দিনশেষে শুধুই অবজ্ঞা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আছিয়া খাতুন ঘরের বারান্দায় বসে রান্নার জন্য শাক কুটছিলেন। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তার বারো বছর বয়সী মেয়ে তানজিনা আক্তার। কথা হচ্ছিল তানজিনার সঙ্গে। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে তানজিনা জানায়, তার বাবা কৃষিকাজ করেন। মা কী করেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তানজিনা মুচকি হেসে বলে, ‘আম্মা কিতা করব, কিচ্ছু করে না।’ তানজিনা সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার সদর ইউনিয়নের আতকাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শুকুর আলীর মেয়ে।

বর্ষায় হাওরপাড়ের জীবন প্রায় সাত মাস কর্মহীন হয়ে পড়ে। অথই পানিতে আটকাপড়া পরিবেশেই গবাদি পশু লালন-পালনের কাজটি করতে হয় কৃষকদের। তখন মাঠে চরানোর মতো সুযোগ না থাকায় গোয়ালঘর বা বাড়ির উঠানে রেখেই কোনো রকমে গবাদি পশুর যত্ন নিতে হয়। হাওরাঞ্চলের পুরুষরা তখন এ-বাড়ি ও-বাড়ির আলগঘরে (বাড়ির মূল ঘরের বাইরে মেহমানদের জন্য অতিরিক্ত ছোট ঘর) গল্প-আড্ডায় সময় কাটান। পুরো বর্ষায় গবাদি পশুর দেখাশোনা বা যত্ন নেওয়ার প্রধান দায়িত্ব বাড়ির নারী সদস্যদেরই পালন করতে হয়। বৈশাখে জমিয়ে রাখা শুকনো খড়, প্রতিদিনের ভাতের মাড়, বাজার থেকে কিনে আনা কুঁড়ো ও ভুসি খাওয়ানোর পাশাপাশি গোয়ালঘর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ নারীদের সামলাতে হয়। এসব কাজের পাশাপাশি স্বামী-সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা-যত্নও তাদেরই করতে হয়। নারীরা উদয়াস্ত পুরুষের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি কাজে যুক্ত থাকলেও পান থেকে চুন খসলে দিনশেষে শুধুই অবজ্ঞার পাত্রী হতে হয়। তবু তানজিনার মতো তাদের সন্তানরাও মায়ের পেশা কী জানতে চাইলে নির্দি্বধায় বলে দেয়, ‘মা কিছুই করে না।’ নারীদের গৃহস্থালি তো বটেই, কৃষিকাজও পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে কোনো কাজ হিসেবেই বিবেচিত হয় না।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৯ ভাগ নারী, যাদের শতকরা ৮৬ ভাগেরই বসবাস গ্রামে। এসব গ্রামীণ নারীরা কাঠ-খড় পুড়িয়ে প্রতিদিন তিনবেলা রান্না করেন। এখনও অনেক গ্রামে বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাস পৌঁছেনি। গ্রামীণ জীবনে এলপি গ্যাস এবং আধুনিক চুলার ছোঁয়া লাগলেও তা সংখ্যার দিক থেকে অতি নগণ্য। হাওরপাড়ের নারীরা রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে ‘মুইট্টা’ বা ‘ঘসি’ ব্যবহার করেন। গরুর গোবর দুই বা আড়াই ফুট লম্বা পাটকাঠিতে লাগিয়ে ও খড়ের সঙ্গে মিশিয়ে এই বিশেষ জ্বালানি তৈরি করা হয়। আর এই কাজটিও করতে হয় নারীদের। শুকনো মৌসুমে তৈরি এসব ‘মুইট্টা’ বা ‘ঘসি’ পুরো বর্ষা মৌসুমে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

শীত ক্রমেই এগিয়ে আসছে। তাই দেশের বিভিন্ন এলাকায় শীতকালীন সবজি উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পুরোদমে। দীর্ঘকাল ধরে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের কাজিরগাঁও, শরীয়তপুর, শান্তিপুর, ইসলামপুর, বেরিকান্দা, গোলকপুর গ্রামের কৃষকরা আলু, মরিচ, টমেটো, মুলা, লাউ, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পেঁয়াজ, রসুনসহ বিভিন্ন জাতের শীতকালীন সবজি চাষ করেন। পুরুষরা জমি তৈরির কাজটি করে দিলেও চারা উৎপাদন থেকে শুরু করে চারা লাগানোর কাজটি করেন পরিবারের নারী সদস্যরা। পুরুষ সদস্যরা হাওরে বোরো ফসল ফলানোর কাজে ব্যস্ত থাকায় সবজির জমি নিড়ানো, পানি দেওয়াসহ যাবতীয় পরিচর্যার কাজটিও করতে হয় নারীদের। উৎপাদিত এসব সবজি জমি থেকে উত্তোলনের পর বাজার উপযোগী করে তোলার কাজেও রয়েছে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শান্তিপুর গ্রামের হালিমা খাতুন বলেন, বাজারে নিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত সবজিবাগান তার। কিন্তু এরপর তিনি আর কিছুই জানতে পারেন না।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর মজুরিবিহীন এবং স্বীকৃতিহীন কাজ বা অবদানের আর্থিক মূল্য নিরূপণ এবং জিডিপির মানদণ্ডে তার তুলনা করার উদ্দেশে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে ‘জাতীয় অর্থনীতিতে নারীদের অবদান নিরূপণ : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক একটি গবেষণায় দেখা যায়, ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সের একজন নারী সমবয়সী একজন পুরুষের তুলনায় প্রায় তিন গুণ সময় এমন কাজে নিয়োজিত থাকেন যা জিডিপিতে ধরা হয় না। একজন নারী মজুরিবিহীন কাজে প্রতিদিন গড়ে আট ঘণ্টা এবং একই কাজে একজন পুরুষ প্রতিদিন ২.৫ ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন। একজন নারী প্রতিদিন গড়ে ১২.১টি মজুরিবিহীন কাজ করেন, যা জিডিপিতে যোগ করা হয় না। পুরুষের ক্ষেত্রে এ ধরনের কাজের সংখ্যা ২.৭টি।

২০১৭ সালে এপ্রিল মাসে হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ রক্ষায় স্বেচ্ছাশ্রমে টানা ২৩ দিন কাজ করেছিলেন সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলী ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মনেছা বেগম। হাওরে বোরো ফসল অকাল বন্যার কবলে পড়লে ফসল রক্ষা বাঁধ টিকিয়ে রাখতে মনেছা বেগমের মতো অনেকই নারীই স্বোচ্ছাশ্রমে বাঁধ রক্ষায় কাজ করে যান। কেউ কেউ কাঁচি নিয়ে নেমে পড়েন ফসলের জমিতে। তলিয়ে যাওয়ার আগে যতটুকু সম্ভব ধান তুলে আনার চেষ্টা করেন নারীরা। মনেছা বেগম বলেন, ‘আমার এমন কাজের জন্য আমি পুরস্কৃত হয়েছি। নারীদের কাজকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই।’ বাংলাদেশ কৃষক লীগের মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামীমা শাহরিয়ার বলেন, ‘হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ টিকিয়ে রাখতে নারীরাও সমান তালে কাজ করে যান। তাই ফসল রক্ষা বাঁধের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে (পিআইসি) নারী সদস্য অন্তর্ভুক্তির জন্য গত বোরো মৌসুমে আমি সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম। আমার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নারীকে প্রাধান্য দিয়ে প্রতিটি পিআইসিতে একজন করে নারী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘কৃষিতে নারীর অবদান অস্বীকার করা যাবে না। সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন গৃহস্থালিতেও নারীর কাজের স্বীকৃতি মিলবে।’

অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ‘রান্নাবান্না আর কৃষি কাজের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কাজ কাজই। উত্তরবঙ্গে সাঁওতাল নারীরা কৃষি কাজ করছেন। মধুপুর, ময়মনসিংহে গারো, হাজং এবং নিম্ন আয়ের মুসলিম নারীরা কৃষি কাজ করে রোজগার করছেন। তাদের কাজ পুরুষের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়। তবে এখানে একটি ঐতিহাসিক ফারাক আছে। তাদের (নারী) পুরুষের তুলনায় মজুরি কম দেওয়া হয়। এটা কিছুটা পুরুষতান্ত্রিক এবং সামাজিক বাড়াবাড়ি ও অবিচার।’

কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘এগুলোর জন্য স্ট্যাটিস্টিকস ও আলাদা মিনিস্ট্রি রয়েছে। তারা এটা হিসাব করবে। নারী সংগঠনগুলো ও মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এই কাজগুলো দেখবে। যেহেতু কৃষিটা প্রাইভেট সেক্টরে আছে, সেখানে আমরা তাদের ঘাড় ধরে কিছু করাতে পারব না। আমরা চেষ্টা করি যাতে আমাদের কোনো প্রকল্পে মেয়েরা আসতে পারে; কিন্তু সেখানে যদি মজুরি বৈষম্য হয়, সেটা আমরা কারেক্ট করতে পারি।’ কৃষিতে নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য নিয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘এটা আমাদের তরফ থেকে নেই। কৃষিটা হয় প্রাইভেট সেক্টরে। এলাকাভিত্তিক মজুরি বৈষম্য রয়েছে। কাজেই দক্ষিণে একরকম মজুরি, উত্তরে অন্যরকম।’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর