশে শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। এ অবস্থায় মনোয়ারার হবু বর চেরাগ আলী সিদ্ধান্ত নেন দেশ স্বাধীন না করে বিয়ে করবেন না। সে সিদ্ধান্তে সায় দেয় মনোয়ারা। যুদ্ধ শেষ হয়। দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু মনোয়ারার বিয়ের স্বাদ অপূর্ণ থেকে যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধে গিয়ে পাক সেনার গুলিতে শহীদ হন চেরাগ আলী। আর যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় পাক হানাদার বাহিনীর লালসার শিকার হন মনোয়ারা।
বীরাঙ্গনা মনোয়ারা জানান, যুদ্ধকালীন সময়ে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তার খালার বাড়ির পাশে ছোট ছড়াতে বসে গৃহস্থ সামগ্রী ধুয়ার কাজ করছিলেন। হঠাৎ চারদিকে লোকজনের ছুটাছুটি দেখে মনোয়ারা বাড়ির পথ ধরেন। কিন্তু বাড়িতে পৌছার আগেই স্থানীয় রাজাকার তোতা মিয়া, তেরা মিয়া ও ময়না মিয়াদের সহযোগিতায় পাক হায়েনারা ধরে ফেলে তাকে। সেখান থেকে টেনে হেঁচড়ে জোরপূর্বক পাক হায়েনারা মনোয়ারাকে তার খালার বাড়ির একটি কক্ষে নিয়ে পালাক্রমে পাশবিক অত্যাচার চালায়।
দেশ স্বাধীন হবার পর মামা ও খালা মিলে মনোয়ারাকে পার্শ্ববর্তী লাহারপুর গ্রামের মো. ছিদ্দেক আলীর সঙ্গে বিয়ে দেন। একে একে তার গর্ভে জন্ম নেয় তিন সন্তান। কিন্তু এক সময় মনোয়ারার পাক হায়েনাদের হাতে নির্যাতনের খবর শুনে স্বামী ছিদ্দেক আলী তিন সন্তানের জননী মনোয়ারাকে তালাক দেন। সর্বস্ব হারানো মনোয়ারা তার শিশু সন্তানরা হয়ে পড়ে আশ্রয়হীন। উপায়ন্তর না দেখে মনোয়ারা সন্তানদের দু’মুঠো অন্ন সংস্থানের জন্য গ্রামীণ সড়কে মাটি কাটার শ্রমিক হিসেবে যোগ দেন। সেই থেকে আজও তিনি জীবন জীবিকার তাগিদে মাটি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে চলেছেন। বৃদ্ধ বয়সেও ক্লান্তি ছুতে পারেনি তাকে। এক বেলা কাজে না গেলে সে বেলা খাওয়া বন্ধ। মনোয়ারা নিজের ইজ্জত ও তার হবু বরের রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীন দেশ পেয়েছে সে দেশের হাজারো বীরাঙ্গনার একজন মনোয়ারা কি পেয়েছে শেষ বয়সে এসে সেই প্রশ্ন তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।