১৩ হত্যার মূলে ভিন্ন মতাদর্শ

তাঁরা সবাই ইসলাম ধর্ম প্রচারেই কাজ করতেন। তবে তাঁদের প্রচারের পদ্ধতি ছিল কিছুটা ভিন্ন। গত দুই বছরে ঘটেছে এমন চাঞ্চল্যকর ছয় হত্যাকাণ্ড, যার একটিরও রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশসহ তদন্তসংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ গত সোমবার রাতে রাজধানীর মধ্য বাড্ডায় মুহাম্মদ খিজির খান নামের এক পীরকে জবাই করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এর আগে পাঁচটি ঘটনায় ১২ জনকে একইভাবে গলা কেটে হত্যা করা হয়।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও স্বজনরা বলছেন, আগের ঘটনাগুলোর সঙ্গে খিজির খান হত্যার ধরন অনেকটাই মিলে গেছে। গোয়েন্দারা বলছে, উগ্রবাদী গোষ্ঠী ভিন্নমতাদর্শীদের গুপ্ত হত্যায় নেমেছে। এই গোপন খুনিদের নাগাল পাননি তদন্তকারীরা। আগের পাঁচ ঘটনার সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত খিজির খান হত্যায় জেএমবি জড়িত কি না সে ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা মেলেনি। তবে উগ্রবাদী কোনো গোষ্ঠী এই খুনে জড়িত থাকতে পারে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

গোয়েন্দারা বলছে, জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ সন্দেহভাজন জঙ্গি সংগঠনগুলো আহলে হাদিস মতাদর্শী। নিহতরা ছিলেন আহলে সুন্নাত মতাদর্শের। তাঁরা পীর এবং কিছুটা ভিন্ন মতাদর্শ প্রচার করতেন। সব ঘটনায়ই সাত-আটজন বাসায় ঢুকে গলা কেটে হত্যা করে। খুনিরা বাড়ির অন্য লোকজনকে বেঁধে রাখে। খুনিদের মধ্যে এক বা একাধিক ব্যক্তি শ্মশ্রুমণ্ডিত ছিল। এসব আলামতের মধ্যেই খিজির খান খুনের মিল খুঁজছেন তদন্তকারীরা। তাঁরা বলছেন, নিহত খিজির খান ‘নক্সবন্দিয়া মোজাদ্দেদিয়া তরিকার’ পীর ছিলেন। তাঁর বাড়িতেই তিনি খানকাহ শরিফ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর বাবাও পীর ছিলেন। খিজির একই ধরনের ২২টি খানকাহ শরিফের প্রধান ছিলেন। তিনি ইসলামী বয়ান, মাহফিলসহ ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও প্রচারণায় অংশ নিয়ে হাদিয়ার নামে টাকা আদায়ের ঘোর বিরোধিতা করতেন। এ কারণে তিনি উগ্রবাদী কোনো গোষ্ঠীর টার্গেটে পরিণত হয়েছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাওলানা ফারুকী ও গোপীবাগের ছয় খুনের সাদৃশ্য এবং কিছু তথ্যের ভিত্তিতে আমরা ধারণা করছি জেএমবির অনুসারী গোষ্ঠী এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং আলামত যাচাই করে দুই খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করেছি। তবে খুনি শণাক্ত করা যায়নি।’

সূত্র জানায়, গত দুই বছরে সাতজন ব্লগারকে গলা কেটে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনায় জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) অনুসারীরা জড়িত বলে তথ্য পাচ্ছে গোয়েন্দারা। দুটি ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। তবে পীর ও ভিন্ন মতাদর্শীদের হত্যার সঙ্গে এসব খুনের ধরন মিলছে না। এবিটির সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা ব্লগার হত্যার দায় স্বীকার করলেও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের খুনের ব্যাপারে কিছু জানায়নি। এদিকে অর্থের জোগান পেয়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা জেএমবির পলাতক জঙ্গিরা ত্রিশালে আসামি ছিনতাইসহ কয়েকটি ঘটনা ঘটিয়েছে। এ কারণে তারা ভিন্নমতের ওপর ‘আঘাত হানার’ পরিকল্পনায় জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গোপীবাগের ছয় খুন : ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর গোপীবাগের রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ৬৪/৬ নম্বর চারতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলার বাসায় মুরিদ সেজে ঢুকে কথিত পীর লুৎফর রহমান ফারুকসহ ছয়জনকে জবাই করে সাত-আটজনের একটি দল। এ সময় হত্যা করা হয় ফারুকের ছেলে সারোয়ার ইসলাম ফারুক ওরফে মনির, খাদেম মঞ্জুর আলম মঞ্জু, মুরিদ শাহিন, রাসেল ও মুজিবুল সরকারকে। স্বজন ও তদন্তকারীরা জানান, দলটি বাসায় ঢুকে ঘরের নারীদের একটি কক্ষে আটকে ফেলে। এরপর পাশের কক্ষে ছয়জনকে জবাই করে। এ ঘটনায় ওয়ারী থানায় দায়েরকৃত মামলাটির তদন্তভার ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। লুৎফর রহমান ফারুক নিজেকে ইমাম মেহেদির প্রধান সেনাপতি এবং পীর বলে দাবি করতেন। তিনি নিজের ভক্তদের ভিন্ন নিয়মে নামাজ ও রোজা রাখার পরামর্শ দিতেন। হত্যাকাণ্ডের রাতে খুনিরা ভক্ত সেজেই তাঁর বাসায় আসে। পরে বাহাসে (বিতর্ক) লিপ্ত হয় এবং একপর্যায়ে ছয়জনকে অস্ত্রের মুখে বেঁধে ফেলে। সূত্র জানায়, গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে তিন জঙ্গি ছিনতাইয়ের মামলায় গ্রেপ্তার করা আসামি আজমীর, গোলাম সরোয়ার রাহাত, জিয়াউল ইসলাম জিতু ও আল আমিন জেল হাজতে ছিলেন। এই চারজনকে গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ছয় খুনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের নির্দেশে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবি। তবে দুই দফায় রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে রহস্যের কোনো কিনারা করতে পারেননি তদন্তকারীরা। এরই মধ্যে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তাও পরিবর্তন করা হয়েছে। তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা, পরিদর্শক আবু আল খায়ের মাতব্বর পদোন্নতি পেলে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় আরেক পরিদর্শক কবির হোসেনকে।

মামলাটির বাদী ও লুৎফর রহমান ফারুকের ছেলে আবদুল্লাহ আল ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুই বছর হয়ে গেল ডিবি কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেনি। আমরা জানি না কেন কিছু হচ্ছে না। পীর হওয়ার কারণে বাবার কিছু শত্রু ছিল। সেসব বলার পরও কাজ হয়নি।’

মামলার আগের তদন্ত কর্মকর্তা আবু আল খায়ের মাতব্বর বলেন, ‘জেএমবি বা এমন কোনো জঙ্গি সংগঠন এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলে ধারণা পাওয়া গেছে। তবে কোনো সূত্র মেলেনি। গ্রেপ্তারকৃতরা মুখ খোলেনি।’

মাওলানা ফারুকী হত্যা : গত বছরের ২৭ আগস্ট পূর্ব রাজাবাজারের ১৭৪ নম্বর বাড়ির ভাড়া বাসায় হজে যাওয়ার ব্যাপারে আলাপ করার ছলে ঢুকে শায়খ মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকীকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিনি টেলিভিশনে ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ও ইসলামী ফ্রন্টের নেতা ছিলেন। স্বজন ও তদন্তকারীদের তথ্য মতে, আহলে সুন্নাতের অনুসারী ছিলেন মাওলানা ফারুকী। তিনি টিভি অনুষ্ঠান ‘শান্তির পথে’ ও ‘কাফেলা’য় নিজের ধর্মীয় মতাদর্শ প্রচার করতেন। সেখানে তিনি মাজার জিয়ারত এবং মিলাদ পড়ানোর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। তাঁর পরিবারের দাবি, ওহাবি ও খারিজি সম্প্রদায় বা কোনো উগ্র মৌলবাদী-জঙ্গিগোষ্ঠী ফারুকীর খুনি। নিহতের ছেলে ফয়সাল ফারুকী বাদী হয়ে শেরে বাংলানগর থানায় হত্যা মামলা করেন। বিরোধী বক্তব্য ও হুমকির কারণে গত ৪ সেপ্টেম্বর টিভির ছয় ইসলামী বক্তার বিরুদ্ধে ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে আরেকটি মামলা করেন ইসলামী ছাত্রসেনার ঢাকা মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক। তদন্তে নেমে ডিবি প্রথমেই মাহমুদা খাতুন, শরিফুল ইসলাম ও ইউসুফ নামের তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এদিকে ফেসবুক ও ব্লগে ফারুকীকে মাজারের পূজারি, দজ্জাল, খাজাবাবাসহ বিভিন্ন নাম দেওয়ার পাশাপাশি হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। ইউটিউবের ভিডিওচিত্রে ফারুকীর ওপর ক্রসচিহ্ন দেখা গেছে। ‘বুড়ির বড়ই গাছের কাঁটা’ নামের একটি ভিডিওচিত্রের সূত্র ধরে গত বছরের ৭ নভেম্বর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে মোজাফফর বিন মোহসিন নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। মোজাফফর পিস টিভির উপস্থাপক এবং ‘উগ্রবাদী বক্তা’ বলে পরিচিত। এসব আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেও রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি ডিবি। মাওলানা ফারুকীর ছেলে ফয়সাল ফারুকী বলেন, ‘আমাদের সন্দেহের বিষয়গুলো আমরা বলেছি। তবে কিছুই বের হয়নি। মামলাটি ডিবির কাছ থেকে সিআইডিতে গেছে। তবু কোনো ফল হয়নি।’

জানতে চাইলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ সুপার (এসএস) মির্জা আবদুল্লাহ-হেল-বাকী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সম্প্রতি মামলাটি আমাদের কাছে এসেছে। এখনো কাগজপত্র বুঝে নেওয়ার কাজ চলছে। অগ্রগতি বলতে তেমন কিছু নেই।’

খালিশপুরে বাবা-ছেলে খুন : ২০১৩ সালের ৮ আগস্ট ঈদুল ফিতরের আগের দিন খুলনার খালিশপুরে কথিত ধর্মীয় নেতা তৈয়েবুর রহমান ও তাঁর কিশোর ছেলে নাজমুম মনিরকে জবাই করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। খুনিরা ভক্ত সেজে বাসায় ঢুকে ঘটনাটি ঘটায়। মুসলিম উম্মাহ নামের একটি সংগঠনের প্রধান ছিলেন তৈয়েবুর। ওই সংগঠনের সদস্যরা শনিবার জুমা ও প্রতিদিন তিন ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। রোজা রাখতেন ১০টি। নিজেকে উম্মুল মুমিনিন বলেও দাবি করতেন তৈয়েবুর। খালিশপুর থানা ও খুলনা মহানগর পুলিশের (কেএমপি) বরাত দিতে খুলনার নিজস্ব প্রতিবেদক গৌরাঙ্গ নন্দী জানান, এই চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি হয়নি। খালিশপুর থানার ওসি এস এম আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি নতুন এই থানায় এসেছি। এই মামলার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানাতে হবে।’

চট্টগ্রামের জোড়া খুন : গত ৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে চট্টগ্রামের শেরশাহ বাংলাবাজারের পূর্বাচল এলাকায় স্থানীয়ভাবে ‘লেংটা মামু’ নামে পরিচিত ফকির রহমত উল্লাহর আস্তানায় গিয়ে তাঁকে এবং তাঁর খাদেম আবদুল কাদেরকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। স্থানীয়রা ধাওয়া করলে হাতবোমা ফাটিয়ে পালিয়ে যায় খুনির দল। সে সময় বোমার স্প্লিন্টারে আহত হন দুইজন। ঘটনার দিন ওই এলাকা থেকে আবদুল মান্নান মনা নামের একজনকে আটক করে পুলিশ। ধারণা করা হয়, ফকিরের ব্যক্তিগত শত্রু বা ভিন্ন মতাদর্শীরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পরে। এক মাস পর গত সোমবার কর্ণফুলী থানার খোয়াজনগর আজিমপাড়া এলাকার আইয়ুব বিবি সিটি করপোরেশন কলেজ রোডের কাছে একটি বাড়ি ও নগরীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান জাবেদসহ পাঁচ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। গতকাল ভোরে অক্সিজেন এলাকায় অভিযানের সময় জাবেদ গ্রেনেড বিস্ফোরণে নিহত হয়। অন্য আসামিদের মধ্যে সুজন ওরফে বাবু (২৮) ফকির লেংটা মামু হত্যায় জড়িত ছিল বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে। চট্টগ্রামের ডিবি পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) বাবুল আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাবু ওই খুনে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে, জেএমবির একটি পক্ষ ভিন্নমত দমনের জন্য হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে।’

এ ছাড়া ২০১০ সালে রাশিদুল ইসলাম নামের এক জেএমবির সদস্য সংগঠনের কর্মকাণ্ড থেকে সরে গিয়ে আত্মসমর্পণের উদ্যাগ নেন। এরপর উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরে তাঁকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে কয়েকজন। রাশিদুল দক্ষিণখানে মোল্লাটেক মসজিদের ইমাম ও দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ২০০৫ সালে সিরিজ বোমা হামলায় অংশ নেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতার তিনটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিলের অপেক্ষায় ছিল। এই হত্যায় কারা জড়িত ছিল তার রহস্য এখনো উন্মোচিত হয়নি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর