ঢাকা ০২:০৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ডিএনসিসির উন্নয়ন প্রকল্পে আড়াই হাজার কোটি টাকার অনিয়ম

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৩:৪৫:৩৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৯ অক্টোবর ২০১৫
  • ২৫৩ বার

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২০১২-১৪ অর্থবছরের উন্নয়ন প্রকল্পে আড়াই হাজার কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে। সংস্থার খোদ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাই এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। নিজের স্বার্থ রক্ষায় সরকারি নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে চুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে তিনি সুবিধা দিয়েছেন। এতে সংস্থার কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি বেহাত হয়েছে। এছাড়া নিজেদের ও বিভিন্ন দাতা সংস্থার দেয়া দান অনুদানের কোনো হিসাব সংরক্ষণ করা হয়নি। সরকারের খোদ অডিট বিভাগ এই অনিয়মের আপত্তি তুলেছে।

বলা হয়েছে, এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের থেকে আর্থিক ক্ষতির সমপরিমাণ টাকা আদায় করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু এর পরেও অধরাই থেকে যাচ্ছে জড়িতরা। নিষ্পত্তিও করা হচ্ছে না আপত্তিগুলো। অভিযোগ থেকে নিজেদের রক্ষা পেতে নানা ধরনের অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন জড়িতরা।

এসব প্রকল্পে অডিট আপত্তির বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে জবাব চাওয়া হয়েছে। কিন্তু সন্তোষজনক জবাব না হওয়ায় গত ২৫ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-সচিব কাজী আসাদুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক পত্রে সংস্থার শীর্ষ এই কর্মকর্তাকে ৩১ আগস্টের মধ্যে পুনরায় জবাব পাঠাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ওই জবাবেও মন্ত্রণালয় সন্তোষ নয় বলে জানা গেছে।

অনুসন্ধানে উদ্ধার করা নথিপত্রে দেখা গেছে, করপোরেশনের স্বার্থ বিবেচনা না করে ডিএনসিসির আওতাধীন মোহাম্মদপুর টাউনহল সংলগ্ন এলাকার ৭ বিঘা জমি চুক্তির মাধ্যমে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে। এতে ডিএনসিসির প্রায় ৫৬০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ডেভেলপারের মাধ্যমে বনানী সুপার মার্কেট কাম-হাউজিং কমপ্লেক্স নির্মাণেও ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।

একই সঙ্গে গুলশান- ২ এর ৪৫ কাঠা জমি কম শেয়ারে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে দেয়ায় ডিএনসিসির আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩৫২ কোটি। রায়েরবাজারের সাড়ে ৪ বিঘার বেশি জমি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অসম চুক্তি করায় ডিএনসিসির আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে অন্তত ৪৩০ কোটি টাকা। এছাড়া অন্যান্য আরো অন্তত ১০টি প্রকল্পে ব্যয়ের নামে আত্মসাৎ হয়েছে আরও প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।

অডিট আপত্তিতে দেখা গেছে, গুলশান-২ এর বাণিজ্যিক এলাকায় টেন্ডার ছাড়া মাত্র ২৫ ভাগ শেয়ারের বিনিময়ে নামমাত্র মূল্যে দুই বিঘা পাঁচ কাঠা জমি দেয়া হয়েছে ইউনাইটেড সিটি টুইন টাওয়ার ডেভেলপারস লিমিটেড নামে একটি কোম্পানিকে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ এলাকায় প্রতিকাঠা জমির মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে বাণিজ্যিক জমি ডেভেলপ করতে জমির মালিককে কাঠা প্রতি প্রায় দুই কোটি টাকা সাইনিং মানি দেয়া হয়। জমির ডেভেলপার চুক্তিতে মালিকপক্ষ ৬০ ভাগ এবং নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ৪০ ভাগ শেয়ার পেয়ে থাকে। কিন্তু ডিএনসিসি মাত্র ২৫ ভাগ শেয়ারের বিনিময়ে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করায় বাজারমূল্য অনুপাতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৬ কাঠা জমি। যার বাজার দর ৩২০ কোটি টাকা। একই সঙ্গে সাইনিং মানি বাবদ ৩২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

২০০৩ সালের ৩ মে সম্পাদিত এ চুক্তির কাজ গত অর্থবছরে শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে ডেভেলপার কোম্পানি ১৫ তলা ভবন গড়ে তুলেছে। ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের কাজ চলমান রয়েছে। আগামী বিজয় দিবসের আগেই ওই ভবনে নিজেদের অংশে অস্থায়ী কার্যালয় করার ঘোষণা দিয়েছেন সংস্থার মেয়র আনিসুল হক। সব মিলিয়ে প্রকল্পটিতে ডিএনসিসির আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩৫২ কোটি টাকা।

একই চিত্র দেখা গেছে বহুতল বিশিষ্ট মোহাম্মদপুর টাউন হল কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পেও। এতে মাত্র ৩০ ভাগ শেয়ারের বিনিময়ে ডিএনসিসির সাত বিঘা জমি একই কোম্পানি এমআর ট্রেডিংকে দেয়া হয়েছে। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। মাত্র ৩০ কোটি ১৫ লাখ টাকার ব্যয়ে নির্মিত একটি বাণিজ্যিক ভবনের বিনিময়ে জয়গাটি ডেভেলপার কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে।

এখানকার জমির বাজারমূল্য বিশ্লেষণে জানা যায়, এই এলাকার প্রতি কাঠা বাণিজ্যিক জমির বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। এলাকায় জমির ডেভেলপার চুক্তিতে মালিকপক্ষ ৬০ ভাগ এবং নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ৪০ ভাগ শেয়ার পেয়ে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কম বেশিও হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে জমির মালিককে কাঠাপ্রতি প্রায় কোটি টাকা সাইনিং মানি দেয়া হয়। কিন্তু ডিএনসিসির এমন স্বর্ণতুল্য জমি ডেভেলপার কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে মাত্র ৩০ ভাগ শেয়ার মূল্যের বিনিময়ে। আর ১৪০ কোটি টাকা সাইনিং মানি পাওয়ার কথা থাকলেও তা পায়নি ডিএনসিসি। এতে একদিকে ৩০ ভাগ কম শেয়ারে ডেভেলপার কোম্পানিকে জায়গাটির দলিল বুঝিয়ে দেয়া, অন্যদিকে সাইনিং মানি ছাড়াই চুক্তি সম্পন্ন করায় দুই ধরনের ক্ষতি হয়েছে ডিএনসিসির। দু’টি খাতে এ প্রকল্পে সংস্থার ক্ষতি হয়েছে ৫৬০ কোটি টাকা।

২০০৭ সালে সম্পাদিত ওই চুক্তিতে বলা হয়েছে, পরবর্তী ৫ বছরের মধ্যে জায়গাটিতে ২০ তলা বিশিষ্ট একটি মার্কেট করে তা ডিএনসিসিকে বুঝিয়ে দিতে হবে। কিন্তু সে মোতাবেক ২০১২ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও এখনও প্রকল্পের কাজ শুরুই করতে পারেনি ডেভেলপার কোম্পানি। চুক্তি ভঙ্গের দায়ে প্রকল্পটি বাতিল হওয়ার কথা থাকলেও এখনো সে চুক্তি বহাল রয়েছে।

শুধু গুলশান কিংবা মোহাম্মদপুর নয়। একই চিত্র বহুতল বিশিষ্ট রাজধানীর রায়েরবাজার ডিসিসি কমার্শিয়াল কাম এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পও। প্রকল্পটিতে ডিএনসিসির নিজস্ব চার দশমিক ৭২৫ বিঘা জমি মাত্র ২৫ ভাগ শেয়ারের বিনিময়ে এমআর ট্রেডিং নামে একটি কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে। এতে নেয়া হয়নি কোনো সাইনিং মানিও।

বাজারমূল্য অনুযায়ী ওই এলাকার প্রতি কাঠা জমির দাম প্রায় ১০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এ প্রকল্পে ডিএনসিসির ক্ষতি হয়েছে অন্তত ৪৩০ কোটি টাকা। ২০০৭ সালে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী পাঁচ বছরের মধ্যে ওই জায়গায় ২০ তলা ভবন নির্মাণ করে সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেয়ার কথা থাকলেও জমি সংক্রান্ত জটিলতার অভিযোগে এখনও উদ্যোগী সংস্থাকে সাইট হস্তান্তর করা সম্ভব হয়নি।

১৬ তলা ফাউন্ডেশন বিশিষ্ট রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানী সুপার মার্কেট কাম-হাউজিং কমপ্লেক্স নির্মাণে ডিএনসিসির নিজস্ব অর্থায়নে ৩ তলা নির্মাণের পর মাত্র ৩০ ভাগ শেয়ারের বিনিময়ে এক লাখ ২৩ হাজার ৪ বর্গফুট জায়গা বোরাক রিয়েল এস্টেট লিমিটেড নামে একটি ডেভেলপর কোম্পানিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পে ডিএনসিসির কমপক্ষে ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

অডিট বিভাগের আরো বেশ কিছু আপত্তি রয়েছে ডিএনসিসির উন্নয়ন প্রকল্পে। এরমধ্যে নগরীর বিভিন্ন স্থানের সড়ক সংস্কারে রেডি মিক্স কংক্রিট ঢালাইয়ের নকশা ও মূল প্রাক্কলন অপেক্ষা চূড়ান্ত বিলে কাজের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ্যে ব্যাপক গড়মিল করে ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করায় ডিএনসিসির অতিরিক্ত ২১ লাখ ৭৭ হাজার ৮৩৬ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দেয়া ২২৭ কোটি ২৩ লাখ টাকার কোনো হিসাব সংরক্ষণ করা হয়নি।

সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পুনর্বাসন কাজের ৯২ লাখ টাকার কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। একই সঙ্গে আয়কর ও ভ্যাট বাবদ আট লাখ ২৮ হাজার টাকার কর্তন করা হয়নি। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (পিপিআর) বিধিমালা লঙ্ঘন করে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার একক কাজ একাধিক প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে। একাধিক কাজের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ না দেয়ায় ডিএনসিসির অতিরিক্ত ২৯ লাখ ৫৫ হাজার ৩৮৭ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

এছাড়াও গাবতলী, মহাখালী ও আমিনবাজার বাসটার্মিনালের দরপত্র আহ্বান না করে নিজেদের মনোনীত এজেন্ট নিয়োগ, খনন করা রাস্তা থেকে বালুর মূল্য বাদ না দিয়ে মাটির মূল্য বাদ দেয়া, অনুমোদন ও মন্ত্রণালয়ের সংগঠন ও সরঞ্জাম তালিকায় (টি অ্যান্ড ই) অন্তর্ভুক্তি না করে ৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয়ে ২টি বুলডোজার ও একটি গাড়ি ক্রয়, অনুমতি ছাড়াই ট্রাকস্ট্যান্ড স্থাপন করায় ডিএনসিসির অন্তত ৩০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলেও উঠে এসেছে সরকারের অডিট বিভাগের আপত্তিপত্রে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র আনিসুল হক বলেন, ‘দুর্নীতিবাজরা সব সময় নিজেদেরকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখেই কাজ করে। তাদের অনিয়মের কোনো ডকুমেন্ট নেই। তাই তাদেরকে ধরা যাচ্ছে না। তাছাড়া আগে কী হয়েছে এগুলো নিয়ে আমি ঘাটাঘাটি করতে চাই না।

এসব বিষয়ে গত ২৫ আগস্ট মন্ত্রণালয় থেকে ডিএনসিসিতে পাঠানো অডিট বিভাগের এক আপত্তিপত্রে এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে বলা হয়েছে। এ জন্য মন্ত্রণালয় ও ডিএনসিসির কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। অভিযুক্তদের কাছ থেকে ডিএনসিসির আর্থিক ক্ষতির টাকা আদায় এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতেও সুপারিশ করা হয় অডিট বিভাগের ওই পত্রে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিএম এনামুল হক বাংলামেইলকে বলেন, ‘এসব অডিট আপত্তিগুলো সাবেক মেয়রের সময় হয়েছে। সেখানে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আমার দায়িত্ব পালনকালে যেসব আপত্তি এসেছে সেগুলোর অধিকাংশের জবাব আমরা দিয়েছি।’

বাংলামেইল

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

ডিএনসিসির উন্নয়ন প্রকল্পে আড়াই হাজার কোটি টাকার অনিয়ম

আপডেট টাইম : ০৩:৪৫:৩৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৯ অক্টোবর ২০১৫

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২০১২-১৪ অর্থবছরের উন্নয়ন প্রকল্পে আড়াই হাজার কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে। সংস্থার খোদ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাই এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। নিজের স্বার্থ রক্ষায় সরকারি নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে চুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে তিনি সুবিধা দিয়েছেন। এতে সংস্থার কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি বেহাত হয়েছে। এছাড়া নিজেদের ও বিভিন্ন দাতা সংস্থার দেয়া দান অনুদানের কোনো হিসাব সংরক্ষণ করা হয়নি। সরকারের খোদ অডিট বিভাগ এই অনিয়মের আপত্তি তুলেছে।

বলা হয়েছে, এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের থেকে আর্থিক ক্ষতির সমপরিমাণ টাকা আদায় করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু এর পরেও অধরাই থেকে যাচ্ছে জড়িতরা। নিষ্পত্তিও করা হচ্ছে না আপত্তিগুলো। অভিযোগ থেকে নিজেদের রক্ষা পেতে নানা ধরনের অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন জড়িতরা।

এসব প্রকল্পে অডিট আপত্তির বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে জবাব চাওয়া হয়েছে। কিন্তু সন্তোষজনক জবাব না হওয়ায় গত ২৫ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-সচিব কাজী আসাদুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক পত্রে সংস্থার শীর্ষ এই কর্মকর্তাকে ৩১ আগস্টের মধ্যে পুনরায় জবাব পাঠাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ওই জবাবেও মন্ত্রণালয় সন্তোষ নয় বলে জানা গেছে।

অনুসন্ধানে উদ্ধার করা নথিপত্রে দেখা গেছে, করপোরেশনের স্বার্থ বিবেচনা না করে ডিএনসিসির আওতাধীন মোহাম্মদপুর টাউনহল সংলগ্ন এলাকার ৭ বিঘা জমি চুক্তির মাধ্যমে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে। এতে ডিএনসিসির প্রায় ৫৬০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ডেভেলপারের মাধ্যমে বনানী সুপার মার্কেট কাম-হাউজিং কমপ্লেক্স নির্মাণেও ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।

একই সঙ্গে গুলশান- ২ এর ৪৫ কাঠা জমি কম শেয়ারে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে দেয়ায় ডিএনসিসির আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩৫২ কোটি। রায়েরবাজারের সাড়ে ৪ বিঘার বেশি জমি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অসম চুক্তি করায় ডিএনসিসির আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে অন্তত ৪৩০ কোটি টাকা। এছাড়া অন্যান্য আরো অন্তত ১০টি প্রকল্পে ব্যয়ের নামে আত্মসাৎ হয়েছে আরও প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।

অডিট আপত্তিতে দেখা গেছে, গুলশান-২ এর বাণিজ্যিক এলাকায় টেন্ডার ছাড়া মাত্র ২৫ ভাগ শেয়ারের বিনিময়ে নামমাত্র মূল্যে দুই বিঘা পাঁচ কাঠা জমি দেয়া হয়েছে ইউনাইটেড সিটি টুইন টাওয়ার ডেভেলপারস লিমিটেড নামে একটি কোম্পানিকে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ এলাকায় প্রতিকাঠা জমির মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে বাণিজ্যিক জমি ডেভেলপ করতে জমির মালিককে কাঠা প্রতি প্রায় দুই কোটি টাকা সাইনিং মানি দেয়া হয়। জমির ডেভেলপার চুক্তিতে মালিকপক্ষ ৬০ ভাগ এবং নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ৪০ ভাগ শেয়ার পেয়ে থাকে। কিন্তু ডিএনসিসি মাত্র ২৫ ভাগ শেয়ারের বিনিময়ে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করায় বাজারমূল্য অনুপাতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৬ কাঠা জমি। যার বাজার দর ৩২০ কোটি টাকা। একই সঙ্গে সাইনিং মানি বাবদ ৩২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

২০০৩ সালের ৩ মে সম্পাদিত এ চুক্তির কাজ গত অর্থবছরে শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে ডেভেলপার কোম্পানি ১৫ তলা ভবন গড়ে তুলেছে। ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের কাজ চলমান রয়েছে। আগামী বিজয় দিবসের আগেই ওই ভবনে নিজেদের অংশে অস্থায়ী কার্যালয় করার ঘোষণা দিয়েছেন সংস্থার মেয়র আনিসুল হক। সব মিলিয়ে প্রকল্পটিতে ডিএনসিসির আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩৫২ কোটি টাকা।

একই চিত্র দেখা গেছে বহুতল বিশিষ্ট মোহাম্মদপুর টাউন হল কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পেও। এতে মাত্র ৩০ ভাগ শেয়ারের বিনিময়ে ডিএনসিসির সাত বিঘা জমি একই কোম্পানি এমআর ট্রেডিংকে দেয়া হয়েছে। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। মাত্র ৩০ কোটি ১৫ লাখ টাকার ব্যয়ে নির্মিত একটি বাণিজ্যিক ভবনের বিনিময়ে জয়গাটি ডেভেলপার কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে।

এখানকার জমির বাজারমূল্য বিশ্লেষণে জানা যায়, এই এলাকার প্রতি কাঠা বাণিজ্যিক জমির বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। এলাকায় জমির ডেভেলপার চুক্তিতে মালিকপক্ষ ৬০ ভাগ এবং নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ৪০ ভাগ শেয়ার পেয়ে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কম বেশিও হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে জমির মালিককে কাঠাপ্রতি প্রায় কোটি টাকা সাইনিং মানি দেয়া হয়। কিন্তু ডিএনসিসির এমন স্বর্ণতুল্য জমি ডেভেলপার কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে মাত্র ৩০ ভাগ শেয়ার মূল্যের বিনিময়ে। আর ১৪০ কোটি টাকা সাইনিং মানি পাওয়ার কথা থাকলেও তা পায়নি ডিএনসিসি। এতে একদিকে ৩০ ভাগ কম শেয়ারে ডেভেলপার কোম্পানিকে জায়গাটির দলিল বুঝিয়ে দেয়া, অন্যদিকে সাইনিং মানি ছাড়াই চুক্তি সম্পন্ন করায় দুই ধরনের ক্ষতি হয়েছে ডিএনসিসির। দু’টি খাতে এ প্রকল্পে সংস্থার ক্ষতি হয়েছে ৫৬০ কোটি টাকা।

২০০৭ সালে সম্পাদিত ওই চুক্তিতে বলা হয়েছে, পরবর্তী ৫ বছরের মধ্যে জায়গাটিতে ২০ তলা বিশিষ্ট একটি মার্কেট করে তা ডিএনসিসিকে বুঝিয়ে দিতে হবে। কিন্তু সে মোতাবেক ২০১২ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও এখনও প্রকল্পের কাজ শুরুই করতে পারেনি ডেভেলপার কোম্পানি। চুক্তি ভঙ্গের দায়ে প্রকল্পটি বাতিল হওয়ার কথা থাকলেও এখনো সে চুক্তি বহাল রয়েছে।

শুধু গুলশান কিংবা মোহাম্মদপুর নয়। একই চিত্র বহুতল বিশিষ্ট রাজধানীর রায়েরবাজার ডিসিসি কমার্শিয়াল কাম এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পও। প্রকল্পটিতে ডিএনসিসির নিজস্ব চার দশমিক ৭২৫ বিঘা জমি মাত্র ২৫ ভাগ শেয়ারের বিনিময়ে এমআর ট্রেডিং নামে একটি কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে। এতে নেয়া হয়নি কোনো সাইনিং মানিও।

বাজারমূল্য অনুযায়ী ওই এলাকার প্রতি কাঠা জমির দাম প্রায় ১০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এ প্রকল্পে ডিএনসিসির ক্ষতি হয়েছে অন্তত ৪৩০ কোটি টাকা। ২০০৭ সালে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী পাঁচ বছরের মধ্যে ওই জায়গায় ২০ তলা ভবন নির্মাণ করে সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেয়ার কথা থাকলেও জমি সংক্রান্ত জটিলতার অভিযোগে এখনও উদ্যোগী সংস্থাকে সাইট হস্তান্তর করা সম্ভব হয়নি।

১৬ তলা ফাউন্ডেশন বিশিষ্ট রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানী সুপার মার্কেট কাম-হাউজিং কমপ্লেক্স নির্মাণে ডিএনসিসির নিজস্ব অর্থায়নে ৩ তলা নির্মাণের পর মাত্র ৩০ ভাগ শেয়ারের বিনিময়ে এক লাখ ২৩ হাজার ৪ বর্গফুট জায়গা বোরাক রিয়েল এস্টেট লিমিটেড নামে একটি ডেভেলপর কোম্পানিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পে ডিএনসিসির কমপক্ষে ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

অডিট বিভাগের আরো বেশ কিছু আপত্তি রয়েছে ডিএনসিসির উন্নয়ন প্রকল্পে। এরমধ্যে নগরীর বিভিন্ন স্থানের সড়ক সংস্কারে রেডি মিক্স কংক্রিট ঢালাইয়ের নকশা ও মূল প্রাক্কলন অপেক্ষা চূড়ান্ত বিলে কাজের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ্যে ব্যাপক গড়মিল করে ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করায় ডিএনসিসির অতিরিক্ত ২১ লাখ ৭৭ হাজার ৮৩৬ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দেয়া ২২৭ কোটি ২৩ লাখ টাকার কোনো হিসাব সংরক্ষণ করা হয়নি।

সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পুনর্বাসন কাজের ৯২ লাখ টাকার কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। একই সঙ্গে আয়কর ও ভ্যাট বাবদ আট লাখ ২৮ হাজার টাকার কর্তন করা হয়নি। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (পিপিআর) বিধিমালা লঙ্ঘন করে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার একক কাজ একাধিক প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে। একাধিক কাজের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ না দেয়ায় ডিএনসিসির অতিরিক্ত ২৯ লাখ ৫৫ হাজার ৩৮৭ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

এছাড়াও গাবতলী, মহাখালী ও আমিনবাজার বাসটার্মিনালের দরপত্র আহ্বান না করে নিজেদের মনোনীত এজেন্ট নিয়োগ, খনন করা রাস্তা থেকে বালুর মূল্য বাদ না দিয়ে মাটির মূল্য বাদ দেয়া, অনুমোদন ও মন্ত্রণালয়ের সংগঠন ও সরঞ্জাম তালিকায় (টি অ্যান্ড ই) অন্তর্ভুক্তি না করে ৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয়ে ২টি বুলডোজার ও একটি গাড়ি ক্রয়, অনুমতি ছাড়াই ট্রাকস্ট্যান্ড স্থাপন করায় ডিএনসিসির অন্তত ৩০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলেও উঠে এসেছে সরকারের অডিট বিভাগের আপত্তিপত্রে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র আনিসুল হক বলেন, ‘দুর্নীতিবাজরা সব সময় নিজেদেরকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখেই কাজ করে। তাদের অনিয়মের কোনো ডকুমেন্ট নেই। তাই তাদেরকে ধরা যাচ্ছে না। তাছাড়া আগে কী হয়েছে এগুলো নিয়ে আমি ঘাটাঘাটি করতে চাই না।

এসব বিষয়ে গত ২৫ আগস্ট মন্ত্রণালয় থেকে ডিএনসিসিতে পাঠানো অডিট বিভাগের এক আপত্তিপত্রে এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে বলা হয়েছে। এ জন্য মন্ত্রণালয় ও ডিএনসিসির কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। অভিযুক্তদের কাছ থেকে ডিএনসিসির আর্থিক ক্ষতির টাকা আদায় এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতেও সুপারিশ করা হয় অডিট বিভাগের ওই পত্রে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিএম এনামুল হক বাংলামেইলকে বলেন, ‘এসব অডিট আপত্তিগুলো সাবেক মেয়রের সময় হয়েছে। সেখানে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আমার দায়িত্ব পালনকালে যেসব আপত্তি এসেছে সেগুলোর অধিকাংশের জবাব আমরা দিয়েছি।’

বাংলামেইল