ঢাকা ০১:৫০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আমি বাংলাদেশের মানুষ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৩৭:০৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫
  • ২৫১ বার

ছোট নদী নীলকমল। বাঁশের পুল পেরোলেই অধুনালুপ্ত দাসিয়ারছড়া ছিটমহল। গত ৭ অক্টোবর যখন ঐ এলাকায় যাই সর্বত্রই কর্মমুখর প্রাণচাঞ্চল্য চোখে পড়ে। ইট-বালুর চওড়া রাস্তা নির্মিত হচ্ছে। নতুন পোস্টে বিদ্যুতের লাইন হচ্ছে। উপজেলা থেকে টিএ্যান্ডটি লাইন সম্প্রসারণের কাজ চলছে। কমিউনিটি ক্লিনিক, তথ্যকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। চালু হয়েছে অস্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি, কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম। সবকিছু মিলিয়ে ১০ হাজারের বেশি মানুষের এই জনপদে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।

১৫ অক্টোবর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দাসিয়ারছড়া আসবেন। মূলত তাঁর আগমনকে সামনে রেখেই এখানে আসা। তাছাড়া ব্যক্তিগত আগ্রহের মাত্রাটাও একটা কারণ।

ছিটমহল সম্পর্কে যে ভাসা ভাসা ধারণা ছিল, সরেজমিন এসে যেন তার পূর্ণতা পেল। নতুন দেশ, নতুন পাতাকা, নতুন জাতীয়তা পাওয়া মুক্ত মানুষের কাছাকাছি না গেলে কখনই হয়তো উপলব্ধি করতে পারতাম না ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের মর্মযন্ত্রণা।

ছিটমহল তৈরির ইতিহাস অল্প-বিস্তর আমাদের জানা। ব্রিটিশ শাসন আমলে অবিভক্ত ভারতের কোচবিহারের মহারাজা ও রংপুরের মহারাজা ইংরেজদের জমিদারীর খাজনা দিতেন না। ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের কারণেই খাজনা দেওয়া থেকে তারা অব্যাহতি পেয়েছিলেন। পরে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের প্রাক্কালে ভারত ও তৎকালীন পাকিস্তানের মানচিত্র অঙ্কন করার সময়ও দুই মহারাজার জমি পৃথকভাবে চিহ্নিত করা হয়। দেশ বিভাগের সময় কোচবিহার মহারাজার জমিদারীতে বসবাসকারীরা ভারতের সঙ্গে বসবাসের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে রংপুর মহারাজার জমিতে বসবাসকারীরা পাকিস্তানে থাকতে চান। কিন্তু কোচবিহার মহারাজার কিছু জমি রংপুর মহারাজার জমির ভেতরে পড়ে যায়। একই ভাবে রংপুর মহারাজার কিছু জমি কোচবিহার মহারাজার জমির ভেতর পড়ে যায়। ফলে দুই দেশ পৃথক হওয়ার সময় জমির ক্ষুদ্র অংশ থেকে ছিটমহল তৈরি হয়।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ আইনজীবী স্যার র‌্যাডক্লিফ দীর্ঘকালের যোগাযোগ ব্যবস্থা, সমন্বিত অর্থনৈতিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে অখণ্ড এলাকার মাঝ বরাবর দাগ কেটে সীমানা বিরোধের যে বীজ রোপণ করেছিলেন তার খেসারত এই অঞ্চলের মানুষকে দীর্ঘকাল দিতে হয়েছে।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন আমলে ছিটমহল সমস্যার শুরু, দ্বিতীয় ঔপনিবেশিক অর্থাৎ পাকিস্তান আমলে সমস্যার সমধান তো হয়নি বরং জটিলতা বৃদ্ধি পায়। সর্বপ্রথম এর সমাধানের পদক্ষেপ নেন বঙ্গবন্ধু। আর পরিপূর্ণভাবে সমস্যার ইতি ঘটে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সময়।বঙ্গবন্ধু পরাধীন জাতিকে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করে স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছেন। তিনিই প্রথম ছিটমহলবাসীর কষ্ট অনুধাবন করেছেন। ছিটমহলে জন্মের কারণে যারা নিজেকে অপরাধী মনে করত, নিয়তিকে দোষ দেওয়া ছাড়া অন্য কিছু ভাবার অবকাশ যাদের ছিল না, দেশ বিভাগের ২৭ বছর পর তাদেরই মুক্তির মন্ত্র শুনিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছিটমহলবাসীর সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যেই ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিজ নিজ দেশের পক্ষে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশ ঐ চুক্তিতে অনুসমর্থন দিলেও জমি হস্তান্তরে ভারতের সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন হওয়ায় বিষয়টি আটকে থাকে।

ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি নামে পরিচিত ১৯৭৪ সালের স্থল চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ২০১১ সালে ঢাকা সফরে এসে প্রটোকলে স্বাক্ষর করেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়কোচিত কূটনৈতিকি উদ্যোগ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ সকল পক্ষের সহযোগিতায় মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির ৪১ বছরের মাথায় বিষয়টির র‌্যাটিফিকেশন বা অনুমোদন প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়। এর মাধ্যেমে শেষ হয় ছিটমহলবাসীর সাত দশকের বঞ্চনা ও ভোগান্তির।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করেছি। কিন্তু প্রকৃত বিজয়ের স্বাদ পেয়েছি ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর। তেমনি গত ১ আগস্ট কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাসিয়ার ছড়া ছিটমহলে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে ছিটমহলবাসীর নতুন জীবনের যাত্রা শুরু হলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আগমনের মধ্য দিয়ে দাসিয়ারছড়ার মানুষের উচ্ছ্বাস-আনন্দ পূর্ণতা পাবে।

আজ যে কথা না বললেই নয়, মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নিয়ে এ দেশে অনেক রাজনীতি হয়েছে। ছিটমহলবাসীর মুক্তির সনদ এ চুক্তিকে ‘গোলামীর চুক্তি’ও বলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ছাড়া সমস্যা সমাধানে কেউ এগিয়ে আসেনি। বরং সমস্যা জিইয়ে রেখে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করেছে অতীতের সরকারগুলো। সেই অপশক্তির মুখে চুনকালি দিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তিসহ সকল অমীমাংসিত সমস্যা একে একে সমাধান করছেন। বঙ্গবন্ধু যেমন পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে বাঙালী জাতিকে বিশ্বে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তার যোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের অভিশাপমুক্ত হয়ে মানুষ আজ আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠেছে।

সংক্ষিপ্ত পরিসরে ছিটমহলের পূর্বাপর সামগ্রিক ঘটনাপ্রবহ বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আর আমার উদ্দেশ্যও সেটি নয়। তাই যেখান থেকে এ লেখা শুরু করেছিলাম সেখানেই ফিরে যাওয়া সঙ্গত।

দাসিয়ারছড়ায় কয়েক ঘণ্টা অবস্থানকালে অনেক সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা হয়। আলাপচারিতায় তাদের আবেগ-অনুভূতি জানতে পারি। শেখ হাসিনার কল্যাণে দাসিয়ারছড়ার মানুষগুলোর যেন নতুন জন্ম হয়েছে। কালিরহাট বাজারের পাশে কয়েকজন মহিলা রাস্তায় মাটি ভরাটের কাজ করছিল। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দসহ আমরা যখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন আমাদেরই একজন নারীদের জিজ্ঞাসা করছিল, তোমরা কি ছিটের (ছিটমহলের) মানুষ না ফুলবাড়ীর (উপজেলার) মানুষ। তখন কর্মজীবী নারীদের একজন টুকরিভরা মাটি ফেলে ঘাড় বাঁকিয়ে উত্তর দিল, আমি বাংলাদেশের মানুষ। নাম না জানা ওই শ্রমজীবী নারীর আত্মসম্মানবোধ দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে এলো। ’৭১-এ অনেক ছোট ছিলাম, বঙ্গবন্ধুর দেয়া স্বাধীনতার মর্ম তখন অনুধাবন করতে পারিনি। দাসিয়ারছড়ার খেটে খাওয়া মানুষটির কথা শুনে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম বঙ্গবন্ধুর প্রতি, যিনি আমাদের পরিচয় দিয়েছেন, স্বাধীন ভূখণ্ড দিয়েছেন। আমাদের কৃতজ্ঞতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রতি, যিনি দাসিয়ার ছড়ার মানুষদের বলতে শিখিয়েছেন ‘আমি বাংলাদেশের মানুষ’।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

আমি বাংলাদেশের মানুষ

আপডেট টাইম : ১২:৩৭:০৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫

ছোট নদী নীলকমল। বাঁশের পুল পেরোলেই অধুনালুপ্ত দাসিয়ারছড়া ছিটমহল। গত ৭ অক্টোবর যখন ঐ এলাকায় যাই সর্বত্রই কর্মমুখর প্রাণচাঞ্চল্য চোখে পড়ে। ইট-বালুর চওড়া রাস্তা নির্মিত হচ্ছে। নতুন পোস্টে বিদ্যুতের লাইন হচ্ছে। উপজেলা থেকে টিএ্যান্ডটি লাইন সম্প্রসারণের কাজ চলছে। কমিউনিটি ক্লিনিক, তথ্যকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। চালু হয়েছে অস্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি, কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম। সবকিছু মিলিয়ে ১০ হাজারের বেশি মানুষের এই জনপদে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।

১৫ অক্টোবর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দাসিয়ারছড়া আসবেন। মূলত তাঁর আগমনকে সামনে রেখেই এখানে আসা। তাছাড়া ব্যক্তিগত আগ্রহের মাত্রাটাও একটা কারণ।

ছিটমহল সম্পর্কে যে ভাসা ভাসা ধারণা ছিল, সরেজমিন এসে যেন তার পূর্ণতা পেল। নতুন দেশ, নতুন পাতাকা, নতুন জাতীয়তা পাওয়া মুক্ত মানুষের কাছাকাছি না গেলে কখনই হয়তো উপলব্ধি করতে পারতাম না ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের মর্মযন্ত্রণা।

ছিটমহল তৈরির ইতিহাস অল্প-বিস্তর আমাদের জানা। ব্রিটিশ শাসন আমলে অবিভক্ত ভারতের কোচবিহারের মহারাজা ও রংপুরের মহারাজা ইংরেজদের জমিদারীর খাজনা দিতেন না। ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের কারণেই খাজনা দেওয়া থেকে তারা অব্যাহতি পেয়েছিলেন। পরে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের প্রাক্কালে ভারত ও তৎকালীন পাকিস্তানের মানচিত্র অঙ্কন করার সময়ও দুই মহারাজার জমি পৃথকভাবে চিহ্নিত করা হয়। দেশ বিভাগের সময় কোচবিহার মহারাজার জমিদারীতে বসবাসকারীরা ভারতের সঙ্গে বসবাসের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে রংপুর মহারাজার জমিতে বসবাসকারীরা পাকিস্তানে থাকতে চান। কিন্তু কোচবিহার মহারাজার কিছু জমি রংপুর মহারাজার জমির ভেতরে পড়ে যায়। একই ভাবে রংপুর মহারাজার কিছু জমি কোচবিহার মহারাজার জমির ভেতর পড়ে যায়। ফলে দুই দেশ পৃথক হওয়ার সময় জমির ক্ষুদ্র অংশ থেকে ছিটমহল তৈরি হয়।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ আইনজীবী স্যার র‌্যাডক্লিফ দীর্ঘকালের যোগাযোগ ব্যবস্থা, সমন্বিত অর্থনৈতিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে অখণ্ড এলাকার মাঝ বরাবর দাগ কেটে সীমানা বিরোধের যে বীজ রোপণ করেছিলেন তার খেসারত এই অঞ্চলের মানুষকে দীর্ঘকাল দিতে হয়েছে।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন আমলে ছিটমহল সমস্যার শুরু, দ্বিতীয় ঔপনিবেশিক অর্থাৎ পাকিস্তান আমলে সমস্যার সমধান তো হয়নি বরং জটিলতা বৃদ্ধি পায়। সর্বপ্রথম এর সমাধানের পদক্ষেপ নেন বঙ্গবন্ধু। আর পরিপূর্ণভাবে সমস্যার ইতি ঘটে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সময়।বঙ্গবন্ধু পরাধীন জাতিকে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করে স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছেন। তিনিই প্রথম ছিটমহলবাসীর কষ্ট অনুধাবন করেছেন। ছিটমহলে জন্মের কারণে যারা নিজেকে অপরাধী মনে করত, নিয়তিকে দোষ দেওয়া ছাড়া অন্য কিছু ভাবার অবকাশ যাদের ছিল না, দেশ বিভাগের ২৭ বছর পর তাদেরই মুক্তির মন্ত্র শুনিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছিটমহলবাসীর সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যেই ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিজ নিজ দেশের পক্ষে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশ ঐ চুক্তিতে অনুসমর্থন দিলেও জমি হস্তান্তরে ভারতের সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন হওয়ায় বিষয়টি আটকে থাকে।

ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি নামে পরিচিত ১৯৭৪ সালের স্থল চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ২০১১ সালে ঢাকা সফরে এসে প্রটোকলে স্বাক্ষর করেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়কোচিত কূটনৈতিকি উদ্যোগ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ সকল পক্ষের সহযোগিতায় মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির ৪১ বছরের মাথায় বিষয়টির র‌্যাটিফিকেশন বা অনুমোদন প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়। এর মাধ্যেমে শেষ হয় ছিটমহলবাসীর সাত দশকের বঞ্চনা ও ভোগান্তির।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করেছি। কিন্তু প্রকৃত বিজয়ের স্বাদ পেয়েছি ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর। তেমনি গত ১ আগস্ট কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাসিয়ার ছড়া ছিটমহলে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে ছিটমহলবাসীর নতুন জীবনের যাত্রা শুরু হলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আগমনের মধ্য দিয়ে দাসিয়ারছড়ার মানুষের উচ্ছ্বাস-আনন্দ পূর্ণতা পাবে।

আজ যে কথা না বললেই নয়, মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নিয়ে এ দেশে অনেক রাজনীতি হয়েছে। ছিটমহলবাসীর মুক্তির সনদ এ চুক্তিকে ‘গোলামীর চুক্তি’ও বলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ছাড়া সমস্যা সমাধানে কেউ এগিয়ে আসেনি। বরং সমস্যা জিইয়ে রেখে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করেছে অতীতের সরকারগুলো। সেই অপশক্তির মুখে চুনকালি দিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তিসহ সকল অমীমাংসিত সমস্যা একে একে সমাধান করছেন। বঙ্গবন্ধু যেমন পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে বাঙালী জাতিকে বিশ্বে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তার যোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের অভিশাপমুক্ত হয়ে মানুষ আজ আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠেছে।

সংক্ষিপ্ত পরিসরে ছিটমহলের পূর্বাপর সামগ্রিক ঘটনাপ্রবহ বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আর আমার উদ্দেশ্যও সেটি নয়। তাই যেখান থেকে এ লেখা শুরু করেছিলাম সেখানেই ফিরে যাওয়া সঙ্গত।

দাসিয়ারছড়ায় কয়েক ঘণ্টা অবস্থানকালে অনেক সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা হয়। আলাপচারিতায় তাদের আবেগ-অনুভূতি জানতে পারি। শেখ হাসিনার কল্যাণে দাসিয়ারছড়ার মানুষগুলোর যেন নতুন জন্ম হয়েছে। কালিরহাট বাজারের পাশে কয়েকজন মহিলা রাস্তায় মাটি ভরাটের কাজ করছিল। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দসহ আমরা যখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন আমাদেরই একজন নারীদের জিজ্ঞাসা করছিল, তোমরা কি ছিটের (ছিটমহলের) মানুষ না ফুলবাড়ীর (উপজেলার) মানুষ। তখন কর্মজীবী নারীদের একজন টুকরিভরা মাটি ফেলে ঘাড় বাঁকিয়ে উত্তর দিল, আমি বাংলাদেশের মানুষ। নাম না জানা ওই শ্রমজীবী নারীর আত্মসম্মানবোধ দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে এলো। ’৭১-এ অনেক ছোট ছিলাম, বঙ্গবন্ধুর দেয়া স্বাধীনতার মর্ম তখন অনুধাবন করতে পারিনি। দাসিয়ারছড়ার খেটে খাওয়া মানুষটির কথা শুনে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম বঙ্গবন্ধুর প্রতি, যিনি আমাদের পরিচয় দিয়েছেন, স্বাধীন ভূখণ্ড দিয়েছেন। আমাদের কৃতজ্ঞতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রতি, যিনি দাসিয়ার ছড়ার মানুষদের বলতে শিখিয়েছেন ‘আমি বাংলাদেশের মানুষ’।