ঢাকা ০৩:৪১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫, ২৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তিস্তার বুকে জেগে ওঠা চরে চাষাবাদ করছেন পাড়ের লাখো কৃষক

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৩:৫৯:৫০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ এপ্রিল ২০১৯
  • ২৭০ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ করালগ্রাসী প্রমত্তা তিস্তা এখন মরুভূমি। তিস্তার বুকে জেগে ওঠা চরে চাষাবাদ করছেন পাড়ের লাখো কৃষক। দুই পাড়ে বসবাসকারীরা জানান, তিস্তা এখন আর নদী নয়, এ যেন বিস্তীর্ণ আবাদি জমি। তিস্তার বুকে খেয়াপারে বা মাছ ধরতে নৌকা নিয়ে ছুটে চলা মাঝিমল্লাদের দৌড়ঝাঁপ নেই। পানি আর মাছে পরিপূর্ণ তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে শুধুই বালুচর। মাছ ধরতে না পেরে মানবেতর জীবন যাপন করছে নদীর দুই পাড়ের কয়েক হাজার জেলেপরিবার। বিপন্ন হতে বসেছে তিস্তার বুকে বাস করা নানা জীববৈচিত্র্য। নৌকা নয়, পায়ে হেঁটেই তিস্তা পাড়ি দিচ্ছেন নদী দুই পাড়ের মানুষজন। জেলে থেকে শুরু করে নদীকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকা লাখো মানুষের কান্নায় তিস্তাপাড়ের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, এ অঞ্চলের বৃহৎ নদী তিস্তা এখন মরুভমি। এর বুকে ফলছে নানা ধরনের ফসল। প্রমত্তা তিস্তার খেয়াঘাটের নৌকাগুলো গায়ে গা ঘেঁষে রাখা হয়েছে। তিস্তার চরে কাজ শেষে হেঁটে নদী পার হয়ে আসেন লালমনিরহাটের চর রাজপুর এলাকার রবিউল ও জুয়েল।

এ সময় জুয়েল জানান, তিস্তায় একহাঁটু পানিও নেই। ক্ষীণ হয়ে এসেছে নদী। নেই কোনো নাব্যতা। জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। বালুচরে দিগন্তজুড়ে সবুজের মাঠে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কৃষক। আলু, তামাকসহ বিভিন্ন ফসল তোলার ধুম পড়েছে তিস্তায়।

প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে নেমে আসে বালু। ফলে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বছর বছর তলদেশ ভরাট হওয়ায় এ জেলার নদীগুলো হারাতে বসেছে তার ঐতিহ্য। নদীতে মাছ ধরে যারা জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারা আজ অসহায়। পানি না থাকায় জেলেরা পেশা বদল করে চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়। সংশ্লিষ্ট সূত্রের এক পরিসংখ্যান মতে, লালমনিরহাট জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ছোট-বড় অনেকগুলো নদী। কিন্তু কালক্রমে নদী ভরাট হয়ে পানি শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে এ জেলার জনপদ। বন্ধ হয়ে গেছে নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষাবাদ। আর পানি না থাকায় দুর্দিন চলছে মৎস্যজীবীদের।

তিস্তা, ধরলা, রতনাই, স্বর্ণামতী, সানিয়াজান, সাঁকোয়া, মালদহ, ত্রিমোহিনী, সতী, গিরিধারী, ছিনাকাটা, ধলাই, ভেটেশ্বরসহ ছোট-বড় ১৩টি নদী লালমনিরহাট জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, যার দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে চার শ কিলোমিটার। এসব নদীর বুকে একসময় পালতোলা নৌকা চলত। কালের পরিক্রমায় সেই নদীর বুকে এখন ঋতুভিত্তিক নানা ফসল বাতাসে দোল খায়। দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে একসময় নদী ছিল। পলি জমে ভরাট হয়ে নদী তার স্বকীয়তা হারিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নদীগুলোর পলি অপসারণ জরুরি হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, নদীগুলো পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে।

জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ১৩টি নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে এগুলোতে কোনো পানি নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওই সূত্রটি দাবি করে, নদীগুলো খনন করে পানিপ্রবাহ ধরে রাখা সম্ভব। এ ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন বলে মনে করেন পাউবোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। এদিকে ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ঐতিহাসিক তিস্তা নদী। লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে তিস্তা। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার হলেও বাংলাদেশ অংশে রয়েছে ১৬৫ কিলোমিটার। ভারতের গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে সেই দেশের সরকার একতরফা তিস্তার পানি নিয়ন্ত্রণ করায় নদীটির বাংলাদেশ অংশ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। ফলে লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলার ১৬৫ কিলোমিটার তিস্তার অববাহিকায় জীবনযাত্রা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। দেশের অন্যতম সেচ প্রকল্প লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার তিস্তা ব্যারাজ অকার্যকর হওয়ার উপক্রম।

তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত রেলসেতু, সড়কসেতু ও নির্মাণাধীন দ্বিতীয় তিস্তা সড়কসেতু দাঁড়িয়ে আছে ধু-ধু বালুচর তিস্তার ওপর। পায়ে হেঁটেই পার হচ্ছে অনেকে। ঢেউহীন তিস্তায় রয়েছে শুধুই বালুকণা। তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প সূত্র জানায়, প্রকল্প এলাকায় সেচ দেওয়া এবং নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক পানি। শুধু সেচ প্রকল্প চালাতেই প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ১৪ হাজার কিউসেক এবং নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য চার হাজার কিউসেক পানি। কিন্তু তিস্তায় প্রয়োজনীয় পানি মিলছে না। শুষ্ক মৌসুমে বোরো আবাদের সময় ব্যারাজ পয়েন্টে কয়েক বছর ধরে পাওয়া যায় মাত্র ৫০০ কিউসেক পানি। ব্যারাজের সবকটি জলকপাট বন্ধ রেখে সেচ প্রকল্পে পানি সরবরাহ করায় নদীর ভাটিতে আর প্রবাহ থাকছে না।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

তিস্তার বুকে জেগে ওঠা চরে চাষাবাদ করছেন পাড়ের লাখো কৃষক

আপডেট টাইম : ০৩:৫৯:৫০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ এপ্রিল ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ করালগ্রাসী প্রমত্তা তিস্তা এখন মরুভূমি। তিস্তার বুকে জেগে ওঠা চরে চাষাবাদ করছেন পাড়ের লাখো কৃষক। দুই পাড়ে বসবাসকারীরা জানান, তিস্তা এখন আর নদী নয়, এ যেন বিস্তীর্ণ আবাদি জমি। তিস্তার বুকে খেয়াপারে বা মাছ ধরতে নৌকা নিয়ে ছুটে চলা মাঝিমল্লাদের দৌড়ঝাঁপ নেই। পানি আর মাছে পরিপূর্ণ তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে শুধুই বালুচর। মাছ ধরতে না পেরে মানবেতর জীবন যাপন করছে নদীর দুই পাড়ের কয়েক হাজার জেলেপরিবার। বিপন্ন হতে বসেছে তিস্তার বুকে বাস করা নানা জীববৈচিত্র্য। নৌকা নয়, পায়ে হেঁটেই তিস্তা পাড়ি দিচ্ছেন নদী দুই পাড়ের মানুষজন। জেলে থেকে শুরু করে নদীকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকা লাখো মানুষের কান্নায় তিস্তাপাড়ের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, এ অঞ্চলের বৃহৎ নদী তিস্তা এখন মরুভমি। এর বুকে ফলছে নানা ধরনের ফসল। প্রমত্তা তিস্তার খেয়াঘাটের নৌকাগুলো গায়ে গা ঘেঁষে রাখা হয়েছে। তিস্তার চরে কাজ শেষে হেঁটে নদী পার হয়ে আসেন লালমনিরহাটের চর রাজপুর এলাকার রবিউল ও জুয়েল।

এ সময় জুয়েল জানান, তিস্তায় একহাঁটু পানিও নেই। ক্ষীণ হয়ে এসেছে নদী। নেই কোনো নাব্যতা। জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। বালুচরে দিগন্তজুড়ে সবুজের মাঠে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কৃষক। আলু, তামাকসহ বিভিন্ন ফসল তোলার ধুম পড়েছে তিস্তায়।

প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে নেমে আসে বালু। ফলে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বছর বছর তলদেশ ভরাট হওয়ায় এ জেলার নদীগুলো হারাতে বসেছে তার ঐতিহ্য। নদীতে মাছ ধরে যারা জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারা আজ অসহায়। পানি না থাকায় জেলেরা পেশা বদল করে চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়। সংশ্লিষ্ট সূত্রের এক পরিসংখ্যান মতে, লালমনিরহাট জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ছোট-বড় অনেকগুলো নদী। কিন্তু কালক্রমে নদী ভরাট হয়ে পানি শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে এ জেলার জনপদ। বন্ধ হয়ে গেছে নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষাবাদ। আর পানি না থাকায় দুর্দিন চলছে মৎস্যজীবীদের।

তিস্তা, ধরলা, রতনাই, স্বর্ণামতী, সানিয়াজান, সাঁকোয়া, মালদহ, ত্রিমোহিনী, সতী, গিরিধারী, ছিনাকাটা, ধলাই, ভেটেশ্বরসহ ছোট-বড় ১৩টি নদী লালমনিরহাট জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, যার দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে চার শ কিলোমিটার। এসব নদীর বুকে একসময় পালতোলা নৌকা চলত। কালের পরিক্রমায় সেই নদীর বুকে এখন ঋতুভিত্তিক নানা ফসল বাতাসে দোল খায়। দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে একসময় নদী ছিল। পলি জমে ভরাট হয়ে নদী তার স্বকীয়তা হারিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নদীগুলোর পলি অপসারণ জরুরি হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, নদীগুলো পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে।

জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ১৩টি নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে এগুলোতে কোনো পানি নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওই সূত্রটি দাবি করে, নদীগুলো খনন করে পানিপ্রবাহ ধরে রাখা সম্ভব। এ ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন বলে মনে করেন পাউবোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। এদিকে ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ঐতিহাসিক তিস্তা নদী। লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে তিস্তা। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার হলেও বাংলাদেশ অংশে রয়েছে ১৬৫ কিলোমিটার। ভারতের গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে সেই দেশের সরকার একতরফা তিস্তার পানি নিয়ন্ত্রণ করায় নদীটির বাংলাদেশ অংশ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। ফলে লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলার ১৬৫ কিলোমিটার তিস্তার অববাহিকায় জীবনযাত্রা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। দেশের অন্যতম সেচ প্রকল্প লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার তিস্তা ব্যারাজ অকার্যকর হওয়ার উপক্রম।

তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত রেলসেতু, সড়কসেতু ও নির্মাণাধীন দ্বিতীয় তিস্তা সড়কসেতু দাঁড়িয়ে আছে ধু-ধু বালুচর তিস্তার ওপর। পায়ে হেঁটেই পার হচ্ছে অনেকে। ঢেউহীন তিস্তায় রয়েছে শুধুই বালুকণা। তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প সূত্র জানায়, প্রকল্প এলাকায় সেচ দেওয়া এবং নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক পানি। শুধু সেচ প্রকল্প চালাতেই প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ১৪ হাজার কিউসেক এবং নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য চার হাজার কিউসেক পানি। কিন্তু তিস্তায় প্রয়োজনীয় পানি মিলছে না। শুষ্ক মৌসুমে বোরো আবাদের সময় ব্যারাজ পয়েন্টে কয়েক বছর ধরে পাওয়া যায় মাত্র ৫০০ কিউসেক পানি। ব্যারাজের সবকটি জলকপাট বন্ধ রেখে সেচ প্রকল্পে পানি সরবরাহ করায় নদীর ভাটিতে আর প্রবাহ থাকছে না।