হাওর বার্তা ডেস্কঃ ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সুনামের সহিত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় রাজধানী তথা দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। সুনামের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকা এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে বিশেষ করে ২০০২ সাল থেকেই একের পর এক প্রতিষ্ঠানপ্রধান বদলের মধ্য দিয়ে ঝেঁকে বসে অনিয়ম-দুর্নীতি। সেই থেকে শিক্ষাব্যবস্থার বারোটা বাজানো এ প্রতিষ্ঠানের অবয়ব বেড়েছে কয়েক গুণ। সিদ্ধেশ্বরীতে মূল ক্যাম্পাসের পাশাপাশি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, আজিমপুর ও ধানমন্ডিতে দুই শিফটে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে নামি এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর পাঠদানে নিয়োজিত আছেন ৪৫০-এর বেশি শিক্ষক। এ শিক্ষকদের অনেকের বিরুদ্ধেই কোচিং-বাণিজ্যের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। একাধিক শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে অবৈধ সম্পদ অর্জনের। এসব শিক্ষকের অবৈধ সম্পদের খোঁজে অনুসন্ধানও চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভর্তি-বাণিজ্য, ঘুষ, অতিরিক্ত অর্থ আদায়, কোচিং-বাণিজ্যের অভিযোগ আগের চেয়ে বেড়েছে। ভর্তি ও কোচিং-বাণিজ্য নিয়ে একাধিক অভিযোগ এরই মধ্যে অনুসন্ধানও করেছে দুদক। অনুসন্ধানে শিক্ষকদের কোচিং-বাণিজ্যের অভিযোগের প্রমাণও মিলেছে।
বর্তমানে ভিকারুননিসার একাধিক শিক্ষকের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অভিযোগ খতিয়ে দেখছে দুদক। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের যেসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান চলছে, তাদের মধ্যে আছেন কলেজ শাখার সহকারী অধ্যাপক ড. ফারহানা খানম ও প্রভাষক রাশিদা আক্তার মিল্কী। আরও যেসব শিক্ষক দুদকের অনুসন্ধানের আওতায় আছেন তারা হলেন প্রতিষ্ঠানের দিবা শাখার সহকারী শিক্ষক শাহনেওয়াজ পারভীন, ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক সুরাইয়া নাসরিন, প্রভাতী শাখার ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষক কামরুন্নাহার চৌধুরী, লক্ষ্মীরানী, ফেরদৌসী ও নুশরাত জাহান। এর বাইরেও আরও শিক্ষকের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান হতে পারে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে।
অভিযোগ প্রমাণ হলে জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। তিনি বলেন, সরকারি ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করবেন এটাই নিয়ম। সরকারি অনুমোদন ছাড়া এর বাইরে যদি তারা কিছু (কোচিং) করেন, সেটা আমরা দুর্নীতির মধ্যেই ফেলব। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আইনিব্যবস্থাও নেয়া হবে। কোচিং-বাণিজ্য নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে একধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। কোচিং-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের চিহ্নিত করার কাজও চলছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০২ সাল থেকে একের পর এক প্রতিষ্ঠানপ্রধান বদল হতে থাকে।
অনিয়ম-দুর্নীতিও বাড়তে থাকে। শিক্ষক ও প্রশাসনিক লোকবল নিয়োগে অভিযোগ উঠতে থাকে অনিয়মের। এছাড়া যোগ্যদের পাশ কাটিয়ে পদোন্নতির অভিযোগও রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। অভিযোগ আছে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতারও। কোনো ধরনের অনিয়ম প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির প্রেসিডেন্ট গোলাম আশরাফ তালুকদার। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, দুদকের বিষয়গুলোয় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে সংস্থাটি। তবে আমাদের পক্ষ থেকে শিক্ষকদের প্রতি বার্তা হলো, কেউ যাতে অবৈধভাবে কোচিং না করান। কেউ যদি এ নিষেধ অমান্য করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে নীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিষয়ভিত্তিকের মতো শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিংয়ের জন্য শিক্ষক নিয়োগ প্রয়োজন। আমাদের স্কুলে শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং করানো হলেও তা খুব কম। এটি আরও বাড়ানো হবে। ২০১২ সালের ২০ জুন কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ করতে নীতিমালা তৈরি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অভিযোগ আছে, এ নীতিমালা উপেক্ষা করে এখনো চলছে শিক্ষকদের কোচিং-বাণিজ্য। নীতিমালায় নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং অথবা প্রাইভেট পড়াতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন ছাত্র-ছাত্রীকে নিজ বাসায় পড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে লিখিতভাবে ছাত্র-ছাত্রীর নাম ও রোল নম্বরসহ তালিকা জানাতে হবে। শুধু তা-ই নয়, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা ওই ১০ শিক্ষার্থীর মধ্যে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজনকে পড়ালেও তাকে অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।
কোচিং সেন্টারের নামে বাসাভাড়া নেয়ার ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধের কথা বলা হয়েছে। এমনকি কোনো শিক্ষক বাণিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠা কোচিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত হতে পারবেন না। শাস্তির বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকারি বা এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কোচিং-বাণিজ্যে জড়িত থাকলে সাময়িক বা চূড়ান্ত বরখাস্ত, এমপিওভুক্ত শিক্ষক হলে এমপিও স্থগিত, বাতিল, বেতন-ভাতাদি স্থগিত, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, বেতন একধাপ অবনমিতকরণ ইত্যাদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যাবে। এদিকে, অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তপ্ত পরিস্থিতি কিছুটা নিবৃত হলেও অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি এখনো। ছয় দফা দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস পেয়ে গত বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানটির আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ কর্মসূচি স্থগিত করে ক্লাস-পরীক্ষায় ফিরে গেলেও আরেক দল শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার হওয়া শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে।
তারা বলছে, অরিত্রী আমাদের বোন, হাসনা হেনা আমাদের মা। তার সসম্মানে মুক্তি চাই। তাদের দাবি হাসনা হেনা নিরপরাধ। অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় তিনি কোনোভাবেই জড়িত নন। হাসনা হেনাকে বলির পাঁঠা বানিয়ে এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে মামলার অন্য দুই আসামি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ও প্রভাতি শাখার প্রধান জিনাত আখতার। অন্যদিকে, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডিও এখনো রয়েছে বহাল তবিয়তে। স্কুলের এক অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভিকারুননিসার গভর্নিং বডি সরকারি কোনো বিধিবিধানের তোয়াক্কা করে না। দুর্নীতি ও শিক্ষা-বাণিজ্যের আখড়ায় পরিণত করেছে প্রতিষ্ঠানটিকে। এসবের অভিঘাত এসে পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপর। অরিত্রী তার শেষ শিকার।
প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ও প্রভাতি শাখার প্রধান জিনাত আখতারকেও মামলায় আসামি করা হয়েছে অথচ তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। শুধু তাই নয়, দুর্নীতির হোতা গোটা গভর্নিং বডি। তাদের পদত্যাগের দাবি উঠলেও তারা এখনো বহাল তবিয়তে আছে। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এত দিন পর ভিকারুননিসার যত অব্যবস্থাপনা, তার হদিশ তুলে আনছে। এত দিন তারা কোথায় ছিলেন? ভিকারুননিসার সব অপকর্মের সঙ্গেই মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদের ব্যক্তিরা জড়িত। এসবের হদিশ কারা তুলে আনবে? অরিত্রীর আত্মহত্যার পর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ত্বরিত গতিতে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি।
দুই দিনের মধ্যে সে কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। মন্ত্রী দাবি করেন, অরিত্রীর আত্মহত্যার পেছনে সংশ্লিষ্ট আসামিদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি গত বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, অরিত্রীর বাবা-মা যখন আবেদন নিয়ে আসেন তখন প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস, প্রভাতি শাখার শিফট ইনচার্জ জিনাত আক্তার ও শ্রেণি শিক্ষক ভয়ভীতি দেখান। অরিত্রীর পিতা-মাতার সঙ্গে অধ্যক্ষ ও শিফট ইনচার্জ নির্মম ও নির্দয় আচরণ করেন, যা অরিত্রীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। অরিত্রীর পিতামাতার প্রতি অসম্মানের বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি বলেই তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে বলে তদন্ত কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়। যার দায় কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠান প্রধান, শিফট ইনচার্জ ও শ্রেণি শিক্ষিকা এড়াতে পারেন না।’
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য র্যাব ও পুলিশকে চিঠি দেওয়া হওয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে। এদিকে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নানা অনিয়ম উঠে এসেছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র। ক্ষমতা ও দুর্নীতিকে অবাধ করতে গভর্নিং বডি ইচ্ছে করেই প্রতিষ্ঠানটিতে অধ্যক্ষ পদে কাউকে নিয়োগ দিচ্ছিল না কয়েক বছর ধরে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে দিয়ে নানা অপকর্ম করনো হয়। পদাধিকার বলে অধ্যক্ষ যেহেতু গভর্নিং বডির সদস্য সচিব সেহেতু তাদের কাছে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষই অধিকতর নিরাপদ। এ প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি মন্ত্রণালয়ের কোনো নির্দেশই মানে না বলেও প্রতিবেদনে উঠে আসে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও শাখাপ্রধান অভিভাবকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান না এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সদাচরণ করেন না।
ক্লাসে অতিরিক্তি শিক্ষার্থী ভর্তি, অতিরিক্ত ও বর্ধিত ফি আদায়, কোচিং-ব্যবসা, কোচিং না করলে ফেল করিয়ে দেওয়া, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জিম্মি করাসহ নানা অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। এসব বিষয় ওপেন সিক্রেট হলেও কোনো অভিভাবক মুখ খুলতে চান না। একাধিক অভিভাবক জানান, ভিকারুননিসায় শিক্ষকদের কাছে কোচিং করা অলিখিতভাবে বাধ্যতামূলক। প্রায় সব বিষয়েই কোচিং করানো হয়। কোচিংয়ে না গেলে ফেল করানোর অভিযোগও করেন বেশকয়েকজন। ভিকারুননিসার কয়েকজন অভিভাবকের করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্কুল-কলেজের পরিচালনা পর্ষদে স্থানীয় এমপিদের সভাপতি পদে থাকার পথ বন্ধ করে ২০১৬ সালে জুনে উচ্চ আদালত থেকে রায় আসে। এরপর ২০১৭ সালের এপ্রিলে ভিকারুননিসার গভর্নিং বডির সভাপতি নির্বাচিত হন গোলাম আশরাফ তালুকদার। যিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর।